Originally posted in দেশ রূপান্তর on 20 July 2025
এনবিআরের রাজস্ব ঘাটতি ৯৩ হাজার কোটি টাকা
বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার ঘাটতি হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাময়িক হিসাব অনুসারে, গত অর্থবছরে শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৯২ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা, যা এ যাবৎকালের রেকর্ড। মূলত অর্থবছরের শুরু থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা এবং সর্বশেষ এনবিআরে সংঘটিত আন্দোলন ঘাটতি তরান্বিত করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের কারণে দেড় থেকে দুই মাস ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় অচল ছিল। আবার বছরের শেষ মাস জুনে এনবিআরের আন্দোলনের কারণে বড় ধরনের ঘাটতির মুখে পড়েছে দেশের প্রধান রাজস্ব আদায়কারী সংস্থাটি। বিদায়ী অর্থবছরে সব মিলিয়ে এনবিআরের শুল্ক, ভ্যাট ও কর বিভাগ আদায় করেছে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। এনবিআরের সংশোধিত লক্ষ্য ছিল ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আয়কর বিভাগে সবচেয়ে বেশি ৪২ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা ঘাটতি হয়েছে।
গত অর্থবছরে কাক্সিক্ষত রাজস্ব আদায় না হওয়ার প্রধান দুটি কারণ হলো জুলাই আন্দোলন এবং এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন। এই দুটি নতুন কারণ। এ ছাড়া এনবিআরে দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়া; কর জাল বৃদ্ধি না পাওয়া, কর কর্মকর্তাদের সক্ষমতার অভাব, শুল্ক-কর ফাঁকি, পর্যাপ্ত অটোমেশন না হওয়া এসব পুরনো কারণ তো আছে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে করদাতাদের হয়রানি এবং ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগও আছে।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। অফিস আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা যায়নি। এ ছাড়া আন্দোলনের সময় বেশ কয়েক দিন কারফিউ ছিল। এসব কারণে কাক্সিক্ষত রাজস্ব আদায় হয়নি। এ ছাড়া বছর জুড়ে এক ধরনের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতাও ছিল।
এর আগে গত মে মাসে বাজেট পর্যালোচনা করতে গিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) জানিয়েছিল যে, অর্থবছর শেষে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি হতে পারে। অর্থবছর শেষে দেখা গেল ঘাটতি ১ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
কী কারণে এনবিআরের রাজস্ব আহরণে এত বেশি ঘাটতি হচ্ছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অর্থবছর জুড়ে রাজস্ব আহরণের যে গতিধারা চলমান ছিল, সেটির ভিত্তিতেই আমরা প্রক্ষেপণ করেছিলাম যে, বছর শেষে রাজস্ব আহরণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এবার যে বড় ঘাটতি হবে, সেটা আগে থেকেই অনুমান করা গিয়েছিল। কারণ অর্থবছরের শুরু থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখ দেয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলন, আওয়ামী লীগ সরকার পতন প্রভৃতি কারণে প্রথম দুই মাস দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে কোনো গতি ছিল না। ফলে শুরু থেকেই রাজস্ব আহরণের গতি কম ছিল। আর পুরো অর্থবছর জুড়েই ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা বিরাজ করেছে। সেটিরও প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আহরণে। সর্বশেষ এনবিআর সংস্কারকে কেন্দ্র করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনও রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।’
তিনি বলেন, বিগত ১০ বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে যে, রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না। এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে। মূলত এনবিআরের কাঠামোগত ত্রুটি এ ক্ষেত্রে বড় কারণ। এনবিআরের কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। অন্যদিকে এনবিআরের সক্ষমতা বিবেচনায় না নিয়েই সরকার একটি লক্ষ্যমাত্রা সংস্থাটির ওপর চাপিয়ে দেয়। ফলে তারা সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে না।
গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৯২ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা বা ১৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ কম আদায় হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছর রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে ২ দশমিক ২৩ শতাংশ।
এনবিআরের সর্বশেষ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আয়কর ও ভ্রমণ কর আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। তবে আদায় হয়েছে ১ লাখ ২৯ হাজার ৯০ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪২ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ লাখ ২৫ হাজার ৪৮৫ টাকার আয়কর আদায় হয়েছিল।
আয়করের মতো একই লক্ষ্যমাত্রা ছিল স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে। তবে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৪১ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ভ্যাট আদায় কম হয়েছে ২৯ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। আয়কর ও ভ্যাটের মধ্যে রাজস্ব আদায়ে কিছুটা এগিয়ে আছে ভ্যাট। এ খাতে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক শূন্য এক শতাংশ। তার আগের বছরে ভ্যাট থেকে এসেছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা।
এ ছাড়া কাস্টমস খাতে অর্থাৎ শুল্ক আদায় হয়েছে ১ লাখ ১৯৮ কোটি টাকা। এ খাতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। সে হিসাবে আদায় কম হয়েছে ২০ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। এ খাতে প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ। আগের অর্থবছরে শুল্ক থেকে এসেছে ১ লাখ ২০ হাজার ৫১০ কোটি টাকা।