Originally posted in বণিকবার্তা on 20 August 2024
ব্যাংক খাতের সংস্কারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি ব্যাংকিং কমিশন করছে এটা খুবই ভালো খবর। উচ্চ খেলাপি ঋণ ও সুশাসনের অভাবের কারণে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে যে অস্থিরতা চলছিল তা মোকাবেলায় দীর্ঘদিন ধরেই আমরা এ দাবি উঠিয়ে আসছিলাম। দেরিতে হলেও ব্যাংকিং কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত।
বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চ হারের খেলাপি ঋণ এবং বিভিন্ন আর্থিক সূচকে অধোগতি। বিদ্যমান নাজুক অবস্থায় ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম করে তোলা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ খাতের দুর্বলতা সার্বিক অর্থনীতিকেও ঝুঁকিতে ফেলে স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের সম্ভাবনাকে ব্যাহত করে।
দুঃখজনক যে বিভিন্ন নীতি আলোচনা ও কৌশলগত পরিকল্পনায় বারবার বলা হলেও পূর্ববর্তী সরকার ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে যথাযথ পদক্ষেপের ঘাটতিতে খাতটি আরো বেশি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি সুকার্যকর ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থার গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবং নিয়মতান্ত্রিক ঝুঁকি কমাতে ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী করা কেবল প্রয়োজনই নয়, বরং একটি কৌশলগত বাধ্যবাধকতা।
ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো নানাভাবে উন্মোচিত হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে ব্যাংক পরিচালক নিয়োগ, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ প্রদান, খারাপ পরিশোধের রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও ঋণ পুনঃতফসিল, করের বোঝা কমানো এবং ব্যাংকের ব্যালান্স শিট পরিষ্কার করার জন্য ঋণ মওকুফ করা, দুর্বল অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, অপর্যাপ্ত কমপ্লায়েন্স এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং কিছু ব্যাংকের আন্তর্জাতিক মান পূরণে ব্যর্থতা। এছাড়া নিয়ন্ত্রকদের দুর্বলতাও এ খাতের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতার অভাব, বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) নিয়ন্ত্রণ, খেলাপিদের প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের নমনীয়তা, ক্ষমতাসীনদের কাছের লোকদের খেয়ালখুশিমতো ব্যাংক লাইসেন্স প্রদান, সরকারের হাত ধরে ব্যাংকের পুনর্মূলধন সংগ্রহ ও কয়েকটি ব্যাংকে অলিগার্কের অনেকটা একচেটিয়া ক্ষমতা উপভোগ।
ব্যাংক খাতের দুর্বলতার সবচেয়ে আশঙ্কাজনক নির্দেশক হলো, গত ১৫ বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত খেলাপি ঋণ (এনপিএল)। এ পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে পূর্ববর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকদের সরাসরি ও পরোক্ষ সমর্থনের কারণে। ২০০৯ সালে ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা, যা বেড়ে মার্চ ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। সংখ্যাটি আসলে আরো অনেক বেশি হতে পারে। কারণ এতে বিলম্বিত সম্পদ, শ্রেণীবদ্ধ ঋণ, আদালতের নিষেধাজ্ঞাপত্রাধীন ঋণ এবং পুনঃতফসীলকৃত ঋণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
উচ্চ মাত্রার খেলাপি ঋণ ব্যাংকের ঋণদান ক্ষমতা ব্যাহত করে, ফলে তারা ঋণ প্রসারে বাধাগ্রস্ত হয় এবং সুদের আয় থেকে বঞ্চিত হয়। এছাড়া উচ্চ মাত্রার খেলাপি ঋণ ব্যাংকের ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, ফলে তহবিলের খরচ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া ব্যাংকগুলোকে তাদের ঘাটতি মেটাতে বিকল্প খুঁজতে হয়। এতে তাদের সম্পদ, শেয়ার মূলধন এবং পুঁজির ওপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলে।
প্রায়ই ঋণগুলো সঠিক বাণিজ্যিক বিবেচনা ছাড়াই অনুমোদিত হয়েছে, যা পূর্ববর্তী শাসনামলে খেলাপির ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না, তখন ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশ ব্যাংক তার স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা হারানোর কারণে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের শাস্তি দিতে পারেনি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষায় নীতি গ্রহণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বার বার ব্যাংকিং কোম্পানি আইন সুবিধাবাদীদের অনুকূলে পরিবর্তন করে ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেয়া হয়েছে।
ব্যাংক খাতের ক্রমশ খারাপ পারফরম্যান্সের কারণে আমরা ক্রমাগত একটি অস্থায়ী ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কথা বলেছি, যা জরুরিভিত্তিতে সমস্যাগুলো সমাধান করবে। ২০১২ সালের হলমার্ক কেলেংকারীর পর থেকে এ রকম একটি অস্থায়ী ব্যাংকিং কমিশন গঠনের প্রস্তাব ক্রমে জোরালো হতে থাকে, যদিও তৎকালীন সরকার এজন্য আমাদের সমালোচনা করত এবং খোঁড়া যুক্তি দিত। কিন্তু আমরা বলে এসেছি যে, এই কমিশনের উদ্দেশ্য হবে ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলোর বিস্তারিত তদন্ত করা এবং সমাধানের প্রস্তাব দেয়া। কমিশনকে কার্যকর করার জন্য এর কার্যপরিধি (টিওআর) স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিত এবং এর মধ্যে নিম্নলিখিত উদ্দেশ্যগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
প্রথমত, ব্যাংকিং কমিশনের উদ্দেশ্যগুলো স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে হওয়া উচিত। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত: (১) খাতের সামগ্রিক অবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মূল্যায়ন; (২) খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত তথ্যের প্রাপ্তি ও তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা; (৩) বর্তমান সমস্যা এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করা; (৪) খাতের সংকটের জন্য কোন কোন গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান দায়ী তা নির্ধারণ করা এবং (৫) প্রশাসনিক, নিয়ন্ত্রক, আইনগত ও কাঠামোগত সংস্কারের জন্য সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর সুপারিশ প্রদান করা।
দ্বিতীয়ত, কমিশনের সময়সূচি সংক্ষিপ্ত এবং সময়বদ্ধ হওয়া উচিত, তিন-চার মাসের বেশি না, যাতে সরকার দ্রুত বাস্তবায়ন শুরু করতে পারে।
তৃতীয়ত, কমিশনকে তার প্রতিবেদন প্রণয়নে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত। এ পদ্ধতিতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত: (১) বিদ্যমান তথ্য এবং তথ্য ব্যবহার করে ডেস্ক গবেষণা পরিচালনা করা; (২) সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে একক সভা করা; (৩) বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করা; (৪) জনসম্মেলন এবং শুনানি আয়োজন করা; এবং (৫) নীতিনির্ধারক, উদ্যোক্তা, ব্যাংক গ্রাহক, ছোট সঞ্চয়কারী, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী, বিশেষজ্ঞ, ব্যাংক কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকিং সম্পর্কিত সংস্থার প্রতিনিধি, নারী, যুবক, স্থানীয় সংগঠন এবং মিডিয়াসহ বিস্তৃত স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণ করা।
চতুর্থত, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য কমিশনকে তার অগ্রগতি সম্পর্কে জনগণকে নিয়মিতভাবে আপডেট করতে হবে। নাগরিকদের জন্য অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন প্রস্তুত এবং উপলব্ধ করা উচিত এবং স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া গ্রহণের জন্য চূড়ান্ত প্রতিবেদনের একটি খসড়া অনলাইনে পোস্ট করা উচিত।
পঞ্চমত, কমিশন সদস্যরা অত্যন্ত যোগ্য, অভিজ্ঞ, সৎ এবং নিরপেক্ষ হতে হবে এবং তাদের দায়িত্বগুলো সর্বোচ্চ পেশাদারত্বের সঙ্গে পালন করতে হবে।
ষষ্ঠত, কমিশনকে কোনো বহিঃপ্রভাব ছাড়াই স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি দেয়া উচিত।
সপ্তমত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কমিশনের সুপারিশগুলো কখন এবং কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তা উল্লেখ করে একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করা উচিত। সরকারকে এ সুপারিশগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন এবং ব্যাংক খাতে এর প্রভাব সম্পর্কে পূর্ণ স্বচ্ছতা প্রদান করতে হবে।
ব্যাংক খাত অবশ্যই অর্থনীতিতে বাণিজ্য ও ব্যবসায় প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশ সরকার জাতীয়করণ করা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বেসরকারীকরণের মাধ্যমে উদারীকরণ প্রক্রিয়া শুরু করে। এ সংস্কার প্রক্রিয়া ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকজুড়ে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নির্দেশনা অনুযায়ী চালু থাকে।
এ সংস্কারগুলোর পাশাপাশি ১৯৮৪ সালে ন্যাশনাল কমিশন অন মানি, ব্যাংকিং অ্যান্ড ক্রেডিট প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ সালে একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হয়, এরপর ২০০২ সালে একটি ব্যাংকিং সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়। ২০০৩ সালে ব্যাংক খাতের জন্য একটি শক্তিশালী এবং কার্যকর নিয়ন্ত্রক ও তত্ত্বাবধানের কাঠামো তৈরির জন্য ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক স্ট্রেংদেনিং প্রজেক্ট’ শুরু হয়। বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বায়ত্তশাসন প্রদানকারী বাংলাদেশ ব্যাংক সংশোধনী বিল ২০০৩ পাস হয়। তবে এ নির্দেশনা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক অবশেষে তার স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে।
এই ব্যাংকিং কমিশনের সফলতা ব্যাপক রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করে। কমিশনের সুপারিশগুলো কেবল তখনই ব্যাংক খাতকে উন্নত করতে পারে যখন এটিকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাজ করার অনুমতি দেয়া হয়। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তার মেয়াদকালে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বাস্তবায়নে নিবেদিত, তবে এটিও নিশ্চিত করতে হবে যে এ সংস্কারগুলো যাতে তার মেয়াদকালের পরও বজায় থাকে।
ড. ফাহমিদা খাতুন: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো