Originally posted in প্রথম আলো on 18 November 2024
দক্ষিণ এশিয়ায় খেলাপি ঋণের হার এখন সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে
চলতি বছরের জুলাই–সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের যে হার দাঁড়িয়েছে, তা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই এখন খেলাপি। ভারত, পাকিস্তান ও এমনকি শ্রীলঙ্কার খেলাপি ঋণের হার এত বেশি নয়।
দেশের ব্যাংকগুলোতে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। তিন মাসেই ব্যাংক–ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। অভিযোগ আছে, এসব ঋণের একটি অংশ বেনামে নেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর খেলাপি ঋণের আসল চিত্র বেরিয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতে আরও অনেক ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে কম ভারতের। জুলাই প্রান্তিক শেষে দেশটির মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে মোট ঋণের ২ দশমিক ৮ শতাংশ। দেশটির খেলাপি ঋণ ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০১০ সালে ভারতের খেলাপি ঋণ ছিল ১০ শতাংশ, এরপর তা কমতে কমতে এখন ৩ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক অর্থনীতির ধীরগতির মধ্যেও ভারতের অর্থনীতি যেমন শক্তিশালী অবস্থানে আছে, তেমনি তাদের আর্থিক খাতও শক্তিশালী।
এরপর খেলাপি ঋণের অনুপাত সবচেয়ে কম নেপালের। জুলাই প্রান্তিক শেষে দেশটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মোট ঋণের ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এই হারই আবার এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ।
দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত দুটি দেশ হলো পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পর এখন ঋণ পুনর্গঠন করছে। পাকিস্তানও একাধিকবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বেইলআউট নিয়েছে। কিন্তু এই দুটি দেশের খেলাপি ঋণের হারও বাংলাদেশের চেয়ে কম।
পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের দ্বিতীয় অর্থাৎ এপ্রিল–জুন প্রান্তিক শেষে দেশটির খেলাপি ঋণের হার আগের প্রান্তিকের তুলনায় কমেছে। এই সময় দেশটির খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ; আগের প্রান্তিক অর্থাৎ জানুয়ারি–মার্চ প্রান্তিক শেষে যা ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের খেলাপি ঋণ এযাবৎকালের সর্বোচ্চ ১৬ দশমিক ৭ শতাংশে ওঠে। এরপর ধারাবাহিকভাবে তাদের খেলাপি ঋণ কমেছে। একই সময়ে পাকিস্তানের অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অক্টোবরে দেশটির মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ, যা ২০২৩ সালের মে মাসে ছিল ৪০ শতাংশ।
বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক শেষে শ্রীলঙ্কার খেলাপি ঋণের হার ১২ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২৩ সালের একই সময়ে দেশটির খেলাপি ঋণ ছিল ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরে দেশটির খেলাপি ঋণ কমেছে। ২০২২ সাল শেষে দেশটির খেলাপি ঋণের হার ছিল ১২ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি বাংলাদেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এতে দেশের উৎপাদনশীল খাতে অর্থায়ন ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এরা নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়। তবে পরিচালনাসংক্রান্ত দুর্বলতার কারণে তারা বেসরকারি খাতে দক্ষতার সঙ্গে ঋণ দিতে পারছে না।
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ও বিনিয়োগের হারের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ১ শতাংশীয় বিন্দু বাড়লে মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশীয় বিন্দু বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়লে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হয়। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে দেশে জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ যদি ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের কাতারে উঠতে চায়, তাহলে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান সম্পর্কে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সর্বশেষ হিসাব পাওয়ার ফলে একধরনের স্পষ্টীকরণ হচ্ছে। খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্রটা বেরিয়ে আসছে। এত দিন ময়লা ঝেড়ে কার্পেটের নিচে রাখা হয়েছিল, এখন তা বাইরে বেরিয়ে এল। রোগ নির্ণয় হয়েছে, ফলে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা সহজ হবে।
যাঁরা লুটপাটের উদ্দেশ্যে ঋণ নিয়েছেন, তাঁদের বিষয়ে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে মত দেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের শেয়ার নিয়ে নেওয়া হয়েছে, এটা ভালো উদ্যোগ। এভাবেই ঋণ পুনরুদ্ধার করতে হবে। তবে যাঁরা ইচ্ছা করে খেলাপি হননি, তাঁদের বিষয়টি ব্যাংক–গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে।
২০১১ সালে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার ছিল মোট ঋণের ১ দশমিক ৯ শতাংশ। পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০১৮ সালে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৯ শতাংশে।
দক্ষিণ এশিয়ার মালদ্বীপ, ভুটান ও আফগানিস্তানের খেলাপি ঋণের হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ২০২৩ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে মালদ্বীপের খেলাপি ঋণ ছিল ৬ শতাংশের কিছু বেশি। ভুটানের ক্ষেত্রে এই হার ছিল ৮ শতাংশের কিছুটা কম। আফগানিস্তানের সর্বশেষ হিসাব পাওয়া যায় ২০১৮ সালের। তখন তাদের খেলাপি ঋণের হার ছিল ৮ দশমিক ৯ শতাংশ।