Published in আলোকিত বাংলাদেশ on Tuesday, 9 January 2018
৫ বছরে রাজস্ব আয়ের গড় প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ
বিদেশি ঋণনির্ভরতা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বা রাজস্ব আয় বাড়ানোর যে পরিকল্পনা সরকারের ছিল, গত কয়েক বছরে তা অনেকাংশে সফল হয়েছে। পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প এখন নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়ছে। এর মূলে রয়েছে রাজস্ব আয়ের বড় উল্লম্ফন। গত ৫ বছর রাজস্ব আয় গড়ে ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ হারে বেড়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ১৫১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। বিগত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ রাজস্ব আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৭৫ হাজার ৩০৮ কোটি টাকার রাজস্ব আয় হয়েছে। খবর বাসসের।
আয়কর মেলাসহ এনবিআরের নানামুখী উদ্ভাবনী উদ্যোগ রাজস্ব আহরণের সাফল্যের পেছনে চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করছে কর প্রশাসন। এ সময়ে রাজস্ব আয় বাড়ার পাশাপাশি করদাতার সংখ্যাও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত মুখ্য সচিব মোঃ নজিবুর রহমান বাসসকে বলেন, ‘গত কয়েক বছরে আয়কর মেলা, ট্যাক্স ও ভ্যাট কার্ড প্রদান, কর বাহাদুর পরিবারকে সম্মাননা জানানোসহ এনবিআরের নানামুখী উদ্ভাবনী উদ্যোগ দেশে রাজস্ববান্ধব সংস্কৃতি তৈরি করতে পেরেছে। ফলে করদাতার সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজস্ব আয়ের ধারাবাহিক সাফল্য এসেছে।’ তিনি বলেন, আগে জনগণের মধ্যে করভীতি ছিল। সেই ভীতি আমরা কাটাতে পেরেছি। মানুষ এখন কর দিতে চান। কর প্রশাসন জনবান্ধব প্রশাসনে পরিণত হয়েছে। এর ফল হিসেবে রাজস্ব আয় ও করদাতার সংখ্যা বেড়েছে।
নজিবুর রহমান গত ৩ বছর এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় বিভিন্ন উদ্ভাবনী কর্মসূচি চালু করে কর কার্যক্রম ও কর প্রশাসনে তিনি সংস্কার আনেন। গত সোমবার তাকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এনবিআরের সদ্য সাবেক এ চেয়ারম্যানের মতে, বিগত কয়েক বছর করদাতাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে হয়রানি বন্ধ করা গেছে। পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে ঘরে ঘরে করসেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, যা রাজস্ব আহরণে ইতিবাচক ফল এনে দিয়েছে।
এনবিআরের তথ্য মতে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে সংগৃহীত ১ লাখ ৯ হাজার ১৫১ কোটি ৭৩ লাখ টাকার রাজস্ব আয় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ২০ হাজার ৮১৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকায়। ১ বছরের ব্যবধানে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয় ১০ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা ২০১২-১৩ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ কোটি ৭০ লাখ টাকা; এ বছর প্রবৃদ্ধি হয় ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রাজস্ব আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৫ হাজার ৫১৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা; প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। বিগত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে বড় সাফল্য আসে। রাজস্ব আয় হয় ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। গত বছরই বেশি প্রবৃদ্ধি হয় ১৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
বিগত ৫ বছরে আহরিত রাজস্বের মধ্যে আমদানি ও রপ্তানি পর্যায় (শুল্ক খাত) অবদান ছিল ২৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্যসংযোজন কর (মূসক) থেকে আসে ৩৬ দশমিক ০৭ শতাংশ এবং আয়কর খাতের অবদান ৩৫ দশমিক ১৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের নির্ধারিত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। করদাতা ও দেশবাসীর সহায়তায় এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে বলে নজিবুর রহমান আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এনবিআরের তথ্য মতে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ইলেকট্রনিক আয়কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীর (ইটিআইএন) সংখ্যা যেখানে মাত্র ১২ লাখ ছিল, সেটা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ লাখ ৭১ হাজারে। সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন দ্বিগুণ হওয়ায় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে সরকারি চাকরিজীবী করদাতার সংখ্যা। এছাড়া কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং বেসরকারি খাতে কর্মকর্তা পর্যায়ে চাকরিজীবীদের রিটার্ন জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করার কারণে সেখানেও ই-টিআইএনধারীর সংখ্যা বেড়েছে। সবকিছু মিলিয়ে গত ১ বছরে করের আওতা দ্বিগুণ বেড়েছে।
এনবিআরের সদ্য সাবেক এ চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের সঙ্গে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক করায় নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা গত ১ বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে করদাতার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি প্রমাণ করে, দেশের নাগরিকরা কর প্রদানে সচেতন হচ্ছেন। এনবিআরের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়ছে। হয়রানিমুক্ত পরিবেশে তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ই-টিআইএন নিবন্ধন করছেন।’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘কয়েক বছরে এনবিআরের নীতিমালায় বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে। তাদের উদ্ভাবিত আয়কর মেলা জনগণকে আয়কর প্রদানে উৎসাহিত করেছে। অনলাইনে ই-টিআইএন ও ভ্যাট নিবন্ধন কার্যক্রম চমকপ্রদ ধারণা। ফলে বাজেটের আকার বৃদ্ধি ও এনবিআরের নেওয়া বিভিন্ন সমন্বিত উদ্যোগের ফলে বেড়েছে রাজস্ব আয়। এনবিআরের এ সাফল্য অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে যে তুলনায় বাজেটের আকার বাড়ছে, এনবিআর সেই তুলনায় এগিয়ে যেতে পারছে না। বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার যে পরিকল্পনা, সেই তুলনায় এনবিআরের এখনও ঘাটতি রয়েছে। তাদের এগিয়ে যাওয়ার যে প্রত্যয় যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে; সেই গতিতে আরও গতি সঞ্চার করা উচিত।’ জনগণের দেওয়া রাজস্বের উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন।