Originally posted in সমকাল on 10 August 2024
আইনশৃঙ্খলা, মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংকে অগ্রাধিকার দিন
নতুন সরকারের করণীয় বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা
ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি ফেরাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অতি দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, আইনশৃঙ্খলার অবনতি মূল্যস্ফীতির ওপরও বাড়তি চাপ তৈরি করছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া নতুন সরকারের জন্য জরুরি কাজ। তাদের মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার পাশাপাশি স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এনে সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ওপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ অর্থনীতির বর্তমান সমস্যাগুলোর গোড়ায় রয়েছে দুর্নীতি-অনিয়ম।
গবেষণা সংস্থা পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, সবচেয়ে আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। তা না হলে অর্থনীতি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ কাজে আসবে না। এ ছাড়া গত কয়েক দিনে বিভিন্ন ব্যাংকে মালিকানা নিয়ে বিক্ষোভ, আন্দোলন, নিয়ন্ত্রণ নেওয়াসহ যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, জরুরি ভিত্তিতে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এই মুহূর্তে ব্যাংক থেকে যাতে কেউ টাকা নিয়ে চলে যেতে না পারে, তা ঠেকাতে হবে।
আহসান মনসুর আরও বলেন, অর্থনীতির বিভিন্ন সংকট উত্তরণে করণীয় নিয়ে তারা বলে আসছেন। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে তাদের পরিকল্পনা সুনির্দিষ্টভাবে জানালে অর্থনীতিবিদরা তার ওপর মতামত দিতে পারবেন। সরকারের উচিত অর্থনীতি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ১০০ দিনের পরিকল্পনা ঘোষণা করা। সরকার মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমাতে চায়, ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানে কমিশন বা টাস্কফোর্স করবে, না কি বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে করাবে, তা জানাতে হবে। অর্থনীতির বাইরে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন, সরকারি সেবা, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কারসহ মৌলিক বিষয়গুলোতে সরকারের অবস্থান ঘোষণা করতে হবে। এ ছাড়া নতুন নির্বাচন দেওয়ার আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কতদিন প্রয়োজন এবং কেন প্রয়োজন– সে বিষয়টি জানানোও জরুরি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ জর্জরিত। নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত সবাই এ চাপে রয়েছে। এমনকি মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যবসায়ীদেরও খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার করার মাধ্যমে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষকে স্বস্তি দেওয়া অর্থনীতির ক্ষেত্রে নতুন সরকারের এক নম্বর ও আশু অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, মধ্য মেয়াদে অর্থনীতিতে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এত বেশি সমস্যা তৈরি হয়েছে, যা বলে শেষ করার মতো নয়। আর এসবের গোড়ায় রয়েছে সুশাসনের অভাব এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। এগুলো গণতন্ত্রের পাশাপাশি অর্থনীতিকে একেবারে দুর্বল করে ফেলেছে। বেকারত্ব, কর আহরণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিনিয়োগসহ প্রায় সব সূচকই তলানিতে। সামষ্টিক অর্থনীতি ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। এর বড় কারণ হচ্ছে সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি-অনিয়ম এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা।
ব্যাংক খাতের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। যা এখন ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর পেছনে ছিল ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হওয়া। তারা সরকারের মদদপুষ্ট ছিল। দলীয় লোকজনকে ব্যাংক দেওয়া হয়েছে। ইচ্ছেমাফিক নীতিমালা পরিবর্তন করা হয়েছে। অন্যদিকে অবকাঠামো স্থাপনসহ মেগা প্রকল্পগুলোতে কী পরিমাণ অপচয় আর দুর্নীতি হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, অর্থনীতিতে সুশাসন ও জবাবদিহির ব্যাপক অভাব ছিল। অতীতের সরকারগুলো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করেনি। নতুন সরকারকে এগুলোতে হাত দিতে হবে। তাহলে অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যাবে। কাজেই সব মিলিয়ে মানুষকে মূল্যস্ফীতি থেকে স্বস্তি দেওয়া, অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারই নতুন সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনাই নতুন সরকারের প্রথম কাজ হওয়া উচিত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। সমকালকে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। এমন অবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক করা সম্ভব নয়। তাই নতুন সরকারের প্রথম দায়িত্ব হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা। দখল ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম বন্ধ করা উচিত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করার ওপরই নির্ভর করছে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার।
তিনি বলেন, গত কয়েক সপ্তাহের চরম অস্থিরতার কারণে সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত ঘটেছে। পণ্য সরবরাহ এখনও স্বাভাবিক হয়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমন থাকলে মূল্যস্ফীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ আবার সুযোগ নিতে চাইবে। তাই এমন অনিশ্চয়তার পরিস্থিতি যত দ্রুত সম্ভব কাটিয়ে উঠতে হবে। এ বিষয়ে সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
সেলিম রায়হান বলেন, রাজস্ব আহরণ, রপ্তানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কম থাকাসহ অর্থনীতির অন্য যে গভীর সমস্যাগুলো রয়েছে, সেগুলোর সমাধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মতো অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। এগুলোতে যথাযথ অভিভাবক দিতে হবে শিগগিরই।