Published in Prothom Alo on Wednesday, 17 December 2014.
অর্থনীতি
মধ্যম আয়ের দেশ বনাম স্বল্পোন্নত দেশ
ফাহমিদা খাতুন
বর্তমানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বের দেশগুলোকে তাদের আয় এবং সামাজিক কিছু সূচকের ভিত্তিতে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে থাকে। এগুলো মধ্যে বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘ আলাদা আলাদা পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। যেমন, বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রদানের সুবিধার জন্য সদস্যদেশগুলোকে নিম্ন আয়ের দেশ, নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ, উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ এবং উচ্চ আয়ের দেশ—এই চার ভাগে ভাগ করেছে। ২০১৫ অর্থবছরে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে বিশ্বব্যাংকের অ্যাটলাস পদ্ধতিতে মাথাপিছু আয় এক হাজার ৪৫ থেকে চার হাজার ১২৫ ডলার হতে হবে। আর উচ্চমধ্যম আয়ের দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে চার হাজার ১২৬ থেকে ১২ হাজার ৭৪৫ ডলার। প্রতিবছর এই তালিকা নতুন করে তৈরি করা হয়। তবে এই ভাগটি শুধু আয়ভিত্তিক বলে এখানে কোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের চিত্রটি বোঝা যায় না। কেননা, উচ্চ মাথাপিছু আয় থাকার পরও কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে অনেক দেশ সামাজিক সূচকে পিছিয়ে থাকে।
তাই জাতিসংঘ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকের ভিত্তিতে বিশ্বের দেশগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছে: স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশ। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসোক) উন্নয়ন নীতিমালাবিষয়ক কমিটি বা কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) তিনটি সূচকের ভিত্তিতে তিন বছর পর পর এলডিসির তালিকা তৈরি করে থাকে। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসার সূচকগুলো হচ্ছে: (ক) মাথাপিছু আয়: তিন বছরের গড় মাথাপিছু জাতীয় আয় (জিএনআই); (খ) মানবসম্পদ সূচক, যেটি পুষ্টি, স্বাস্থ্য, স্কুলে ভর্তি ও শিক্ষার হারের সমন্বয়ে তৈরি হয়; (গ) অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক, যেটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক আঘাত, জনসংখ্যার পরিমাণ এবং বিশ্ববাজার থেকে একটি দেশের দূরত্বের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। একটি দেশ যেকোনো দুটি সূচক অর্জন করতে পারলে, সেটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ ঘটানোর যোগ্যতা অর্জন করে। তবে ইচ্ছে করলে কোনো দেশ শুধু আয়ের ভিত্তিতেও এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসার আবেদন করতে পারে। সে ক্ষেত্রে তার মাথাপিছু আয় মূল্যায়নের বছরে নির্ধারিত প্রয়োজনীয় আয়ের দ্বিগুণ হতে হবে। যেমন ইকুয়েটরিয়াল গিনি ১৪ হাজার ৩২০ ডলার মাথাপিছু আয় নিয়েও স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় রয়েছে। তেমনি সার্কভুক্ত দেশ ভুটান মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৪৬০ ডলার সত্ত্বেও একটি এলডিসি। তাই মধ্যম আয়ের দেশ হলেই স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ ঘটে না।
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ১৯৭৫ সালে। ২০১২ সালে জাতিসংঘ নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী বাংলাদেশ এখনো একটি স্বল্পোন্নত দেশ, যেহেতু বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২০১৩ সালে ৯০০ ডলার, মানবসম্পদ সূচক ৫৪ দশমিক ৭ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক ৩২ দশমিক ৪ ছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে মাথাপিছু জাতীয় আয়ের যে হিসাব করেছে, সেখানে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এক হাজার ৫৪ ডলার হিসাব করা হয়েছে। কিন্তু আঙ্কটাড এলডিসি রিপোর্টে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মাথাপিছু জাতীয় আয় বিশ্বব্যাংক প্রণীত অ্যাটলাস পদ্ধতিতে হিসাব করা হয়ে থাকে। সব দেশের জন্য একই পদ্ধতি ব্যবহার হয় বলে এখানে সামঞ্জস্য রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ড অনুযায়ী বাংলাদেশ এখনো নিম্ন আয়ের দেশ। তবে বাংলাদেশের জাতীয় আয় প্রবৃদ্ধির গতিধারা দেখলে সহজেই অনুমেয় যে বাংলাদেশ আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে।
এলডিসি থেকে উত্তরণসংক্রান্ত জাতিসংঘের পরবর্তী মূল্যায়ন হবে ২০১৫ সালে। তখন আরও দুটি দেশের সম্ভাব্য উত্তরণ-প্রক্রিয়ায় পর্যালোচনা করা হবে। দেশ দুটি হচ্ছে অ্যাঙ্গোলা ও কিরিবাতি, যাদের মাথাপিছু জাতীয় আয় ২০১৩ সালে ছিল যথাক্রমে পাঁচ হাজার ১০ ও দুই হাজার ৬২০ ডলার। বাংলাদেশ ২০১৫ সালের পর্যবেক্ষণে অন্তর্ভুক্ত হতে চাইলে তার মাথাপিছু আয় এক হাজার ২৪২ ডলার হওয়া প্রয়োজন। তার ওপরে মানবসম্পদ বা অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের যেকোনো একটি পূরণ করা প্রয়োজন। আর যদি শুধু মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে আমরা উত্তরণ ঘটাতে চাই, তাহলে মাথাপিছু জাতীয় আয় তিন বছর ধরে গড়ে দুই হাজার ৪৮৪ ডলার হওয়া প্রয়োজন। তাই ২০১৮ সালের আগে এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে বাংলাদেশ সামনের বছরগুলোতে আরও অগ্রগতি সাধন করবে, তাতে সন্দেহ নেই। কেননা, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স, খাদ্যনিরাপত্তা ও এমডিজির সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অর্জন প্রশংসনীয়। তাহলে আশা করা যায়, ২০১৮ সালের মূল্যায়ন-প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হবে। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতিমালাবিষয়ক কমিটি ২০২১ সালে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের জন্য সুপারিশ করবে। তখন জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতিমালাবিষয়ক কমিটি বাংলাদেশকে উত্তরণ বিষয়ে তার বক্তব্য উপস্থাপনের অনুরোধ জানাবে। যদি ধরে নেওয়া হয় যে জাতিসংঘের ইকোসোক, উন্নয়ন নীতিমালাবিষয়ক কমিটির সুপারিশ অনুমোদন করল এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০২১ সালেই তা গ্রহণ করল। তাহলে নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তটি কার্যকর হবে স্বীকৃতি দেওয়ার তিন বছর পর অর্থাৎ ২০২৪ সালে। ২০২১ থেকে ২০২৪— এই তিন বছরকে গ্রেস পিরিয়ড বলা হয়, যাতে দেশটির উত্তরণ-প্রক্রিয়াটি সহজ হয়। এই গ্রেস পিরিয়ডে দেশটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবেই থাকে। এই সময়ে দেশটি উত্তরণের কৌশল তৈরি করবে এবং জাতিসংঘের কমিটি তার উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ করবে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসার আকাঙ্ক্ষা সব দেশেরই। কেননা, এর সঙ্গে দেশের সম্মান, আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি ইত্যাদি জড়িত রয়েছে। বাংলাদেশ একটি অগ্রসরমাণ দেশ। মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার তুলনীয় অনেক দেশের চেয়ে বেশি। আর সামাজিক খাতে বাংলাদেশের সাফল্য তো বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশ একটি স্বল্পোন্নত দেশ! এটি আমাদের জন্য সুখকর নয়। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ ঘটলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়বে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আমরা এক কাতারে দাঁড়াতে পারব। কিন্তু অবকাঠামোগত দুর্বলতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব এবং সুশাসনের ঘাটতির জন্য আমরা দ্রুত অগ্রসর হতে পারছি না। মনে রাখতে হবে, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বেশ কিছু সুবিধা থেকে বঞ্চিত হব। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ইত্যাদি উন্নত দেশে আমরা আমাদের রপ্তানি পণ্য, বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাই। উন্নয়নশীল দেশ হলে আমরা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হব। তখন আমাদের প্রতিযোগী দেশ যেমন চীন ও ভিয়েতনামের মতো শর্তে পণ্য রপ্তানি করতে হবে। এ ছাড়া বাণিজ্যসংক্রান্ত মেধাস্বত্ব আইন বা ট্রিপস এবং বাণিজ্য-সংক্রান্ত বিশেষ সুবিধাগুলো আমরা আর পাব না।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু এই সুবিধা পাওয়ার জন্যই আমরা স্বল্পোন্নত দেশে রয়ে যাব কি না। আর শুল্কমুক্ত সুবিধা সারা জীবন শুধু স্বল্পোন্নত দেশের জন্যও থাকবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা রাউন্ডের চুক্তিগুলো বাস্তবায়িত হলে শুল্ক এমনিতেই সবার জন্য কমে যাবে। তখন আর আমাদের জন্য অগ্রাধিকারমূলক শুল্কসুবিধা থাকবে না। তা ছাড়া, বর্তমানে বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তিগুলোতেও শুল্ক হারে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ার সুবিধা একসময় শেষ হয়ে যাবে। তাই আমাদের লক্ষ্য হবে প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত করে, মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটিয়ে এবং অর্থনৈতিক নাজুকতা কাটিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়া।
ড. ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)