আমার ব্র্যাক–জীবনঃ একজন উন্নয়ন কর্মীর বেড়ে ওঠা
লেখকঃ ডঃ আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী
প্রথমা প্রকাশন
পুস্তক পরিচিতি
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)
মাঝে মাঝে কিছু ব্যতিক্রমধর্মী বই হাতে আসে যা পড়লে পাঠক হিসাবে মনে হয় এমন একটি লেখা যদি আগে পড়ার সুযোগ হত! হয়ত সে লেখার অনুপ্রেরণা নতুনভাবে চিন্তা করতে শেখাত, বড় কিছু, ভাল কিছু, নতুন কিছু করতে উৎসাহিত করত, উদ্বুদ্ধ করত। ডঃ আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী’র “আমার ব্র্যাক-জীবনঃ একজন উন্নয়ন কর্মীর বেড়ে ওঠা” এমনি একটি প্রেরণা-পঠন। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম যারা শুধু স্বপ্ন দেখে না, যারা সম্ভাবনা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রত্যয়ী, তাদের জন্য এ বইটি পড়ার ও বোঝার এখনই সময়।
ডঃ মোশতাক যে সময়কে তাঁর লেখায় ধারণ করেছেন তা তাঁর বেড়ে ওঠা ও স্বাধীন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রযাত্রার এক যুগপৎ আখ্যান। সে আখ্যানে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে বাংলাদেশের বেসরকারী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসমূহ, যার মধ্যে অনন্যসাধারণ ও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে ব্র্যাক ও তার প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ। তাঁর লেখায় ডঃ মোশতাক বলেছেন ছাত্রজীবনের শেষে বাঁক পরিবর্তনের এক সন্ধিক্ষণে স্যার আবেদের সাথে তাঁর পরিচয়ের কথা, কিভাবে স্যার আবেদ তাঁর তরুণ সংবেদনশীল মন ও মনন কে অনুপ্রাণিত করেছিলেন সেকথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে পড়া শেষ করে সে পরিচয়ের সুত্রেই তাঁর ব্র্যাক-জীবনের সুচনা। ব্র্যাক-এর বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে তাঁরও বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতাই এই বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য। সে বেড়ে ওঠা থেকে আমরা জানতে পারি ব্র্যাক-এর অনেক সফল কর্মসূচীর পেছনে লেখকের অবদানের কথা – একজন তরুণ গবেষণা কর্মী থেকে কিভাবে স্যার আবেদের একান্ত ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে ব্র্যাক-এর নানামুখী অর্জনে যে ভূমিকা রেখেছেন সে কথা। ছিলেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আর স্যার আবেদ যখন চেয়ারম্যান তখন ব্র্যাকের ভাইস চেয়ারম্যান। স্যার আবেদের মত একজন বিরল ব্যক্তিত্বকে কাছে থেকে দেখা ও তাঁর কাছ থেকে শেখার কথা বিশদভাবে বলা আছে এই বই এর অনেকাংশ জুড়ে।
পৃথিবীখ্যাত লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে ডেমোগ্রাফির ওপর উচ্চতর পড়াশোনা শেষে দেশে ফেরার পর যখন বিদেশী সংস্থায় কাজের লোভনীয় প্রস্তাব এসেছে, পাঁচ গুণ বেশী বেতনের চাকুরীর প্রস্তাব পেয়েছেন, লেখক সেটা তখন ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন নিজেকে এ প্রশ্ন করে, ‘টাকা-পয়সা তো অনেক রোজগার করা যায় কিন্তু তাতে কি জীবন স্বার্থক হয়?’ লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে দুই বছর তিন মাসের রেকর্ড সময়ে ওরাল থেরাপি প্রোগ্রামের ওপর পি. এইচ. ডি. করে দেশে ফিরে আসেন; হার্ভার্ড-এর আহবান উপেক্ষা করেছিলেন আবেদ ভাই-এর পরামর্শে – সেখানে চার থেকে পাঁচ বছর লাগবে পি. এইচ. ডি. করতে, কিন্তু ব্র্যাক-এ তাঁর মত তরুণের তখন অনেক প্রয়োজন।
পরবর্তীতে বিখ্যাত কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথের অধ্যাপক হিসেবে ডঃ মোশতাক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের আই ভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের প্রথম বাংলাদেশি অধ্যাপক, যা এক বিরল অর্জন। তাঁর লেখাতে পাই রকফেলার ফাউন্ডেশনের সিনিয়র এডভাইজার-এর মত বিশাল পরিসরের কাজের অভিজ্ঞতা, যে রকফেলার ফাউন্ডেশনের সহায়তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ে জনস্বাস্থ্য ও ইনফরমেটিক্স বিভাগ স্থাপনে তিনি উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। আবার আবেদ ভাই যখন ডাক দিয়েছেন, তখন শতকরা ৯০ ভাগ কম বেতনে বিদেশী সংস্থার সে চাকুরী ছেড়ে দেশে এসে আবার ব্র্যাক পরিবারে যোগ দিয়েছেন।
কোন উদ্যোগের কার্যকারিতার সঠিক মূল্যায়ন ও তার প্রসার-যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য মাঠ পর্যায়ের গবেষণা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা অনেক সময় আমরা সম্যকভাবে অনুধাবন করিনা। ডঃ মোশতাককে ব্র্যাক সে গবেষণার সুযোগ করে দিয়েছিল, পরবর্তীতে যা তাঁকে একজন প্রখ্যাত গবেষক ও শিক্ষক হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, সুনাম দিয়েছে, অনেক বিরল স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘আমার গবেষণা জগতে বিচরণ কোন আকস্মিক ঘটনা ছিল না। দেশের এবং বিশেষ করে পশ্চাদপদ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে আমার আশৈশব লালিত অভিলাষ থেকেই এর যাত্রা শুরু। এই লড়াইয়ে গবেষণা হচ্ছে আমার হাতিয়ার। তাই প্রথম থেকেই আমি প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। এ ক্ষেত্রে ধৈর্য ও অধ্যাবসায় এক বিশেষ ভূমিকা রেখেছে’। ব্র্যাক-এর আর. ই. ডি.– গবেষণা প্রোগ্রামের মাধ্যমে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা গবেষণার ক্ষেত্রে রেখেছিলেন পাইওনিয়ার-এর ভূমিকা। গবেষণার সাথে মাঠ পর্যায়ের উদ্ভাবনী কার্যক্রমের মেলবন্ধনের মাধ্যমে ‘এক চিমটি লবণ ও এক মুঠো গুড়’-এর মত যুগান্তকারী ফর্মুলা কিভাবে সারাদেশে বিস্তৃতি লাভ করে সে কথা আমরা ডঃ মোশতাকের লেখা থেকে জানতে পারি। জানতে পারি সেসব নিবেদিত সহকর্মীদের কথা যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে, ট্রায়াল এন্ড এরর এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে।
নারীর ক্ষমতায়ন কর্মসূচী থেকে সুলভে রিডিং গ্লাসের প্রচলন, পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচী, ব্র্যাক-আই. সি. ডি. ডি. আর. বি.-র যৌথ উদ্যোগে চাঁদপুরের মতলবে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, ক্ষুদ্রঋণ, উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমন্নয়ে বিশাল কর্মকাণ্ড – এসব কর্মসূচী বাস্তবায়নের বর্ণনায় আছে উন্নয়নকর্মীদের জন্য অনেক কিছু শিক্ষণীয়। কোন ধারণা, তা সে যত মৌলিক ও প্রয়োজনীয়ই হোক না কেন, তার যথার্থতা, গ্রহণযোগ্যতা ও সর্বোপরি স্কেলিং আপ-এর জন্য যে ধাপে ধাপে গবেষণার প্রয়োজন এবং এ ক্ষেত্রে শিখনের অভাব ও অনীহার অতিক্রমন যে সফল বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত, নিজের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার আলোকে আকর্ষণীয় ও প্রানবন্ত ভাষায় ডঃ মোশতাক সেসবের বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর লেখায় আছে ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, কৃষি, পুষ্টি, শিক্ষা কার্যক্রমকে বাংলাদেশের বাইরে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে পৌঁছে দেবার কথা। জানতে পারি উন্নয়ন ও কল্যাণধর্মী মডেলের স্থানীয়করণ কেন এতটা জরুরী, তা সে মডেল কাগজে কলমে যত ভালই হোক না কেন। শিখতে পারি কিভাবে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মানুষকে কোন মডেলের বাস্তবায়নে প্রথম থেকে ও কার্যকরভাবে যুক্ত করা হল সে মডেলের সাফল্যের পূর্বশর্ত।
বাংলাদেশের যেসব অর্জন সারাবিশ্বে নাম করেছে, অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে – যেমন ওরস্যালাইন কর্মসূচী, টিকাদান কর্মসূচী, প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলা, কৃষিতে উন্নত বীজের প্রচলন, পোলট্রিবিপ্লবে ভেল্যু চেইন ও মাছ চাষের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি – এসব বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের গবেষণার মাধ্যমে এগুলির কার্যকারিতা কিভাবে বাড়ানো হয়েছিল সেসব অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সামনের দিকে এগিয়ে চলার এ যুগ সন্ধিক্ষণে আজও প্রাসঙ্গিক। ডঃ মোশতাকের কাছ থেকে জানতে পারি ব্র্যাকের পৃথিবীখ্যাত জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর প্রতিষ্ঠাতা ডীন হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা, যে স্কুলের আর্থসামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদানের জন্য পরবর্তীতে গঠন করেছেন পরিবারের মালিকানায় থাকা একমাত্র জমি বিক্রির টাকা দিয়ে একটি তহবিল। নিজেকে আড়ালে রেখে, নিজস্ব ভুমিকাকে গৌণ গণ্য করে, সহকর্মী ও সহযোদ্ধাদের কাছে অকপটে ঋণ স্বীকার করে, তাঁদের ভুমিকাকে গুরুত্ব ও সম্মান দিয়ে লিখেছেন ব্র্যাকের সেসব উদ্যোগের কথা যেসবের সাথে তিনি ছিলেন ওতপ্রোতভাবে যুক্ত, কোন কোনটিতে কেন্দ্রীয় ও নেতৃত্বের ভুমিকায়।
প্রখ্যাত ল্যানসেট পত্রিকায় একাধিক প্রবন্ধ সহ দুই শয়ের অধিক প্রকাশনার মাধ্যমে এবং বাংলাদেশে বিশ্বখ্যাত ল্যানসেট সিরিজ বক্তৃতামালা আয়োজন করে ডঃ মোশতাক গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও ব্র্যাকের অভিজ্ঞতাকে নিয়ে গেছেন জ্ঞান জগতের বৃহত্তর পরিসরে। অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, হেলথ ওয়াচ ও এডুকেশন ওয়াচ-এর মত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগে। শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি লিখেছেন – This is a wake up alarm, not a wake up call। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড-এর অন্যতম সদস্য হিসাবে গুণগত মানসম্পন্ন উচ্চ শিক্ষার প্রসারে অবদানের মাধ্যমে সচেষ্ট রয়েছেন এ অবস্থার পরিবর্তনে। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন আমাদেরকে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা স্কিমের কথা এখনই ভাবতে হবে। এস. ডি. জি. বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর কমিটির সদস্য হিসেবে রেখে চলেছেন ‘কাউকে পিছনে রাখা যাবে না’- এস. ডি. জি.-র এ প্রত্যয়ের বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সীমিত সময়ের জীবনে সার্থকতা আছে কেবলমাত্র পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য ভাল কিছু করার মধ্যেই- এটা তিনি শিখেছেন স্যার আবেদের কাছে।
১৯৮০ সালে স্যার আবেদ ম্যাগসাইসাই পুরস্কার নিতে গিয়ে বলেছিলেন “A community of greed has taken over the community of need”। এ কথা কয়টি তরুণ ডঃ মোশতাককে নতুন এক জীবন-দর্শনে ভাবিত ও প্রাণিত করেছিল। আমরা জানি স্যার আবেদ সারাজীবন সেই বাস্তবতাকে প্রশ্ন করেছেন, তার বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। ডঃ মোশতাক ছিলেন সে সংগ্রামে তাঁর অন্যতম সহযোদ্ধা। লিখেছেন, ‘আমার যত ঋণ – সবই ব্র্যাক ও আবেদ ভাইয়ের কাছে’।
তিনি একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, স্যার আবেদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্র্যাক ও তাঁর সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহ আগামীতে এগিয়ে যাবে নতুন নতুন অর্জন, উদ্ভাবন ও সাফল্যের পথে, নতুন প্রজন্মের সফল নেতৃত্বে। জীবনে তুস্টির সাথে অতৃপ্তি ও অপূর্ণতা থাকবে। এটাই জীবন। কিন্তু মূল লক্ষ্যটিকে নির্ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে; ব্যক্তিগত আশা-হতাশাকে অতিক্রম করে সে লক্ষ্যের দিকে অবিচল থাকতে হবে; পরিশ্রম করতে হবে; মানুষকে ভালবাসতে হবে – পরিণত বয়সে পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে সেখানেই নিহিত একজন মানুষের প্রকৃত সন্তুষ্টি ও সাফল্য । যাপিত জীবনের এই উপলব্ধি দিয়েই ডঃ মোশতাক তাঁর লেখার উপসংহার টেনেছেন। এ উপলব্ধিতে অনুপ্রাণিত মানুষেরাই এগিয়ে নেবে বাংলাদেশকে আগামীর দিনে। সেই কারণেই এই আশা যে বইটি পাঠক সমাদৃত হবে এবং বহুলভাবে পঠিত হবে।