Published in প্রথম আলো on Friday, 22 December 2017
দেশের ব্যাংকিং খাতে নৈতিকতার সংকট চলছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, সংকটের পুরোটাই খেলাপি ঋণকে ঘিরে। অধিকাংশ ঋণগ্রহীতা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণের অর্থ পরিশোধ না কৌশল জেনে গেছেন। ফলে খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করার ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। এটি আর্থিক খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ জন্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় রাজনীতিকরণ ও নিয়ন্ত্রকের ব্যর্থতাই দায়ী।
রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশে গতকাল বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২০তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
অর্থনীতি সমিতির এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ‘অর্থশাস্ত্র ও নৈতিকতা’। এতে সম্মানীয় অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়নে বর্তমানে ১২টি সুনির্দিষ্ট নৈতিক বিষয় জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। শুরুতেই তিনি বলেন, বাংলাদেশের জমির মালিকানা, মূলধন ও প্রাতিষ্ঠানিক সম্পদের অসম বণ্টনের কারণে প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিতে সবার সমানভাবে অংশগ্রহণ করার সুযোগ নিশ্চিত করা যায়নি।
রেহমান সোবহান বলেন, ব্যাংকঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য চলছে। ব্যাংকার, ব্যাংক মালিক বা রাজনৈতিক সংযোগ থাকলেই ঋণ পাওয়ায় বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণের সমস্যাটি আশির দশকে জিয়াউর রহমানের শাসন আমলের শেষ বছর থেকে শুরু হয়েছে। বিষয়টি বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। শেয়ারবাজারকে ক্যাসিনোর (জুয়ার টেবিল) সঙ্গে তুলনা করেন তিনি।
রাজনীতিকে শক্তির উৎস হিসেবে উল্লেখ করে রেহমান সোবহান বলেন, রাজনীতিতেও সবার অংশগ্রহণ নেই। ধনী লোকজন রাজনীতিকে কুক্ষিগত করে রেখেছে। এটি গুরুতর সমস্যা। কারণ, গুটি কয়েক মানুষ রাজনীতিকে ব্যবহার করে সম্পদ বাড়িয়ে নিচ্ছেন। গণতন্ত্রকে গণতান্ত্রিক করতে নীতিনির্ধারকেরা ব্যর্থ হয়েছেন।
অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতিকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, সরকারের সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে অসমতা আছে। এটি গভীরভাবে নৈতিকতার সমস্যা। রাষ্ট্রের চোখে সবাই সমান হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে সেটি হচ্ছে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু জায়গার সেবা পেতে জনগণকে পয়সাও দিতে হচ্ছে। রেহমান সোবহান বলেন, কেবল অসম নীতির কারণে মানসম্মত শিক্ষা সবার জন্য নিশ্চিত করা যায়নি। এটি অনৈতিক। যাদের সামর্থ্য আছে, তারাই কেবল ব্যয়বহুল শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সমানভাবে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবাও দেওয়া যায়নি। আপনাকে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিতে গেলে টাকা দিতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, অর্থশাস্ত্রের সঙ্গে নৈতিকতা যুক্ত করার মধ্য দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য নিরসনে আরও কার্যকর নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ সম্ভব। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ও গণতন্ত্রের জন্য কাঠামোগত সমস্যা চিহ্নিত করে তা দূর করার পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সক্ষমতা তৈরি ও সুযোগের সমন্বয়। অর্থায়ন, নিম্নতম মজুরির মতো বিষয় পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।
অর্থনীতিশাস্ত্র চর্চা ও গবেষণায় অবদান রাখার জন্য অধ্যাপক রেহমান সোবহান, প্রয়াত মাহবুব হোসেন এবং অধ্যাপক আশরাফ উদ্দিন চৌধুরীকে স্বর্ণপদক দিয়েছে অর্থনীতি সমিতি। মাহবুব হোসেনের পক্ষে তাঁর মেয়ে শারমিন হোসেন পদক নেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন অর্থনীতি সমিতির সভাপতি আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক জামালউদ্দিন আহমেদ ও সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক আবুল বারকাত। তিন দিনের সম্মেলনের প্রথম দিন গতকাল চারটি বিশেষ অধিবেশনে পাঁচটি প্রবন্ধ পাঠ করা হয়।