মৎস্য খাতে কর অপব্যবহারের মূল কারণ ফরমালাইজেশনের অভাব – ড. মোয়াজ্জেম

Originally posted in কালেরকন্ঠ on 23 April 2025

দুর্নীতি রোধে করহার বাড়ছে মৎস্য খাতে

দুর্নীতি রোধে ব্যবস্থা নিতে মৎস্য খাতে করহার বাড়ছে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এই পরিবর্তন আসতে পারে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র মতে, মৎস্য খাতের সর্বোচ্চ করহার ১৫ শতাংশ।

অন্যদিকে একজন স্বাভাবিক ব্যক্তি শ্রেণির করদাতার ক্ষেত্রে এই হার ২৫ শতাংশ। করহারে বড় পার্থক্য থাকায় কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে সমাজের অনেক রাঘব বোয়ালই নিজেকে মৎস্য খাতের উদ্যোক্তা হিসেবে দাবি করে কর ফাঁকি দিয়ে আসছেন। এবার এই কর ফাঁকি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। কর ফাঁকি ও কালো টাকা সাদা করার সহজ এই কৌশল রুখে দিতে এই খাতে আয় করলে এতে বাড়তি কোনো কর সুবিধা দেওয়া হবে না।

স্বাভাবিক হারেই দিতে হবে আয়কর।

নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসসহ অনেকে মৎস্য খাত থেকে বড় আয় দেখিয়ে কর ফাঁকি দিয়েছেন এবং কালো টাকা সাদা করেছেন। তাঁদের বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান করছে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইসি) এবং আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট। এরপর এই খাতের অপব্যবহার রোধের উদ্যোগ নেয় এনবিআর।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই খাতে করহার কম হওয়ায় যেকোনো আয়কে মৎস্য খাতের আয় দেখিয়ে কর ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। অন্যদিকে প্রকৃত করদাতারাও নিরুৎসাহ হচ্ছেন। তাই এই খাতের সুবিধা তুলে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।’ তবে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের সুরক্ষার বিষয়টিও সরকার বিবেচনা করছে বলে জানান তিনি।

বর্তমানে ব্যক্তি আয়ের ওপর সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ হলেও মৎস্য খাতের ক্ষেত্রে তা সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ। তথ্য বলছে, এই খাত থেকে আয়ের প্রথম ১০ লাখ টাকা করমুক্ত। পরের ১০ লাখ টাকার ওপর কর ৫ শতাংশ। তার পরের ১০ লাখের ওপর ১০ শতাংশ কর আরোপ করা আছে। আর আয় ৩০ লাখ টাকার বেশি হলে সেখানে সর্বোচ্চ করহার ১৫ শতাংশ।

এনবিআর সূত্র জানায়, অনেক রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ী এই কম করহারের সুবিধা নিয়ে অবৈধ অর্থ বৈধ করেছেন এবং কর ফাঁকি দিয়েছেন। এই সংখ্যা শতাধিক। এর মধ্যে বেশির ভাগই ৫০ কোটি টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন।

এনবিআরের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন সংস্থাটির করনীতি বিভাগের সাবেক সদস্য ড. সৈয়দ আমিনুল করিম। একই মত পোষণ করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমানও।

ড. সৈয়দ আমিনুল করিম বলেন, ‘এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া খুব জরুরি। কারণ রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে অনেক দুর্নীতিবাজ লোকজন এটার সুবিধা নিয়েছে এবং এখনো নিচ্ছে। এটা অল্প করের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার একটা সহজ রাস্তা। এটা বন্ধ করতে হবে।’

এতে প্রকৃত মৎস্যজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা প্রকৃত মৎস্যজীবী, তাদের আয়ের একটা বড় অংশ করমুক্ত। সেই অঙ্কটা বরং একটু বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। এতে তারা সুবিধাটা পেল এবং দুর্নীতিবাজদের রাস্তা সংকুচিত হলো।’

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশে খাতভেদে করহারের ভিন্নতা আছে। তাই এর অপব্যবহার হয়। আমরা যত দ্রুত একীভূত করহারের দিকে যেতে পারব, তত ভালো হবে। এতে জটিলতা কমে এবং ফাঁকফোকরও কমে যায়। এসব বিবেচনায় হয়তো এনবিআর এটা করতে চায়।’

এতে প্রকৃত মৎস্যজীবীরা সমস্যায় পড়বেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কর একেবারে না দিতে হলে সবচেয়ে সুবিধা হয়। তবে কর দিতে হবে। সে জন্য একটা নির্দিষ্ট হারে সব খাত কর দিলে সমস্যার সমাধান হবে।’

তবে করহার বাড়িয়ে দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না বলে মনে করছেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও ফিশ ফার্মারস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোল্লা শামসুর রহমান। তাঁরা বলছেন, এই খাতকে লাইসেন্সের আওতায় আনতে হবে এবং সঠিকভাবে মনিটর করতে হবে। তাহলে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না।

মোল্লা শামসুর রহমান বলেন, ‘এখানে সমস্যা হলো, সরকার খামারিদের সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু এনবিআর তার এসআরওতে লাইসেন্সধারী অথবা মৎস্য খামারি, এটা লিপিবদ্ধ করেনি। এ জন্য অসৎ লোকেরা এই সুবিধাগুলো নিচ্ছে। এটা তো সমস্যার সমাধান না। সমাধান হলো, প্রকৃত খামারিদের এই সুবিধার আওতায় আনতে হবে। এর সমাধান হতে পারে এনবিআরের এসআরওতে এটা সুনির্দিষ্ট করা। মৎস্য খামার হতে গেলে শুধু ট্রেড লাইসেন্স হলে হবে না; মৎস্য অধিদপ্তরের লাইসেন্সধারী হতে হবে।’

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘অপব্যবহারের মূল কারণ যতটা না কম করহার, এর চেয়ে বেশি সমস্যা হলো এই খাতের ফরমালাইজেশনের ব্যাপক অভাব। ফরমাল খাত হিসেবে রেজিস্ট্রেশন, লাইসেন্সিং ও মনিটরিংয়ের ঘাটতি রয়েছে। ফলে কম করহারের সুবিধা নিয়ে যে কেউ তার আয়কে মৎস্য খাতের আয় হিসেবে দেখিয়ে অপব্যবহার করছে। যেহেতু যেকোনো খাতের আয়কেই এই খাতের আয় হিসেবে দেখানোর বিষয়টি উন্মুক্ত থাকছে, তাই এর অপব্যবহারের আশঙ্কা বিদ্যমান। এর আগে কালো টাকা সাদা করার কৌশল হিসেবে যেকোনো আয় এই খাতের আয় হিসেবে দেখানো হয়েছে। করহার বাড়িয়ে দিলেই এই অপব্যবহার হয়তো কমবে না।’