Originally posted in দৈনিক সমকাল on 15 October 2024
চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর
অর্থনীতি ও নিরাপত্তায় জোর বাংলাদেশের
চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তা– দুই খাতেই সম্পর্ক গভীর করতে চায় বাংলাদেশ। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে চীনের সহযোগিতা করার সুযোগ রয়েছে। তবে চীনের অর্থায়ন ও ঋণ আরও ভালো করে খতিয়ে দেখতে হবে। ঋণের নানা শর্ত পুনর্মূল্যায়ন করা জরুরি। দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎকে সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভূরাজনৈতিক বাধা ও উদ্বেগ রয়েছে। এগুলো দূর করা না গেলে সম্পর্ক এগোবে না।
গতকাল সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশ-চীন রিলেশনস: এ ফিউচার আউটলুক’ শীর্ষক সেমিোরে এসব কথা বলা হয়। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উপলক্ষে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) ও সেন্টার ফর চায়না স্টাডিজ (এসআইআইএস-ডিইউ) যৌথভাবে এই আয়োজন করে। উদ্বোধন পর্ব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। বিআইএসএসের চেয়ারম্যান রাষ্ট্রদূত এ এফ এম গাউসুল আজম সরকারের
সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ইফতেখার আনিস। এ সময় বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন ও অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এসআইআইএস একাডেমিক উপদেষ্টা পরিষদের পরিচালক প্রফেসর ড. ইয়াং জিমিয়ান উদ্বোধন অধিবেশনে বিশেষ বক্তব্য দেন।
বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা– দুই খাতেই সম্পর্ক গভীর করতে চায় বলে উল্লেখ করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, দেশের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে প্রতিরক্ষা খাতে চীনের উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা রয়েছে। চীন থেকে আমাদের নিরাপত্তা সরঞ্জামের বড় অংশ আসে। এ সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য ঢাকা আগ্রহী, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে। দুই দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়লে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বাড়বে। এটি অন্যতম অগ্রাধিকার।
উপদেষ্টা বলেন, দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে চীনের সহযোগিতা করার সুযোগ রয়েছে। তবে প্রকল্পগুলো টেকসই হতে হবে জানিয়ে ভবিষ্যতে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিদ্যুৎ খাত, বিশেষ করে সবুজ জ্বালানিতে আমাদের সহযোগিতা প্রয়োজন হতে পারে। এ ছাড়া আইসিটি খাতে চীন বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে পারে, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।
রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ সংকটের সমাধান তাদের নিজ ভূমিতে ফেরত যাওয়া। এ ব্যাপারে চীনের সহযোগিতাকে সাধুবাদ জানাই। তবে দুর্ভাগ্যবশত তৃপক্ষীয় আলোচনা এখনও সফলতার মুখ দেখেনি। এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও নিজ ভূমিতে ফেরত যেতে পারেনি। সংকট সমাধানে চীনের আরও সক্রিয় ভূমিকা ঢাকা আশা করে বলে জানান তিনি। তৌহিদ হোসেন বলেন, চীন থেকে আমাদের অর্থপূর্ণ সহযোগিতা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে হবে।
বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে– মন্তব্য করে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। এখন বাংলাদেশ সংকটপূর্ণ ঐতিহাসিক সময় পার করছে। দুই দেশের সমন্বিত কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বের বিষয়ে তিনি বলেন, চীন রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবে। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং জনগণের জীবনযাত্রা উন্নয়নের বিষয়েও চীনের দৃঢ় সমর্থন থাকবে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীন সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক। সেই সঙ্গে এ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একত্রে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিকভাবে সমন্বয় শক্তিশালীকরণ এবং জাতিসংঘসহ অন্যান্য বহুপক্ষীয় ফোরামে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
চীনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশের চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। কর্ণফুলী টানেলের উপযোগিতার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, চীনের অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ আসলে কর্ণফুলী টানেল অর্থনৈতিকভাবে উপযোগী হবে। এ ছাড়া বিনিয়োগের ফলে বাংলাদেশ ও চীনের সহযোগিতাও বৃদ্ধি পাবে। বিগত সময়ে অর্থায়নের প্রশংসা করে তিনি বলেন, চীনের অর্থায়নে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। দুই দেশের সম্পর্ক চমৎকার। আমাদের দেখতে হবে, এ সম্পর্ক থেকে আমরা ভালো কিছু কীভাবে বের করে আনতে পারি। তবে প্রতিটি ভালো সম্পর্কেরই নিজস্ব কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে। আমাদের আমদানির এক-চতুর্থাংশ চীন থেকে আসে। এখানে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে আর্থিক সংকটে রয়েছে। আমদানির ক্ষেত্রে চীন আমাদের ঋণ দিতে পারে। এতে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে চাপ কম পড়বে। বর্তমানে চীন প্রায় ৬০০ কোটি ডলার বাংলাদেশের কাছে পাবে, যা মোট ঋণের ১০ শতাংশ। চীনের ঋণের দিকে তাকালে দেখা যায় অনেকগুলো সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট। এ ছাড়া এসব ঋণ স্বল্প সময়ের মধ্যে পরিশোধ করার মতো শর্ত রয়েছে। ফলে ভবিষ্যতের জন্য চীনের অর্থায়ন ও ঋণ আরও ভালো করে খতিয়ে দেখতে হবে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভূকৌশলগত কিছু বাধা রয়েছে। ভূকৌশলগত উদ্বেগগুলো দূর না করা গেলে বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক এগোবে না।
এ ছাড়া বিভিন্ন অধিবেশনে বক্তারা উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সহযোগিতা বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়েছে ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক হচ্ছে সম্পর্কের ভিত্তি। বক্তারা বাংলাদেশের বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে চীনের প্রশংসা করেন এবং বাংলাদেশের রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে চীনের গৃহীত বেশ কয়েকটি মূল উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন।
উদ্বোধন পর্ব ছাড়াও দিনব্যাপী সেমিনারে তিনটি অধিবেশন ছিল। ‘আঞ্চলিক পরিবর্তনশীলতায় বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক ভূদৃশ্যের প্রভাব’ শীর্ষক প্রথম কার্য অধিবেশনটি সঞ্চালনা করেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহান। ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংস্কার ও প্রবণতা’ শীর্ষক দ্বিতীয় কার্য অধিবেশন পরিচালনা করেন একাডেমি অব কনটেম্পরারি চায়না অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড স্টাডিজের অ্যাসোসিয়েট রিসার্চ ফেলো ড. ঝাং জিয়ান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসিন ‘চীন-বাংলাদেশ সহযোগিতা জোরদার এবং ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতা অংশীদারিত্বের অগ্রগতি’ শীর্ষক তৃতীয় কার্য অধিবেশন পরিচালনা করেন।