Originally posted in বাংলা ট্রিবিউন on 22 August 2022
ব্যাংকে আমানত রেখে যে সুদ মিলছে, তা দিয়ে মূল্যস্ফীতির ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না। তবুও বাড়ছে ব্যাংকের আমানত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুনের তুলনায় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ, গত এক বছরে মানুষজন ব্যাংকে বেশি আমানত রেখেছেন।
তবে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্যে দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকার। ২০২১-২২ অর্থবছরে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ১৯ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি হয় ২ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকার। জুন মাসে মূল অর্থ জমা হয় ১০ হাজার ৭১২ কোটি টাকার, আর মুনাফা পরিশোধ হয়েছে ৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার। অর্থাৎ জুনে যারা সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই আর নতুন করে বিনিয়োগ করেননি। সে হিসাবে জুনে নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। ছয় মাস আগের সময়কে ভিত্তি ধরলে জুনে বিক্রি কম হয়েছে ৮৩৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ মে মাসে মোট জমা হয়েছে ৭ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। ওই সময়ে মূল অর্থ ও মুনাফা পরিশোধ করা হয়েছে ৭ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে ওই মাসে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৩৮ কোটি টাকা।
ধারণা করা হচ্ছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে জীবনযাত্রার মান ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে বেশি বিপাকে আছেন সীমিত আয়ের মানুষেরা।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘ব্যাংকের আমানত বাড়লেও মানুষের সঞ্চয় বেড়েছে এমনটি বলার সুযোগ নেই। কারণ, বিভিন্ন কারণে ব্যাংকের আমানত বাড়তে পারে। যেমন, বড় আমানতকারী অর্থাৎ শিল্পপতিদের আমানত বেড়েছে। যারা বিনিয়োগ করতে পারছেন না, তাদের টাকাও আমানত আকারে দেখাচ্ছে। এছাড়া অন্য বিকল্প অর্থ কোথাও ছিল, তা তুলে এনে প্রয়োজন মিটানোর জন্য এখন ব্যাংকে রেখেছেন, এমনটাও থাকতে পারে।’ তিনি মনে করেন, বাস্তবে ছোট আমানতকারীদের আমানতের পরিমাণ হয়তো কমে গেছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের সঞ্চয় কমেছে বলে দাবি করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে ব্যক্তিপর্যায়ের মেয়াদি আমানতে ব্যাংকগুলোতে সুদহার ছিল ৬ থেকে ৭ শতাংশে মধ্যে। আর দুর্বল ব্যাংকগুলোতে সুদহার ছিল আরও বেশি।
তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষের সঞ্চয় কমে গেছে। আর এ অবস্থা শুধু ব্যক্তিপর্যায়ের নয়, জাতীয়ভাবেও একই সমস্যা।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২ অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় দেশজ সঞ্চয় কমে আসছে। অর্থাৎ জিডিপি যে হারে বাড়ছে, সঞ্চয় সেভাবে বাড়ছে না। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশজ সঞ্চয় ছিল ২৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত জুন মাসে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অর্থাৎ গতবছরের জুনে যে জিনিস গড়ে ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, এই বছরের জুনে সেই জিনিস গড়ে ১০৭ টাকা ৫৬ পয়সায় কিনতে হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের জুনে যিনি ব্যাংকে গড়ে ১০০ টাকা জমা করতেন, এ বছরের জুনে তিনি ব্যাংকে জমা করেছেন গড়ে ১০৯ টাকা ৩৫ পয়সা।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়ায় মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা কমে যাচ্ছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় সেই অর্থ ফের যেকোনও মাধ্যম হয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলেই চলে গিয়ে সার্বিক আমানতের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুনের শেষে ব্যাংকগুলোতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ২৪ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকে রয়েছে ১১ লাখ ২ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ৬৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে রয়েছে ৪ লাখ ৯ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা বা ২৫ দশমিক ২০ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোতে রয়েছে ৬৮ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। বিশেষায়িত দুই ব্যাংকে রয়েছে ৪৩ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৭১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষে মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ১৪ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। আগের তিন মাসের চেয়ে তা ২ হাজার ৪২২ কোটি টাকা বেশি।
এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার হয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ।