Originally posted in বাংলা ট্রিবিউন on 30 July 2024
অর্থনৈতিক চাপ কতটা সামাল দেওয়া যাবে
দিন যত যাচ্ছে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ ততই বাড়ছে। অথচ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো—বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের প্রধান দুটি মাধ্যম রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এমন সময়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে বাংলাদেশকে প্রায় ৩৩৬ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। এর ফলে এই প্রথমবারের মতো এক বছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধ ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেলো। পরিশোধ করা অর্থের মধ্যে মূল ঋণ ২০১ কোটি ডলার, আর সুদের পরিমাণ প্রায় ১৩৫ কোটি ডলার।
রবিবার (২৮ জুলাই) প্রকাশিত ইআরডির হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কয়েক বছর ধরেই বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। ঋণ পরিশোধ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গত দুই বছরে।
সামনের দিনগুলোতে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, দেশে রেমিট্যান্স ও রফতানিসহ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে আমদানি দায় ও ঋণ পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে বেশি। ফলে নিম্নমুখিতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
এদিকে ইআরডির তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধ দুটোই বেড়েছে। গত অর্থবছরের তুলনায় এই বৃদ্ধি ২৫ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সুদ ও আসল মিলিয়ে ২৬৮ কোটি ডলার পরিশোধ করে বাংলাদেশ।
বিদেশি ঋণ পরিশোধের এই চাপ শুরু হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন দেশে দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। এর প্রভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। এমন বাস্তবতার মধ্যেই একের পর এক দুঃসংবাদ আসছে অর্থনীতিতে। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান করা রফতানি ও রেমিট্যান্স নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে সংশ্লিষ্ট মহলে।
অবশ্য চলতি মাসের (জুলাই) শুরুর দিকেই প্রকৃত রফতানি আয় নিয়ে দুঃসংবাদ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। দুঃসংবাদটি হলো, শুধু ২০২৩-২৪ অর্থবছরেরই ১০ বিলিয়ন ডলারের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।
এমন সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নতুন করে রফতানি আয় আরও কমে যাওয়ার দুঃসংবাদ আসছে বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে। বহির্বিশ্বে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ক্রেতাদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। বিদেশি ক্রেতাদের অনেকে অর্ডার বাতিল করেছেন, নতুন কোনও অর্ডার আসছে না। চলমান সহিংসতার মধ্যে ইন্টারনেট-সেবা বন্ধ থাকার কারণে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী বাংলাদেশ থেকে সরে যাচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
একইসঙ্গে বিভিন্ন দেশে রেমিট্যান্সবিরোধী প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এরইমধ্যে রেমিট্যান্স প্রবাহে ধস নেমেছে। কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সৃষ্ট সহিংতায় হতাহতের ঘটনার প্রতিবাদে প্রবাসীদের একটি অংশ ‘বৈধ পথে রেমিট্যান্স না পাঠানো’র বিষয়ে ক্যাম্পেইন করছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রেমিট্যান্সের নেতিবাচক প্রবাহ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি করবে। অবশ্য নানা কৌশলে যেকোনও মূল্যে রেমিট্যান্স বাড়াতে কাজ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরইমধ্যে নির্ধারিত রেটের চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে মৌখিকভাবে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে গত ৮ মে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালুর পর ডলারের দর এক লাফে ৭ টাকা বেড়ে ১১৭ টাকা হয়। তখন থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে থাকে। কিন্তু ছন্দপতন হয় গত সপ্তাহে। কোটা সংস্কার ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে গত সপ্তাহের ছয় দিনে অন্য সময়ের একদিনের সমান রেমিট্যান্সও আসেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত দেশে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১৫০ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রায় ৯৮ কোটি ডলার এসেছিল প্রথম ১৩ দিনে। আর ১৪ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ১০ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ৫৩ কোটি ডলার। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ পড়তে শুরু করেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিদেশি ঋণ পরিশোধ বাবদ অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বাজেটে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও খারাপ হয়। অস্থিরতায় এখন রেমিট্যান্স কমেছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আগামী দিনে আরও কমবে। সামনের দিনে রফতানিও কমবে। রিজার্ভও কমবে। তাতে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপও বাড়বে।’ তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বিনিয়োগ আসবে না। আবার বড় অঙ্কের রেমিট্যান্সও আসবে না।’
তিনি জানান, এমনিতেই ইপিবির হিসাবের চেয়ে বাস্তবে রফতানি আয় কম হয়েছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর দেওয়া পরিসংখ্যানের চেয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন ডলার কম রফতানি আয় হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে টানা তিন অর্থবছরেই বাংলাদেশের পণ্য রফতানি কমছে। এমন দুঃসংবাদের মধ্যেই শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন, যা রূপ নেয় সহিংসতায়। ফলে পণ্য জাহাজীকরণে বাধা, উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে দেশের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। এতে আগামী দিনগুলোতে রফতানি আরও কমে যেতে পারে। আর রফতানি কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে যাবে। রেমিট্যান্স-রফতানি ছাড়াও বৈশ্বিক উচ্চ সুদের হার রিজার্ভকে চাপে রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কত, তা নিয়ে লুকোচুরি চলছে। গত ৩০ জুনের পর রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। সে কারণে দেশের রিজার্ভ এখন কত, তা জানে না দেশবাসী। অবশ্য গত ৯ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আকুর মে-জুন মেয়াদের ১ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে ২০ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
তবে অর্থ মন্ত্রণালয় মনে করছে, উন্নত বিশ্বে বিদ্যমান উচ্চ সুদের হার বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসে প্রভাব ফেলছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, উন্নত দেশগুলোতে এই উচ্চ সুদের হার আগামীতে অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো কঠিন হতে পারে। একইসঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারে বিরাজমান উচ্চ সুদের হার বিনিয়োগের গতি শ্লথ করে প্রভাব ফেলতে পারে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে। অর্থ বিভাগের করা এক নীতি বিবৃতিতে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিবেচনায় চলতি অর্থবছরে আটটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ মনে করেন, চলমান পরিস্থিতির কারণে রফতানি রেমিট্যান্সসহ দেশের অর্থনীতির সব খাতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘অর্থনীতি ভালো নেই। ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সুদহার বাড়ছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে, রফতানি কমে যাচ্ছে। ফলে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যে অর্থনীতির এই সংকট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
প্রসঙ্গত, বিভিন্ন খাতে উন্নয়ন প্রকল্পে নেওয়া ঋণের অর্থ পরিশোধের চাপ গত কয়েক বছরে ক্রমাগত বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা—রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, মেট্রোরেল ও কর্ণফুলী টানেলের মতো মেগা প্রকল্পগুলোর ঋণ পরিশোধ শুরু হলে এ চাপ আরও অনেক জোরালো হয়ে উঠবে। এখন পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। এর মধ্যে আকারে সবচেয়ে বড় ঋণটি নেওয়া হয়েছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে। এ প্রকল্পের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে ১ হাজার ১৩৮ কোটি (১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন) ডলার ঋণ অর্থায়নের চুক্তি রয়েছে। এ ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা ২০২৭ সালের মার্চ থেকে। যদিও গত মার্চে আন্তমন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকের পর ইআরডি ঋণের কিস্তি দুই বছর পিছিয়ে ২০২৯ সালের মার্চে নেওয়ার জন্য রাশিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছে।
এছাড়া বিদেশি ঋণ পরিশোধে সরকার বৈদেশিক মুদ্রার জোগান পেতে আইএমএফের ঋণ গ্রহণ করেছে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় সুদ ছাড়া মূল ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ২৮ কোটি ডলার বা ১৬ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল ১৭৩ কোটি ডলার।
আর এক বছরের ব্যবধানে সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। গত অর্থবছরে সুদ খাতে অতিরিক্ত খরচ করতে হয়েছে ৪২ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের সুদ বাবদ ৯৩ কোটি ডলার খরচ করতে হয়েছিল। বিদায়ী অর্থবছরে প্রথমবারের মতো শুধু সুদ বাবদ খরচ এক বিলিয়ন ডলার বা ১০০ কোটি ডলার ছাড়ালো।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শুধু অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়, এমন সাশ্রয়ী প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি। যেন আগামীতে আরও বড় ঋণের চাপে না পড়ি।’ তিনি বলেন, ‘রেমিট্যান্স ও রফতানি কমে গেলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে। এজন্য রেমিট্যান্স ও রফতানির মাধ্যমে রিজার্ভও বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশে বড় কয়েকটি প্রকল্পের ঋণের ম্যাচিউরিটি পিরিয়ড শুরু হচ্ছে। এগুলোর সুদ-আসল পরিশোধ শুরু হয়েছে। এটি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আগামীতে আরও বাড়বে। ’
ইআরডির তথ্য অনুসারে, গত অর্থবছরের জুলাই থেকে জুন সময়ে ৯৮৬ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ এসেছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ছাড় বেড়েছে ৫৫ কোটি ডলার। আগের অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯২১ কোটি ডলার ছাড় করেছিল উন্নয়ন সহযোগীরা। এদিকে, গত অর্থবছরে ঋণদাতা সংস্থা ও দেশগুলো ১ হাজার ৭২ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।