Originally posted in বণিকবার্তা on 5 July 2023
পহেলা জুলাইয়ে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরের প্রথম অর্ধের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মুদ্রানীতি বিবৃতিতে সমষ্টিগত চাহিদাকে হ্রাসপূর্বক ঋণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখার কথা বলা হয়েছে।
নতুন মুদ্রানীতিতে চারটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হলো: ক) নীতি সুদহার করিডোর প্রতিষ্ঠা; খ) ঋণ বিতরণে রেফারেন্স সুদের হার প্রবর্তন; গ) বিনিময় হারের একীকরণ; এবং ঘ) আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল প্রণীত পেমেন্ট ব্যালান্স ও ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়ালে (Balance of Payment and International Investment Position Manual) বর্ণিত নির্দেশনাগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সর্বমোট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ গণনা করার পদ্ধতি সংশোধন।
সুদহারের মতো মুদ্রানীতির গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তন নিঃসন্দেহ প্রশংসনীয়। দীর্ঘদিন ধরে সুদহারের মতো বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে অনিচ্ছুক ছিল এ যুক্তিতে যে এসব আর্থিক হার নির্ধারণ বেসরকারি খাতে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিরুৎসাহিত করবে এবং তা প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
কিন্তু বিবেচ্য যে কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান থাকলে ও সুশাসনের অভাব হলে সুদের নিম্ন হার অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা সৃষ্টির জন্য তেমন সহায়ক হয় না। নতুন মুদ্রানীতিতে সব শ্রেণীর ব্যাংকঋণ বিতরণে রেফারেন্স সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ২০২০ সালের এপ্রিলে প্রবর্তিত ঋণের হারের সীমা আর থাকছে না। ঋণের হারের সীমা না থাকলে ব্যাংক খাতে প্রতিযোগিতা বাড়বে। ফলে ঋণপ্রবাহের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে। ব্যক্তি উদ্যোক্তা লাভবান হবে এবং ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার হবে।
নতুন মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রাগত লক্ষ্যমাত্রার (monitory target) চেয়ে সুদের হারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। যার ফলে আন্তঃব্যাংক কল মানি হারের সঙ্গে নীতি হারের (policy rate) সামঞ্জস্য তৈরি হবে, যা বাজারে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।
আন্তঃব্যাংক কল মানি মার্কেট একটি স্বল্পমেয়াদি আর্থিক বাজার হিসেবে কাজ করে যেখানে ব্যাংক, মিউচুয়াল ফান্ড ও করপোরেশনের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তঃব্যাংক হারে (যে হারে ব্যাংকগুলো একে অন্যের থেকে তহবিল ধার করে) ঋণ আদান-প্রদান করতে পারবে।
যথাযথ মুদ্রানৈতিক পন্থা অবলম্বনের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি হার বাড়ানোর সিদ্ধান্তও নিয়েছে। এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ভোক্তা মূল্য সূচক মূল্যস্ফীতির প্রভাব রোধের লক্ষ্যে ঋণ গ্রহণে ব্যয় বৃদ্ধি।
এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব ওয়েবসাইটে মাসিক ভিত্তিতে ঋণের রেফারেন্স সুদহার ঘোষণা করবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তরফ থেকে সুদহার নির্ধারণের এ করিডোর পদ্ধতিকে ‘স্মার্ট’ (শর্ট টার্ম মুভিং অ্যাভারেজ) নামকরণ করা হয়েছে। ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের চলমান গড় হারের ভিত্তিতে এ হার নির্ধারণ করা হয়। ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ ঋণের রেফারেন্স সুদহারের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদ যোগ করতে পারবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত রেফারেন্স হার থেকে ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরীণ সুদ হার বৃদ্ধির সীমা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ আর নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ।
কুটির, ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে এবং ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে ঋণ প্রদান কার্যক্রম তত্ত্বাবধানের খরচ মেটাতে ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ১ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত ফি ধার্য করার এখতিয়ার দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ক্রেডিট কার্ড ঋণের সুদহার অপরিবর্তিত থাকবে।
ব্যাংকগুলো অনেক দিন ধরে মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম সুদে ঋণ বিতরণ করছিল। মে মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে পৌঁছেছিল। মূল্যস্ফীতিকে হিসাবে নিলে প্রকৃত সুদের হার আসলে ঋণাত্মক ছিল। এখন সুদ হারের সীমা তুলে নেয়ার কারণে ঋণের হারে খুব বেশি পার্থক্য থাকবে না। বর্তমানে ছয় মাসের ট্রেজারি বিলের হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ১ শতাংশ। সদ্য বাস্তবায়িত নীতি অনুসারে, ব্যাংকগুলোর জন্য সর্বোচ্চ ঋণের হার হবে ১০ দশমিক ১ শতাংশ, যেখানে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বোচ্চ ঋণের হার হবে ১২ দশমিক ১ শতাংশ। তবে মূল্যস্ফীতির হার এখনো অনেক বেশি।
মুদ্রানীতিতে নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। যদিও এ লক্ষ্য অর্জন চ্যালেঞ্জিং হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ১১ শতাংশ অনুমিত হয়েছে, যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় কম। কিন্তু নতুন অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে বেসরকারি খাতে ১৫ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো হার ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ করেছে এবং রিভার্স রেপো রেট ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ করেছে।
পলিসি রেট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, কারণ এটি সুদের হার নির্ধারণের জন্য একটি কার্যকর কৌশল। তবে ঋণের হার এখনো মূল্যস্ফীতির হারের কাছাকাছি রয়ে গেছে। বিবেচ্য যে মূল্যস্ফীতির চাপ কখন ও কীভাবে হ্রাস পাবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব নীতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক নয় এবং সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনায় মুনাফালিপ্সু সিন্ডিকেটদের দৌরাত্ম্য থামাতে পারছে না। তাছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক আখ্যায়িত ‘স্মার্ট’ নীতি ব্যাংকগুলোকে বাজারের পরিস্থিতি ও ঝুঁকির সম্ভাবনা বুঝে সুদের হার নির্ধারণ করার স্বাধীনতা পুরোপুরি দেয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেধে দেয়া গণ্ডির মধ্যেই ব্যাংকগুলো আবদ্ধ থাকতে হবে এবং তারা ঋণ বিতরণে বাজার পরিস্থিতির সামঞ্জস্য রেখে স্বাধীনভাবে সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে না। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নতুন অর্থবছরের প্রথমার্ধে মুদ্রানীতির কার্যকারিতা সীমিত থাকবে।
সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির বিপরীতে নতুন বাজেটের রাজস্ব নীতি সম্প্রসারণমূলক। নতুন মুদ্রানীতি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে অধিক মাত্রায় সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ধর্তব্যে নেয়নি। গত অর্থবছরে তারল্য সংকটের মধ্যেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া ঋণের ওপর সরকার অধিক মাত্রায় নির্ভরশীল ছিল। এ সম্ভাবনা নতুন অর্থবছরেও বিদ্যমান। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ আরো বাড়বে। তাই মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন দেশের দরিদ্র, নিম্ন আয়ের এবং নিম্নমধ্যম আয়ের পরিবারের ভোগান্তি কমাতে যথেষ্ট হবে না। রাজস্ব নীতি ও মুদ্রানীতির মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা সত্ত্বেও মুদ্রানীতি কীভাবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরবে তা ভাববার বিষয়।
ড. ফাহমিদা খাতুন: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)