Originally posted in দেশ রূপান্তর on 29 May 2025
স্বাধীনতা-পরবর্তী বিগত কয়েক দশকের পথপরিক্রমায় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সে সম্পর্কের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, বিনিয়োগ, যোগাযোগের মতো বিষয়ের যেমন সংশ্লেষ আছে, তেমনি আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার একটি উপাদানও সেখানে বর্তমান রয়েছে। দুই দেশই সার্কের সদস্য এবং সাফটার মাধ্যমে একটি মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল ব্যবস্থায় উভয় দেশই অন্তর্ভুক্ত। দুদেশের সম্পর্ক অবশ্য বিভিন্ন সময়ে নানা টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে নিকট অতীতের ঘনিষ্ঠ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক একটি ব্যতিক্রমী চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যদি কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করা হয়, তবে সাধারণত প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগ সম্পর্ক একটি নৈকট্যের মধ্যে অবস্থান করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ক্ষেত্রে এমনটি লক্ষ্য করা যায়, যেমন দৃশ্যমান আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মধ্যেও। এই ধারাবাহিকতায় বিগত সময়ে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সম্পর্কের ক্রম নৈকট্য বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবণতার মধ্যেই বিকশিত হয়েছে ও গভীরতর হয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক উপাদানও সেখানে অবদান রেখেছে।
বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় দেশই নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্য উদারীকরণ নীতি গ্রহণ করা শুরু করে। তখন থেকেই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক দ্রুত বিকশিত হতে থাকে। উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য সম্প্রসারিত হতে থাকে মূলত ব্যক্তি খাতের অগ্রণী ভূমিকার ওপর নির্ভর করেই। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় যারা প্রথাগতভাবে আগে অন্যান্য দেশ থেকে পণ্য আমদানি করতেন, তারা ভারত থেকে বেশি মাত্রায় আমদানি করা শুরু করেন। ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশটির উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়তে থাকে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে পণ্য আমদানির বিষয়ে বেশি মাত্রায় আগ্রহী হতে থাকেন। আমদানি প্রতিস্থাপনের এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভারত ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান আমদানির উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়। কয়েক বছর আগে ভারত থেকে আমদানি এক অর্থবছরে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলারে উঠে যায়, যদিও এই আমদানি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কিছুটা কমে এসেছে। তবে এই হ্রাসের ক্ষেত্রে কোনো কোনো পণ্যের মূল্য হ্রাসও একটি ভূমিকা রেখেছে। পণ্য আমদানি পরিমাণগতভাবে তাই হয়তো সেই মাত্রায় হ্রাস পায়নি।
ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্য, রপ্তানিমুখী পণ্যের জন্য কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য এবং আমদানি-প্রতিস্থাপক শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় নানা পণ্য। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতিও ভারত থেকে আমদানির তালিকায় আছে।
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। এ শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল তুলা, সুতা ও কাপড়ের একটি বড় অংশ ভারত থেকে আমদানি করা হয়। এসব কাঁচামাল দিয়ে প্রস্তুতকৃত তৈরি পোশাক আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছি। ভারতেও এর একটি অংশ রপ্তানি করছি। ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্য নির্ভর তৈরি পোশাকের একটি অংশ যুক্তরাষ্ট্রেও যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের যে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত বাণিজ্য রয়েছে, সেখানে ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের একটি বড় অবদান রয়েছে। ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য উদ্বৃত্তে অবদান রাখছে। এ ছাড়া ভারত থেকে যে খাদ্য-শস্য, সবজি ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়, সেটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মেটাতে এবং বাজার মূল্য স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকে।
আমাদের রপ্তানি মূলত তৈরি পোশাকনির্ভর। ফলে পণ্য বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে ভারতের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধি বেশ কঠিন, যেহেতু ভারত নিজেই বস্ত্র ও পোশাকের উৎপাদনে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সম্পন্ন একটি দেশ। তা সত্ত্বেও ২০১১ সাল থেকে ভারত যখন সাফটার অধীনে বাংলাদেশসহ সার্কভুক্ত স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে শূন্য শুল্কে পণ্য রপ্তানির সুবিধা প্রদান করা শুরু করে, তখন থেকে ভারতের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বাড়তে থাকে। এই চুক্তির অধীনে অস্ত্র ও মাদকসহ মোট ২৫টি পণ্য ব্যতীত অন্য সব পণ্যে বাংলাদেশ ভারতের বাজারে শূন্য শুল্কে পণ্য রপ্তানির সুবিধা পায়, যা ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যেহেতু বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত পণ্যগুলোর ওপর সাধারণভাবে ভারতে উচ্চ শুল্কহার বিদ্যমান, সেহেতু শূন্য শুল্কে প্রবেশাধিকার বাংলাদেশের পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে সময় লেগেছিল ৪০ বছরের মতো। আর শূন্য শুল্ক সুবিধা পাওয়ায় পরবর্তী ৫-৬ বছরের মধ্যে সেই রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয় (যদিও সাম্প্রতিক সময়ে তা ১.৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে)। বিশেষ করে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এক্ষেত্রে বেশ লাভবান হয়েছে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, ভারত নিজেই একটি বড় তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী ও রপ্তানিকারক দেশ। দেশটিতে তৈরি পোশাকের জন্য প্রয়োজনীয় তুলার প্রাপ্যতাসহ পশ্চাতসংযোগের ক্ষেত্রে বড় সক্ষমতা রয়েছে। বস্তুত এ শিল্পে ভারতের মূল্য সংযোজন শতভাগের কাছাকাছি। তা সত্ত্বেও শূন্য শুল্ক সুবিধার কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ভারতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জনে সক্ষম হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে ভারতে মোট যে পণ্য রপ্তানি হয়, তার এক-তৃতীয়াংশই তৈরি পোশাক। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশটিতে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৫৫ কোটি ডলারের মতো। এর বাইরে অন্যান্য পণ্যের রপ্তানিও শূন্য শুল্ক সুবিধার পর বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু যেমনটা প্রত্যাশা করা হয়েছিল বাংলাদেশ তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে রপ্তানি বৃদ্ধি করতে পারেনি। ভারত বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৭৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। সেই বিচারে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি উল্লেখযোগ্য নয়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক-নির্ভর রপ্তানি কাঠামো এবং সরবরাহের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাই এ ক্ষেত্রে মূলত দায়ী, যদিও বিভিন্ন অ-শুল্ক প্রতিবন্ধকতাও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বাণিজ্যের ৭০ শতাংশই সম্পন্ন হয় বিভিন্ন স্থলবন্দরের মাধ্যমে। এসব বন্দরের অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা, ওয়্যারহাউজ সুবিধার ঘাটতি, পরিবহনগত সমস্যা, সিঙ্গেল ইউন্ডো না থাকা, সময়ক্ষেপণসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ভারতের বাজারের সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেননি। তবে রপ্তানি না বাড়ার প্রধানতম কারণ হচ্ছে তৈরি পোশাকের বাইরে বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত পণ্যের বৈচিত্র্যের অনুপস্থিতি। ভারতের বাজার ধরতে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। ভারতের বাজারমুখী বিদেশি বিনিয়োগ; ভারত থেকে এবং ভারতের বাইরে থেকে। কিন্তু বাংলাদেশ ভারতের বাজারমুখী এবং শূন্য শুল্ক সুবিধার সুযোগ গ্রহণে আগ্রহী ভারতীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারেনি। যদিও বিগত সরকার ভারতকে দুটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশ-নির্দিষ্ট বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছিল। ভারতের বাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশে উৎপাদন কার্য পরিচালনার মাধ্যমে এবং যোগাযোগ, বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য এই তিনটি উপাদানের ত্রিমাত্রিক সংশ্লেষে ভারতের বাজারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রপ্তানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা অনর্জিতই থেকে গেছে।
বিভিন্ন মোডে যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য বিগত সরকার বেশ কিছু প্রচেষ্টা হাতে নিয়েছিল। নৌ প্রটোকল চুক্তি, উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি ও ২০১৫ সালে বিবিআইএন মোটরযান চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে সড়কপথে নিরিবচ্ছিন্ন যোগাযোগের জন্য একটি চুক্তিও সম্পাদন হয়েছিল। এসব চুক্তি খুব একটা কার্যকর হয়নি এবং পণ্যের বড় অংশের বাণিজ্য কার্যক্রম গতানুগতিকভাবেই স্থলবন্দরের লোডিং-আনলোডিং-রিলোডিংয়ের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়েছে। যেমন আশুগঞ্জে আন্তর্জাতিক নৌ-বন্দর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতের ত্রিপুরায় কলকাতা থেকে জাহাজের আনা মালামাল পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত ১০ বছরে ভারতের ব্যবসায়ীরা এসবের সুযোগ গ্রহণ করতে আগ্রহী হননি বিভিন্ন কারণে। যার মধ্যে অবকাঠামোগত দুর্বলতা ছিল প্রধান। বিবিআইএন মোটরযান চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল যাত্রী ও পণ্য চলাচল নির্বিঘ্ন করা, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি ও বাণিজ্য সম্প্রাসারণ। কিন্তু সেটি গত ১০ বছরেও কার্যকর হয়নি।
ভারতের সঙ্গে গত সরকার যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন চুক্তি করেছে। সেখানে বাংলাদেশের প্রাপ্য ফি ও চার্জ ঠিকভাবে নির্ধারিত হয়নি। এসব বিষয়ে বিগত সরকারের সমালোচনা যখন করা হয়েছে তখন তাকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়নি। বিভিন্ন চার্জ ও ফি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘বেনিফিট শেয়ারিং’-এর ব্যবস্থা চালু করার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এসব চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে বাণিজ্য কার্যক্রমে সময় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে যে সাশ্রয় হওয়ার কথা, সেটি দুই দেশ ভাগ করে নেবে, এটাই ছিল মূল প্রস্তাব। আমলারাই মূলত এসব আলোচনায় অংশ নিয়েছেন, বিশেষজ্ঞদের ডাকা হয়নি। ফলে পারস্পরিক সহযোগিতার দর্শন ও ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেছে, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে থাকত না। ভারত একটি বিশাল বাজার। অন্যদিকে বাংলাদেশের সরবরাহ সক্ষমতাও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধিমান। ফলে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কের নৈকট্য বাড়িয়ে বাংলাদেশের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তিনটি লাইন অব ক্রেডিটের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে প্রথম লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় ভারত পদ্মা সেতুতে ২০ কোটি ডলার অনুদান দিয়েছিল। বৃহত্তর পরিসরে ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কের নৈকট্য বাড়ানোর চেষ্টা ছিল। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও বাস্তবায়নের শর্তাবলি নিয়ে প্রশ্ন ছিল।
বর্তমানে দুদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমরা দেখছি যে বিভিন্ন পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এর ফলে দুই দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ সময়ে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ অবশ্য অভূতপূর্ব নয়। ২০০৭ সালের দিকে যখন বৈশি^ক খাদ্যসংকটের একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তখন ভারত চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল এবং পরবর্তী সময় চালের টনপ্রতি ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য ১ হাজার ডলার নির্ধারণ করেছিল। বাংলাদেশ এ কারণে তখন সমস্যায় পড়েছিল। যদিও ভারত সব দেশে রপ্তানির ক্ষেত্রেই অনুরূপ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সাম্প্রতিক অতীতে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের মতো সিদ্ধান্ত ভারত নিয়েছে।
বাংলাদেশের অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার আওতায় আমাদের তৈরি পোশাকের কিছু অংশ কলকাতা বিমানবন্দর ও দিল্লি বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে রপ্তানি করা হতো। কিন্তু সম্প্রতি ভারত সেই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে। এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার স্থলপথে ভারত থেকে সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ভারত আবার স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে; কেবল এখন কলকাতা ও মুম্বাইয়ের নওসেবা বন্দর দিয়ে ভারতে তৈরি পোশাক রপ্তানি করা যাবে। ফলে ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। উত্তর-পূর্ব ভারতে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের প্রাণসহ বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে। ভারত হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে অনেক রপ্তানি পণ্যবাহী ট্রাক আখাউড়া বন্দর পর্যন্ত গিয়েও ফেরত এসেছে। অনেকে পণ্য রপ্তানির ক্রয়াদেশ পেয়েছিল, যা প্রস্তুত করার পরও তারা রপ্তানি করতে পারেনি; ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপের পেছনে নানা অর্থনৈতিক যুক্তি দাঁড় করানো যেতে পারে। ভারত বলতে পারে যে, বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি হওয়ায় তাদের দেশীয় উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ভারতীয় উদ্যোক্তারা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন যে, স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি হলে বাংলাদেশি রপ্তানিকারক অপেক্ষাকৃত স্বল্প খরচে রপ্তানি করতে সক্ষম হয়, তারা আবার শূন্য শুল্কের সুবিধা পায়। এর ফলে ভারতীয় উৎপাদকরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেন না। কলকাতা ও নওসেবা বন্দর দিয়ে আমদানি হলে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের ব্যয় বেশি পড়বে এবং ভারতীয় উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে। একইভাবে বাংলাদেশও সুতার ক্ষেত্রে এমন যুক্তি দিতে পারে। কিন্তু মূল কথা হচ্ছে, এর ফলে কেবল রপ্তানিকারকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, আমদানিকারক ও স্থানীয় শিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যেমন স্থানীয় বাজারে সুতার মূল্য বেশি হলে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের ব্যয় বৃদ্ধি পায়। ভারত থেকে যেসব পণ্য আমদানি হয়, সেগুলো বাংলাদেশের ভোক্তাদের হাতে অপেক্ষাকৃত স্বল্পমূল্যে পণ্য প্রাপ্তিতে সহায়তা করে। পাশাপাশি আমাদের রপ্তানিমুখী ও আমদানি-প্রতিস্থাপক শিল্পের ব্যয় হ্রাস করে। বাংলাদেশ ভারতে যে রপ্তানি করে সে ক্ষেত্রেও এটা সমানভাবে প্রযোজ্য। তুলনামূলক সুবিধার ভিত্তিতে বাণিজ্য কার্যক্রম পরিচালনা সব স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষের জন্যই লাভজনক। বৈশ্বিক বাণিজ্যের ভিত্তিটাই এই। সুতরাং বিষয়টিকে বৃহত্তর পেক্ষাপটেই দেখতে হবে। রপ্তানি এবং আমদানি উভয়ই ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। আর এ বিষয়টি দুই দেশের জন্যই সত্য।
এটা ঠিক যে, আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের ওপর বাংলাদেশের একটা নির্ভরশীলতা আছে। কিন্তু অন্যদিকে ভারতেরও মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ তাদের একটি বড়, ১০-১২ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাজার। ভারতের উৎপাদক, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও অনেক রপ্তানিকারক এই বাজারের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে ভারতের সেবা খাতের রপ্তানির ক্ষেত্রেও এটা সত্য। এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। এক্ষেত্রে উভয়ের জন্যই লাভজনক হবে একটি ‘উইন উইন’ সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত রচনা। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত ও নিরুৎসাহিত করতে পারে, এমন ধরনের পদক্ষেপ কোনো পক্ষের জন্যই ইতিবাচক হবে না।
ভারত থেকে যে ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো পণ্য আমদানি হয়, তার বিপরীতে সরকার ১ বিলিয়ন ডলারের ওপরে শুল্ক পেয়ে থাকে। সেটি আবার বাংলাদেশের রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে জড়িত। সুতরাং এখানে অনেক বিষয় নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় রাখতে হবে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাজারে বাংলাদেশের জন্য একটি সহজাত সুযোগ বিদ্যমান। সেখানে বাংলাদেশের একটা তথাকথিত ‘ক্যাপটিভ মার্কেট’ হয়তো আছে। কিন্তু সেই বাজারের আকার বর্তমানে বেশ সীমিত। এই অঞ্চলটি যদি অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হয়, সেখানকার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, তাহলে বাংলাদেশের বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে আরও লাভবান হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এখানে আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার। তা হচ্ছে, আমরা মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এই বন্দরটি থেকে উপকৃত হতে পারে। আবার তারা এটি ব্যবহার করলে বন্দরের কার্যক্রম বাড়বে, যা এ বিশাল বিনিয়োগের রিটার্ন বৃদ্ধিতে এবং এটিকে লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
অনেকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে পরস্পর বিরোধী ও সাংঘর্ষিক হিসেবে মনে করেন। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য যেটা ইতিবাচক হবে তা হলো, দুই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অনুঘটক হিসেবে দেখা।
বৃহত্তর পেক্ষাপটে বাংলাদেশ ট্রান্স এশিয়ান রেল যোগাযোগ ও ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ের মধ্যে আছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে বাংলাদেশ অবস্থান করছে। সেক্ষেত্রে চীনের কুনমিং ও গুয়াংজুর সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দরগুলোর সংযোগ আমাদের বন্দরগুলোর জন্য বিশাল পশ্চাৎভূমি স্থাপনে সহায়ক হবে। এক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতাও প্রয়োজন হবে। এশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় দেশগুলোর সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে এগোতে পারলে বাংলাদেশ একবিংশ শতাব্দীর বিকাশমান সুযোগগুলো আরও ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারবে। যেমন ১৯৯৯ সালে বিসিআইএম ইকোনমিক করিডর শীর্ষক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যেখানে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার ছিল অংশগ্রহণকারী দেশ। শুরুতে কুনমিং ইনিশিয়েটিভ নাম নিয়ে যাত্রা করেছিল। এ উদ্যোগ অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিল। কুনমিং থেকে রুলি, মান্দালেই, ঢাকা, কলকাতা হয়ে কার র্যালিও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ বিষয়গুলোকে একটি বৃহত্তর পেক্ষাপটে দেখতে হবে, আমাদের ভূ-কৌশলগত অবস্থানের সুযোগ নিতে হবে। ভূ-অর্থনৈতিক সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভারত ও চীনের সঙ্গে একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে সামনের দিকে যদি বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে, তবে বাংলাদেশের জন্য সেটিই হবে যথাযথ উন্নয়ন কৌশল।
বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ব্যবসাবাণিজ্য-বিনিয়োগসহ বহুমাত্রিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ককে ভারতের বিপক্ষের কোনো বিষয় হিসেবে দেখা উচিত হবে না। অনুরূপভাবে ভারতের সঙ্গেও বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। সে সম্পর্ককে চীনের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো ঠিক হবে না। বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে বিমসটেকের সদস্য আছে। বিমসটেক মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল চুক্তি যদি হয়, তাহলে ভারত ও বাংলাদেশ আসিয়ান ও আরসেপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি বৃহত্তর এশীয় বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে। সেটিও হবে বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। ভারত বাংলাদেশকে যে শূন্য শুল্ক সুবিধা দিয়েছে, সেটা যাতে অব্যাহত থাকে সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। এটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, আগামী বছর বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হবে। তখন ভারতের বাজারে এই শূন্য শুল্ক সুবিধা থাকবে না। কাজেই এখন থেকেই ভারতের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করা উচিত যেন ভারত শূন্য শুল্ক সুবিধা অব্যাহত রাখে। যেমনিভাবে চীন এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা বাংলাদেশের জন্য অগ্রাধিকারমূলক শূন্য শুল্ক বাণিজ্য সুবিধা ২০২৮ সাল পর্যন্ত সম্প্রসারণ করবে। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুক্তরাজ্য ও কানাডা বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ২০২৯ সাল পর্যন্ত এলডিসির সুবিধা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে।
অর্থনীতির তাৎক্ষণিক প্রয়োজনের নিরিখে এমন সিদ্ধান্ত বিভিন্ন সময় নেওয়া হলেও এবারের পদক্ষেপগুলোর ক্ষেত্রে যে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে তা হলো পদক্ষেপগুলো অনেকটাই পাল্টাপাল্টি ধরনের যা দুই দেশের জন্যই নেতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে। পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ না নিয়ে, কীভাবে আমরা আগামী দিনে দুই দেশের অর্থনীতি ও উভয় দেশের জনগণের জন্য কল্যাণকর হবে, এমন একটি সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে একবিংশ শতাব্দীতে কীভাবে এগিয়ে যেতে পারি সে বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়াই সমীচীন হবে।
লেখক : সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)