দৈনিক প্রথম আলো
বিদায় জানালাম মোজাফ্ফর আহমদকে; যাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ও সখ্য ৫৫ বছরের। আমাদের এ বয়সে এমন বিদায় জানানোর ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে।
মোজাফ্ফর প্রায় এক দশক ধরে অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু তিনি এমন এক পরিপূর্ণ ও প্রতিশ্রুতিময় জীবনযাপন করে গেছেন, যা তাঁর চেয়ে অনেক কম বয়সী এবং অনেক ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী ব্যক্তিরাও সহজে পারেন না। তাঁর জীবনের শেষ ১০টি বছর ছিল দৈহিক ক্ষয়ের ওপর আত্মিক শক্তির বিজয়। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে সংবাদমাধ্যম তাঁর অভিমত জানতে চেয়েছে। এ ধরনের প্রচারণা তিনি চাননি; কিন্তু তাঁর সততা, নিরপেক্ষতা, স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি ও প্রজ্ঞা তাঁকে এমন এক ব্যক্তিত্বের মর্যাদায় উন্নীত করেছে যে জনগুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয়ে তাঁর মতামত জানতে চাওয়া হতো।
জীবনের শেষ দিনগুলোতে স্বাস্থ্যের ক্রমেই অবনতি সত্ত্বেও তিনি নাগরিক সমাজের তিন প্রতিষ্ঠানের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চেয়ারপারসন ছিলেন। এসব দায়িত্ব পালনের অর্থ শুধু বোর্ড সভা ও সেমিনারগুলোতে সভাপতিত্ব করা নয়; তিনি নদীদখল ও নদীদূষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অংশ হয়ে নদীর কাছেও গিয়েছেন, নানা ধরনের অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে মৌন মিছিলে অংশ নিয়েছেন রাজপথে।
আমাদের এই অদ্ভুত দেশে, যেখানে ভালো মানুষই আক্রমণের শিকার হন, এমন লোকের অভাব নেই যাঁরা হয়তো ভাবতেন, বুড়ো বয়সে এই বাঙালি ডন কুইক্সোট কেন অসম্ভবের পিছে ছুটছে? কিন্তু তাঁরা বোঝেন না যে মোজাফ্ফর আহমদের মতো মানুষ এমন স্থূল বৈষয়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলেন না, যেখানে প্রতিটি কাজ করতে হবে লাভ-লোকসান হিসাব করে। মোজাফ্ফর আহমদ অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানাতেন। কারণ, তিনি মনে করতেন, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো তাঁর নৈতিক দায়িত্ব। তাঁর প্রতিবাদে সমাজ ও রাষ্ট্রের সব অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটবে, এই প্রত্যাশা থেকে নয়, প্রতিবাদ করাকে নৈতিক দায়িত্ব ভেবেই তিনি প্রতিবাদ করতেন। এই দায়িত্ববোধের কারণেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সক্রিয় ছিলেন। ১০ বছর আগে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসকেরা তাঁর অসুস্থতার আরোগ্যহীন পর্যায় লক্ষ করে ভেবেছিলেন, তিনি বাঁচবেন হয়তো আর বছর তিনেক। কিন্তু চিকিৎসকদের ঘোষিত সেই আয়ু অতিক্রম করে নিজের জীবনকে তিনি আরও প্রসারিত করতে পেরেছিলেন সম্ভবত এই কারণে যে, তিনি নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিত কর্মযজ্ঞে।
মোজাফ্ফর আহমদের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৫৭ সালে; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। তখন আমার সহকর্মীদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক আনিসুর রহমান, ড. মকসুদ আলী, ড. মাহফুজুল হক ও ড. মহিউদ্দীন আহমেদ। আমার মনে পড়ে, মোজাফ্ফর ছিলেন শান্তশিষ্ট, গম্ভীর, স্বল্পভাষী; কিন্তু নিজের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতেন বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে। তিনি স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনার জন্য গিয়েছিলেন প্যারিসের সবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে যান পিএইচডি করতে। সে সময় শিকাগো ঘরানার অর্থশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মিলটন ফ্রিডম্যানের প্রভাব ছিল। কিন্তু মোজাফ্ফর আহমদের অর্থনীতিবিষয়ক চিন্তায় পরবর্তীকালে এমন সব পরিবর্তন ঘটে, যা তাঁকে নিয়ে যায় শিকাগো ঘরানার সঙ্গে সম্পৃক্ত মুক্তবাজার অর্থনীতির বন্দনা থেকে অনেক দূরে।
১৯৬৫ সালে মোজাফ্ফর যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন, তত দিনে তিনি একজন পরিপক্ব অর্থনীতিবিদ, নিজের চিন্তাভাবনা সম্পর্কে আরও প্রত্যয়ী এবং কথা বলেন বেশ গুছিয়ে। ঢাকায় ফিরেই তিনি যোগ দেন অর্থনীতি বিভাগে চলমান সে সময়ের উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্কের সম্মুখভাগে। অচিরেই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন অর্থনীতির একজন প্রেরণাদায়ী শিক্ষক হিসেবে, কিন্তু তাঁর মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অচিরেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন গভর্নর মোনেম খানের বশংবদ। সরকারবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অর্থনীতি বিভাগে ইতিমধ্যে আবু মাহমুদ, আনিসুর রহমান ও আমার পরিচয় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, এ সময় মোজাফ্ফর এসে যোগ দিলেন আমাদের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের দ্বন্দ্ব এ পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে এনএসএফের গুন্ডারা শারীরিকভাবে আক্রমণ করেছিল অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান আবু মাহমুদকে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ তুলে আদালতে মামলা করেছিলেন, বিচারপতি মুরশিদ তাঁর পক্ষে রায় দিলে এনএসএফের মাস্তানরা ড. আবু মাহমুদকে আক্রমণ করে। আর গভর্নর মোনেম খানের সরকারের স্বরূপ ছিল এমন, ড. আবু মাহমুদ গুরুতর আহত হলেও তাঁর ওপর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তাদের অবাধে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যেন তারা ক্যাম্পাসে ত্রাস সৃষ্টি করতে পারে।
ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভাজন ছিল প্রকট। বঙ্গবন্ধুসহ অধিকাংশ বিরোধীদলীয় নেতা কারাগারে, স্বৈরাচারী আইয়ুব শাহী ও তাঁর এদেশীয় সাঙ্গাতদের দাপট সর্বত্র। এ এমন একটা সময়, যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিরিয়াস পড়াশোনা ও গবেষণা করার পরিবেশ যেমন ছিল না, তেমনি ছিল না স্বাধীনভাবে মুক্তচিন্তা করার সুযোগ। ড. আবু মাহমুদ শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, যেমন বাধ্য হয়েছিলেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। আমি শিক্ষাছুটি নিয়ে বিদেশে চলে যাই, আনিসুর রহমানও তা-ই করেন। এনএসএফের মাস্তানদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যায় ক্যাম্পাস, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হয়ে পড়ে স্বৈরাচারী সরকারের বশংবদ। এমন পরিবেশে মোজাফ্ফর আহমদ বিচ্ছিন্ন বোধ করতে থাকেন। তিনি ও ইংরেজি বিভাগের খান সারওয়ার মুরশিদ সিদ্ধান্ত নেন এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার। তাঁরা চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। অধ্যাপক আখলাকুর রহমান মোজাফ্ফরকে আমন্ত্রণ জানান ইউনাইটেড ব্যাংকের সিনিয়র ইকোনমিক অ্যাডভাইজর হিসেবে ব্যাংকটির সদর দপ্তর করাচিতে যোগ দিতে। মোজাফ্ফর ইউনাইটেড ব্যাংকে যোগ দিয়ে করাচিতে যান, কিন্তু তাঁর বিশ্ববীক্ষায় বেসরকারি খাতের কাজকে আপন করে নেওয়া সম্ভব হয়নি; তাই পূর্ব পাকিস্তান শিল্প করপোরেশনের পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক পদে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ইউনাইটেড ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দেন এবং ১৯৬৮ সালের দিকে শিল্প করপোরেশনে যোগ দিতে করাচি থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন। শিল্প করপোরেশনে মোজাফ্ফরের সুযোগ হয় একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় খাত গড়ে তোলার, অর্থনৈতিক দর্শন বাস্তবায়নে নিজের সমস্ত পেশাগত দক্ষতা কাজে লাগানোর। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিতে অবাঙালি শিল্প-বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রবল আধিপত্য ছিল। মোজাফ্ফরের কার্য মেয়াদে পূর্ব পাকিস্তান শিল্প করপোরেশন সেই অবাঙালি আধিপত্যের সামনে বাঙালিদের একটা চ্যালেঞ্জ গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি সম্মুখসারির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভুত হয়। এই ভূমিকায় কাজ করতে গিয়ে মোজাফ্ফর সরকারি শিল্প উদ্যোগগুলোর ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশে শিল্পায়ন-সংক্রান্ত পরিকল্পনা প্রণয়নে তিনি বড় ভূমিকা পালন করেন।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যখন নূরুল ইসলাম, আনিসুর রহমান, মোশারফ হোসেন ও আমার ওপর প্রথম পরিকল্পনা কমিশন গঠনের দায়িত্ব অর্পণ করেন, তখন মোজাফ্ফর আহমদকে সঙ্গে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের এক মিনিটও সময় লাগেনি। আমরা তাঁকে পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প বিভাগের প্রধান পদে নিই। পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে শিল্প ছিল আমার দায়িত্বে; শিল্প বিভাগটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মোজাফ্ফর আমার সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন, শিল্প করপোরেশন থেকে সবচেয়ে মেধাবী ও দক্ষ কর্মীদের নিয়ে আসেন পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প বিভাগে। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিল্প খাত গড়ে তোলা ও শিল্পনীতি পরিকল্পনার কাজে মোজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বে পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প বিভাগ বিরাট ভূমিকা পালন করে।
১৯৭৪ সালের শেষ নাগাদ পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম সদস্যরা নিজ নিজ একাডেমিক কর্মক্ষেত্রে ফিরে যান। মোজাফ্ফর আহমদও সিদ্ধান্ত নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার; ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (আইবিএ) অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। আমি ইতিমধ্যে বিআইডিএসের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিয়েছি। আমরা দুজন রাষ্ট্রীয় শিল্পোদ্যোগের রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে বিশদ একটি গবেষণায় একসঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই। সেই গবেষণার ফল আমাদের যৌথ গ্রন্থ পাবলিক এন্টারপ্রাইজ ইন অ্যান ইন্টারমিডিয়েট রেজিম: এ স্টাডি ইন দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব বাংলাদেশ। ৬০০ পৃষ্ঠার বিশাল গ্রন্থটি আমরা দুজনে লিখি মাত্র দুই মাসে, ১৯৭৬ সালের শেষ প্রান্তিকে, নরওয়ের বার্গেন শহরের ক্রিশ্চিয়ান মিকেলসেন ইনস্টিটিউটের প্রশান্ত পরিবেশে, নিমন্ত্রিত ভিজিটিং ফেলো হিসেবে। এই গবেষণাকর্ম পরে বিআইডিএস থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এত স্বল্প সময়ের মধ্যে এমন বিশাল মাপের একটা কাজ করা সম্ভব হয়েছিল এ জন্য যে, আগের দুই বছর বিআইডিএস ও আইবিএতে মোজাফ্ফরের নেতৃত্বে পটভূমি গবেষণার সিংহ ভাগ সম্পন্ন হয়েছিল। বার্গেনে আমরা পূর্ণ পারস্পরিক সহযোগিতায় প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করতাম। সেখানে অবস্থানের একটা মাস ছিল রমজান, মোজাফ্ফর আহমদ একটি রোজাও বাদ দেননি।
এই দুই মাসে মোজাফ্ফরের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে; একনিষ্ঠ পেশাজীবী ও পণ্ডিত মোজাফ্ফর থেকে বেশি ঘনিষ্ঠভাবে জানা ও বোঝার সুযোগ হয় তাঁর ভেতরের মানুষটিকে। তিনি ছিলেন গভীরভাবে ধর্মপ্রাণ, কিন্তু ধর্মপালনে তাঁর কোনো আড়ম্বর ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্মপালন মানে শুধু রীতি-আচার পালন নয়, বরং ধার্মিকতার সারমর্ম নিহিত আছে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের সামগ্রিকতায়। তাঁর বয়স ৪০ হওয়ার আগেই তিনি বাবাকে হারান, তখন পুরো পরিবারের দায়িত্ব তুলে নেন নিজের কাঁধে। যৌথ পরিবারটির গুরুদায়িত্ব পালনে তাঁকে সহযোগিতা করেন তাঁর স্ত্রী রওশন জাহান, যিনি ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের এক অসাধারণ ছাত্রী, উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করেছিলেন শিকাগো ইউনিভার্সিটি থেকে। শুধু নিজের সন্তানদের লালনপালনের জন্য নয়, একই বাড়িতে মোজাফ্ফর আহমদের বিরাট একান্নবর্তী পরিবারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রওশন জাহান অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একাডেমিক ক্যারিয়ার বিসর্জন দেন।
১৯৭৭ সালে মোজাফ্ফর আহমদ জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকারে যোগ দিতে সম্মত হন, একজন উপদেষ্টা হিসেবে। আমি তাঁকে এক চিঠিতে লিখেছিলাম, জিয়ার সরকারে যাঁরা যোগ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র তাঁর যোগ দেওয়ার ঘটনাটিই আমাকে বিস্মিত করেছে। জিয়ার সরকারে মোজাফ্ফরকে দেওয়া হয়েছিল পাট ও বস্ত্রশিল্পের দায়িত্ব; তিনি বিশ্বাস করতেন, ওই দুটি খাতে তিনি ভালো কিছু কাজ করতে পারবেন। আমি জানি না, তিনি এই খাত দুটির কোনো উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছিলেন কি না, কিন্তু যাঁরা তাঁর কাজের কথা জানেন, তাঁরা স্বীকার করেন যে এই ক্ষেত্রে তিনি পরিপূর্ণ আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছিলেন। জিয়াউর রহমান যখন সেনাশাসক থেকে রাজনৈতিক নেতায় রূপান্তরিত হয়ে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, মোজাফ্ফর তখন তাঁর সরকার থেকে বেরিয়ে আসেন। মন্ত্রিসভায় তাঁর পেশাগত সহকর্মীদের কয়েকজন থেকে যান এবং বিএনপিতে যোগ দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার মানসিকতা মোজাফ্ফরের ছিল না, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে ফিরে যান।
যৌথভাবে গবেষণাকর্মটি সম্পাদনের পর মোজাফ্ফর আহমদের সঙ্গে আর প্রত্যক্ষভাবে কাজ করা হয়নি; তবে আমি অক্সফোর্ডে চার বছর কাটানোর পর দেশে ফিরে এলে তাঁর সঙ্গে পেশাগত ও ব্যক্তিগত যোগাযোগ আবার ঘনিষ্ঠ হয়। আমি আবারও বিআইডিএসে যোগ দিই, আর মোজাফ্ফর আইবিএর ডিরেক্টর হিসেবে ওই ইনস্টিটিউটকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অসাধারণ ফ্যাকাল্টিতে পরিণত করেন।
আমি বিআইডিএসে, ও পরে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগে (সিপিডি) তাঁকে নিয়মিতভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন দিক নিয়ে সন্দর্ভে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানাতাম। ১৯৮৩ সালে আমি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হই; আমার পরে মোজাফ্ফর সভাপতি নির্বাচিত হন ১৯৮৫ সালে। আমাদের সময়ে অর্থনীতি সমিতি ছিল কর্মচাঞ্চল্যে মুখর; বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্থনীতি অনুষদ, বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থাগুলোতে কর্মরত অর্থনীতিবিদদের আমরা সমবেত করতে পেরেছিলাম; একটি পেশাজীবী গোষ্ঠী হিসেবে অর্থনীতিবিদদের দৃশ্যমানতা তখন বেড়েছিল। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সেই দিনগুলোতে আমরা সরকারের বিভিন্ন নীতি ও অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যেসব অভিমত ব্যক্ত করতাম, তা হতো সমালোচনামূলক; ফলে সরকারের মধ্যে আমাদের সমাদর বাড়ত না।
আইবিএর ডিরেক্টর হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর মোজাফ্ফর আহমদ তাঁর জীবনের শেষ দুই দশক সামাজিক আন্দোলনে একজন অত্যন্ত সক্রিয় নাগরিক হিসেবে অংশ নেন। রাজনীতি ও সমাজ সম্পর্কে তাঁর অভিমতগুলো ছিল সব সময়ই স্পষ্ট ও প্রবল, নৈতিকতার ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো। কারণ, জীবনের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাসের মূলে ছিল নৈতিকতা। তাঁর এসব মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটত তাঁর লেখালেখির মধ্য দিয়ে, বিভিন্ন সভা-সেমিনারে উপস্থাপিত বক্তৃতায়, সংবাদমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্য-বিবৃতিতে। জীবনের এই চূড়ান্ত পর্বে তিনি একই সঙ্গে অনেক দায়বদ্ধতা অনুভব করেন; বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাগুলো সম্পর্কে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমতগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরার দায় প্রবলভাবে অনুভব করেন।
শেষ জীবনে মোজাফ্ফর আহমদ বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন; সংগঠনটির সভাপতি হিসেবে তিনি পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বিশেষভাবে সোচ্চার হয়েছিলেন ভূমিদস্যুদের নদীদখলের বিরুদ্ধে। টিআইবির চেয়ারপারসন হিসেবেও তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন একই রকম সক্রিয়। এবং সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নামের সংস্থাটির চেয়ারপারসন হিসেবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সুশাসনের পক্ষে, অর্থ ও পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত নির্বাচনব্যবস্থার পক্ষে এক সাহসী ও দলনিরপেক্ষ কণ্ঠস্বর।
এই সব বিপুল কর্মযজ্ঞের মাশুল দিতে হচ্ছিল তাঁর স্বাস্থ্যকে। অনেকেই জানেন না, বছর দশেক আগে মোজাফ্ফর আহমদের এক জটিল অসুখ ধরা পড়ে; রক্তের এক বিরল ধরনের অস্বাভাবিকতা, যা রোগীকে অত্যন্ত দুর্বল করে ফেলে এবং শেষে রোগীর মৃত্যু ঘটায়। এই অসুখের কারণে মোজাফ্ফর শেষের দিকে এত দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে নাগরিক সমাবেশে বক্তৃতা করা বা রোদতপ্ত রাজপথে মানববন্ধনে দাঁড়ানো তাঁর পক্ষে ক্রমেই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও এসব কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া তিনি বন্ধ করেননি গভীর দায়িত্ববোধের কারণে।
মোজাফ্ফর আহমদ খ্যাতি বা ঐশ্বর্যের পেছনে ছোটেননি। তিনি ছিলেন লাজুক স্বভাবের অমায়িক মানুষ। তাঁর অনেক সহকর্মী বিদেশে চলে গেছেন; কিন্তু তিনি নিশ্চিন্ত-নিরাপদ প্রবাসজীবনের আরাম-আয়েশের লোভ ত্যাগ করে রয়ে গেছেন বাংলাদেশে। জীবনযাপনে পরিমিতির অনুশীলন তাঁকে রক্ষা করেছে অনৈতিকতার দূষণ থেকে; এবং এটাই তাঁকে শক্তি-সাহস জুগিয়েছে ক্ষমতাবানদের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একটুখানি অবসর, বা আনন্দ-অবকাশের কথা না ভেবে, পরিবারের জন্যও আরেকটু বেশি সময় না দিয়ে এই সব কর্মযজ্ঞে মেতে থেকে মোজাফ্ফর আমাদের কী দেখাতে পেরেছেন? আমার মনে হয়, জীবনের শেষ যাত্রায় তাঁর পাথেয় হয়েছিল এই চেতনা যে, তিনি তাঁর দেশের মানুষকে দেখাতে চেয়েছেন, অল্প কিছু মানুষের জন্য নয়, দেশের সব মানুষের জীবন আরও সুন্দর করার সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। কাজের মধ্য দিয়ে তিনি অর্জন করেছেন অনেক মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। মোজাফ্ফর আহমদ তাঁর জীবনেই দেখিয়ে গেছেন, জীবনের অধিকাংশ সময় যাঁর কোনো ক্ষমতা বা প্রভাব ছিল না, পৃষ্ঠপোষকতা দান করা ও আনুগত্য কেনার সামর্থ্য ছিল না, তেমন একজন মানুষ সবার শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছেন।
অমায়িক সজ্জন, সবার শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি, আমার আজীবন বন্ধু মোজাফ্ফর আহমদের প্রয়াণে তাঁর পরিবারের সদস্যদের মতো আমিও গভীরভাবে শোকাহত। কিন্তু তাঁর বিপুল কর্মময় জীবনের কথা ভেবে আমি আনন্দ পাই, আবার আমার দেশের জন্য দুঃখ বোধ করি এ জন্য যে, মোজাফ্ফর আহমদের মতো মানুষ এদেশে ক্রমেই বিরল হয়ে উঠছেন।
(ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম)