দৈনিক প্রথম আলো
যেকোনো দুটি দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও কার্যকর সম্পর্কের লক্ষণ হলো সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ। বিশেষ করে, যদি তা রাষ্ট্রীয় সফরের মধ্য দিয়ে হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়েছিলেন গত বছর। বলা হয়ে থাকে, সেই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ‘রূপান্তরের’ সূচনা ঘটেছে। সম্পর্কের এই রূপান্তরকে অব্যাহত রাখতে ফিরতি সফরে বাংলাদেশে এসেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। এটা পুরোপুরি একটি দ্বিপক্ষীয় সফর। রাজনৈতিক দিক থেকে দেখলে এই সফর নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের আরও একটি লক্ষণীয় দিক হলো, আমাদের সরকারের লোকজনের বাইরে তিনি দেশের প্রধান বিরোধীদলীয় নেতার পাশাপাশি অন্যান্য দলের নেতা, ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ সমাজের বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। এই প্রত্যক্ষ আলাপ-আলোচনা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে একটা জাতীয় ভিত্তি তৈরি করেছে।
এ ধরনের যেকোনো সফর থেকে কিছু সুনির্দিষ্ট ফলাফল সর্বদাই আশা করা হয়ে থাকে। একদিকে থাকে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের আশা, অন্যদিকে থাকে সহযোগিতার যেসব পথ আছে সেগুলোকে আরও সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা। সেদিক থেকে দেখলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চাওয়াটি ছিল তিস্তা ও ফেনী নদীর পানির ন্যায্য ভাগ পাওয়ার বিষয়টি। শেষ মুহূর্তে বিষয়টি ভেস্তে যাওয়ায় এই সফরের ফলাফলের ওপরও তা কালো ছায়া ফেলেছে। তাই ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা, স্থলসীমান্ত বাস্তবায়নসংক্রান্ত প্রটোকলে সই, দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতায় বাংলাদেশি নাগরিকদের ২৪ ঘণ্টা যাতায়াতসুবিধা প্রদান বা শিক্ষা, পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার লক্ষ্যে বিভিন্ন সমঝোতা স্মারক সইয়ের বিষয়গুলো পেছনে চলে গেছে। শেষ মুহূর্তে বিভিন্ন কারণে ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া নিয়ে সম্মতিপত্র সই না হওয়ায় একধরনের নাটকীয়তার সৃষ্টি হয়। এই সফরের এজেন্ডা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে—ফলাফল মিশ্র ও অসমাপ্ত।
এ ধরনের একটি পরিস্থিতি কেন হলো, সেটা খুঁজে দেখা দরকার। বহুপক্ষীয় আলোচনায় অনেক সময়েই বিভিন্ন চুক্তি শেষ পর্যায়ে চূড়ান্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্বের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন পড়ে। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এ ধরনের ‘শেষ মুহূর্তের বিস্ময়’ সাধারণত দেখা যায় না। কিন্তু তিস্তার পানি নিয়ে শেষ মুহূর্তে যা ঘটল, তা আমাদের শুধু বিস্মিতই করেনি, আমরা দেখলাম যে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়েও সমাধানের কোনো পথ বের করা গেল না। যদিও এর প্রধান কারণ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তির বিষয়টিকেই বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এটাও ঠিক, মনমোহনের সফরের সময়সূচি ঠিক করার আগে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন ও পরবর্তী পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে করা হয়েছিল। কেন্দ্রের নেতৃত্ব আশা করেছিলেন, নির্বাচনে মমতার দল জয়ী হলে বিষয়টি সহজ হবে। কিন্তু এখন আমরা দেখলাম যে ফলাফল উল্টো। ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা এবং দিল্লিতে সোনিয়া গান্ধীর অনুপস্থিতির কারণে মমতার এই আপত্তির বিষয়টি সামাল দেওয়া যায় কি না, সেটাও চিন্তাভাবনার বিষয়।
কিন্তু আমাদের দেশের দিক থেকে তা দেখলে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তথা ভারতের এই রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মনোভাব কি আমাদের বিবেচনায় ছিল? আমরা কি সে অনুযায়ী কোনো উদ্যোগ নিয়েছিলাম? ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এই বাংলাদেশ সফরের যে প্রস্তুতিটি বাংলাদেশের তরফ থেকে নেওয়া হয়েছিল, তা নিতান্তই আমলানির্ভর। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়ে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিবর্গ বা প্রতিষ্ঠানকে এর সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত করা হয়নি বা তাদের কাছ থেকে কোনো পরামর্শ নেওয়া হয়নি। এমনকি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের এই রূপান্তরের নীতিগত বিষয় সংসদে বা সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করা হয়নি। আশ্চর্যের বিষয়, মনমোহনের বাংলাদেশ সফরের আগের দিন অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিভিন্ন চুক্তির বিষয় নিয়ে আলোচনার কথা বলা হলেও তা হয়নি। মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের প্রস্তুতির সঙ্গে জড়িত কর্তাব্যক্তিদের অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আমি আরও অবাক হয়েছি, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের আগের দিন আমরা সবাই যখন জেনে গেছি যে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হচ্ছে না, তখনো আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলে গেছেন, চুক্তি হবে এবং এ ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। বিষয়টি একদিকে যেমন বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে, তেমনি উত্কণ্ঠাও বাড়িয়েছে।
আর আমাদের বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের কেউ কেউ তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি প্রশ্নে মমতা ব্যানার্জির অবস্থান এবং বাংলাদেশে না আসার সিদ্ধান্তকে তাঁর রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে সাধুবাদ জানিয়েছেন। এই বিষয়টিতে তাঁরাও সমভাবে ব্যথিত হবেন—এটাই ছিল প্রত্যাশিত। কারণ, এই চুক্তি না হওয়াটা দেশ ও জনগণের ক্ষতি। বর্তমান সরকারের অসফলতায় খুশি হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। কারণ, সরকারের অসফলতা মানে চূড়ান্ত বিচারে আমাদেরই ক্ষতি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের এই সফর ও এর ফলাফল থেকে আমাদের ভুলভ্রান্তিগুলো খুঁজে বের করা এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ। তবে ভুলগুলো খুঁজে বের করে সেখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার বিষয়টিই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বাংলাদেশে যেভাবে সরকার পরিচালিত হচ্ছে, সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা খুবই দরকারি হয়ে পড়েছে। আমরা দেখতে পেলাম, নবীন রাজনীতিবিদদের দিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করে তাঁদের অনভিজ্ঞতাকে প্রবীণ আমলাদের দিয়ে পূরণ করার পরীক্ষা ফলাফলের মাপকাঠিতে পাস করতে পারল না। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে, রাজনৈতিক শক্তির বাইরেও মেধা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যে লোকজন ও সামাজিক শক্তি আমাদের রয়েছে, তাদের উপেক্ষা করে ভালো ফল পাওয়া কঠিন। এর ফলে একটি রাষ্ট্র যত শক্তি নিয়ে জাতীয়ভাবে শক্তিধর প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে পারে, সেখানে কিছুটা ঘাটতি থেকে যায়। এই সমস্যাটি আমাদের নিজস্ব; ভারতের পরিপক্ব ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রে এ ধরনের সমস্যা নেই।
পরিহাসমূলকভাবে হলেও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এই বাংলাদেশ সফরের নেতিবাচক ফলকেই আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাই। নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে ট্রানজিট-সংক্রান্ত নতুন কোনো সমঝোতা বা চুক্তি না হওয়ার বিষয়টিকে আমি একধরনের সৌভাগ্য বলেই মনে করি। এর ফলে এখন আমরা যে সময়টুকু পেলাম, তা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। তবে সময় অত্যন্ত কম। দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ইশতেহারে যত দ্রুত সম্ভব এ ব্যাপারে সমঝোতার কথা বলা হয়েছে। ট্রানজিট নিয়ে নানা বাগিবতণ্ডায় আমাদের পরিবহন অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য যে বিনিয়োগ প্রয়োজন, সে বিষয়টি অনেকটাই পেছনে চলে গিয়েছিল। এখন সেটা সামনে নিয়ে আসতে হবে। বিনিয়োগ অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য অর্থের জোগান ও বাস্তবায়নের বিষয়টি এখন সবচেয়ে প্রাধান্য পাওয়া উচিত। ট্রানজিটের ব্যাপারে ভারতের কাছ থেকে পাওয়া প্রস্তাবগুলো দেখলে মনে হয়, আমাদের অনেক অব্যবহূত অবকাঠামো রয়ে গেছে। ফলে চলতি ভাড়া দিয়ে ভারত মাল আনা-নেওয়া করবে। কিন্তু আমাদের কথা হচ্ছে, ট্রানজিটের জন্য ভৌত অবকাঠামো গড়ে তোলার কিছু দায়দায়িত্ব ভারতকে নিতে হবে। ট্রানজিট ফির মাধ্যমেও তা উসুল করতে হবে। আর ট্রানজিট ফি এবং এর অনুমিত অঙ্কগুলো বিভিন্ন বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে।
দ্বিপক্ষীয় তথা উপ-আঞ্চলিক ট্রানজিট-সুবিধা ব্যবস্থাপনা এবং একটি সুষ্ঠু ও আইনি কাঠামো গড়ে তোলার জন্য সরকারকে সচেষ্ট হতে হবে। আমাদের সরকারকে এটা মনে রাখতে হবে যে বহু দশকের পুরোনো বাণিজ্য চুক্তি বা সে ধরনের কোনো প্রটোকলের ওপর ভিত্তি করে একটি আধুনিক ট্রানজিট চুক্তি হতে পারে না। আমরা আশা করব, সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিলের অপব্যাখ্যা দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের যে উষ্ণতা বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে বিরাজমান, মনমোহনের বাংলাদেশ সফরের ফলাফল তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এখন আমাদের এই সফরের সামগ্রিক প্রস্তুতি ও ফলাফল নিয়ে নিজস্ব সমালোচনা ও পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন। উন্নত দেশে এ ধরনের ক্ষেত্রে কোনো জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীর নেতৃত্বে কমিটি করে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হতো। আমাদের দেশে সে ধরনের কিছু আশা করা কঠিন। এই সফর নিয়ে পরিতাপ করার চেয়ে অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়াই এখন সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত।