Published in যুগান্তর on Wednesday, 9 May 2018
৫ দেশের চাপ ছাড়া রোহিঙ্গাদের ফেরানো সম্ভব নয়
মিয়ানমারের আমাদানি-রফতানির ৮০ শতাংশই এসব দেশের সঙ্গে * এক চীনের সঙ্গেই ৪১ শতাংশ * এ কারণেই অন্যদের তোয়াক্কা করছে না মিয়ানমার
মনির হোসেন
রাষ্ট্রীয়ভাবে রোহিঙ্গা নির্যাতনকারী হিসেবে চিহ্নিত মিয়ানমারের অর্থনীতি মূলত ৫টি দেশের ওপর নির্ভরশীল। দেশগুলো হল- চীন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভারত ও জাপান। দেশটির আমদানি-রফতানির ৮০ শতাংশই এই পাঁচ দেশে। একক দেশ হিসেবে অর্থনীতির প্রায় ৪১ শতাংশ চীনের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ অন্যসব দেশ আমদানি-রফতানি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলেও দেশটির অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের কোনো আঘাত লাগবে না। স্বল্প মেয়াদে যতটুকু ক্ষতি হবে, তার বিকল্প পথ বের করে নিতে পারবে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটি। আর বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে এ দেশগুলোর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের চাপ নেই। ফলে আন্তর্জাতিক অন্য কোনো দেশ বা সংস্থার কোনো ধরনের চাপ আমলে নিচ্ছে না মিয়ানমার। এ পাঁচটি দেশের চাপ ছাড়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরানো কঠিন।
মিয়ানমারে নিযুক্ত কানাডার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত বব রায়ের রিপোর্টে এসব বিষয় ওঠে এসেছে। ওই রিপোর্ট অনুসারে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় হবে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৮ হাজার কোটি টাকা।
জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ড. আবদুল মোমেন যুগান্তরকে বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতা রয়েছে। কূটনৈতিকভাবে ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আন্তর্জাতিক একটি ইস্যুকে দ্বিপাক্ষিক ইস্যু বানানো হয়েছে। ফলে খুব সহজে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে বলে মনে হয় না। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হলে যেসব দেশের সঙ্গে মিয়ানমারের শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, তাদের কাজে লাগাতে হবে। বিশেষ করে এখানে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে চীন।
বিশ্বব্যাংকের উদ্ধৃতি দিয়ে বব রায়ের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মিয়ানমারের পণ্য রফতানির পরিমাণ ছিল ১১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে উল্লিখিত ৫ দেশে রফতানি হয়েছে ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রফতানি আয়ের ৮২ দশমিক ২৪ শতাংশ। একক দেশ হিসেবে চীনে রফতানি হয়েছে ৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। এ ছাড়াও থাইল্যান্ডে রফতানি হয়েছে ২ দশমিক ২৫ বিলিন ডলার, ভারতে ১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার, সিঙ্গাপুরে দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার এবং জাপানে দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য।
এদিকে এ সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দেশটিতে ১৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার পণ্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ওই ৫ দেশ থেকে এসেছে ১২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার, যা মোট আমদানির ৭৭ শতাংশ। এর মধ্যে চীন থেকে আমদানি হয়েছে ৫ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা মিয়ানমারের মোট আমদানির ৪৫ শতাংশ। এ ছাড়াও সিঙ্গাপুর থেকে এসেছে ২ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার, থাইল্যান্ড ১ দশমিক ৯১ বিলিয়ন, জাপান ১ দশমিক ২৬ বিলিয়ন এবং ভারত থেকে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য এসেছে।
উল্লেখ্য, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে এ পর্যন্ত ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে জাতিসংঘের মহাসচিব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা মিয়ানমারের ওপর চাপ দিয়েছিল। এরপর প্রাথমিকভাবে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে মিয়ানমার। কিন্তু ওই চুক্তি বাস্তবায়ন না করে গড়িমসি করছে দেশটি। অপরদিকে যে ৫টি দেশের ওপর মিয়ানমারের অর্থনীতি নির্ভরশীল, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আপাতত ওইসব দেশ থেকে কোনো চাপ নেই। উল্টো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দেশটির বিরুদ্ধে শক্ত কোনো পদক্ষেপ এলেই ভেটো দিয়ে তা বাতিল করে দেয় চীন। ফলে রোহিঙ্গাদের খুব দ্রুতই দেশে ফেরার সম্ভাবনা কম।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মধ্যমেয়াদি চাপ তৈরি হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা অনুসারে রোহিঙ্গাদের জন্য ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের বাজেটে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রাখতে হবে। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। সুনির্দিষ্টভাবে ১২টি খাতে এ অর্থ ব্যয় করতে হবে। এর মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তায় ২৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার, পানি ও অন্যান্য ১৫ কোটি ৮২ লাখ ডলার, আশ্রয় ১৫ কোটি ৮১ লাখ ডলার, ব্যবস্থাপনায় ১৫ কোটি ২২ লাখ ডলার, স্বাস্থ্য ১৩ কোটি ৯ লাখ ডলার, নিরাপত্তা ৮ কোটি ৩২ লাখ ডলার, পুষ্টিতে ৬ কোটি ৫৭ লাখ ডলার, শিক্ষা ৫ কোটি ৪৯ লাখ ডলার, সমন্বয় ৬৪ লাখ ডলার, অবকাঠামো ৪২ লাখ ডলার এবং জরুরি টেলিকম সেবায় ১৩ লাখ ডলার সহায়তা লাগবে। এক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ না রাখা হলে পরবর্তী সময়ে সমস্যায় পড়তে হতে পারে।