অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর শ্বেতপত্র তৈরি করা জরুরি – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

অনেক কিছুই নির্ভর করবে সরকারের মেয়াদকালের ওপর

Originally posted in সমকাল on 12 August 2024


অর্থনীতি নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের করণীয় বিষয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাকির হোসেন

সমকাল: দেশের অর্থনীতির সংকটময় পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছে নতুন সরকার। সংকট কাটাতে কী করা দরকার?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আমি প্রথমেই মনে করি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর একটা শ্বেতপত্র তৈরি করা দরকার। শ্বেতপত্র তৈরি করলে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে। এই মুহূর্তে অর্থনীতিতে যে জটিল পরিস্থিতি রয়েছে, তা জানার জন্য এবং পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য যা হবে একটি নির্দেশিকা। শ্বেতপত্রের অনেক সুবিধা আছে। নতুন সরকার কোন অবস্থায় অর্থনীতিকে পেল, তার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য মূল্যায়ন তাদের যেমন দরকার, ইতিহাসের জন্যও দরকার। শ্বেতপত্র তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি মূল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আলোচনার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যালোচনা ও দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের সৃষ্টি হবে। নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যা এক ধরনের গণতান্ত্রিক ভিত্তি দেবে। কোনো কারণে সরকার যদি না করে তাহলে পেশাজীবী নাগরিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসতে হবে। তাই শ্বেতপত্র তৈরি করা জরুরি।

সমকাল: শ্বেতপত্র তৈরির প্রক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: শ্বেতপত্র তৈরি করতে হলে অবশ্যই সরকারকে একটি কাঠামো দিতে হবে। কাঠামোর সঙ্গে সরকারের আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান অবস্থানপত্র তৈরি করবে। যেমন– ইতোমধ্যে দায়দেনা পরিস্থিতি নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অবস্থানপত্র রয়েছে। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থার অবস্থানপত্র লাগবে। পাশাপাশি অংশীজনের মতামত নিতে হবে। এখানে বেসরকারি খাত, বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং উন্নয়ন সহযোগীদের আনতে হবে। ব্যক্তি খাতের বড় ও মাঝারিদের পাশাপাশি ছোট উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মতামত নিতে হবে। শ্বেতপত্র তৈরিতে এক মাসের বেশি সময় নেওয়া উচিত হবে না।

সমকাল: নতুন সরকার আর কী করতে পারে?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: অনেক কিছুই নির্ভর করবে সরকারের মেয়াদকালের ওপর। মেয়াদকাল যাই হোক না কেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি ডাটা কমিশন করতে পারে। তথ্য-উপাত্তের ক্ষেত্রে যেসব ব্যত্যয় হয়েছে এবং ঘাটতি আছে বা যে ক্ষেত্রে নতুন প্রয়োজন দেখা দিয়েছে– সেই জায়গাটা পরিষ্কার করবে। তথ্যের উৎপাদক, ব্যবহারকারী এবং মূল্যায়নকারী– এই তিন পক্ষকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। সরকারি তথ্য-উপাত্ত সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তথ্য-উপাত্ত প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। পাশাপাশি সাংবিধানিক সুরক্ষা দিতে হবে।

সমকাল: কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : দুটি ক্ষেত্রের কথা বলব– ব্যাংকিং এবং জ্বালানি। এ দুটি অর্থনীতির ফুসফুসের মতো কাজ করে। ব্যাংকিং কমিশন তৈরি করা দরকার। কিন্তু এর পরিধি কী হবে– তা সরকারের সময়কাল ও সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করবে। যে সময় পর্যন্ত সরকার থাকবে, তার মধ্যে ব্যাংকিং খাতের রোগ নির্ণয় করার সময় পাবে নাকি পথ্য দেওয়া ও চিকিৎসা করার সময় পাবে এবং ফলাফল পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারবে– তা আমি জানি না। কিন্তু একটি কমিশন হওয়া উচিত। ব্যাংকিং খাতে তথ্য-উপাত্তের সঠিকতা যাচাই করা হবে এর প্রথম কাজ। খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে বড় কাজ। প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন পর্যাপ্ততার মতো বিষয়গুলোকে স্বচ্ছতার সঙ্গে যাচাই করতে হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে মালিকদের প্রতিনিধিত্ব এবং সময়কাল পর্যালোচনা করে বর্তমানের শিথিল অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আমানতকারীদের স্বার্থ বিঘ্নিত না করে একটি বাস্তবসম্মত ‘এক্সিট পলিসি’ করতে হবে। ঋণ অবলোপনের নিয়ম পর্যালোচনা করতে হবে। ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ হতে হবে স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে।

যেসব শক্তিশালী শিল্পগোষ্ঠী বা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী ব্যাংকের মালিকানায় রয়েছে, তাদের মালিকানার প্রশ্নটি স্বচ্ছতার সঙ্গে সুরাহা করতে হবে। এটি খুবই জটিল রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয়। করপোরেট সুশাসনে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে, যার সঙ্গে মালিকানা ও ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত। সরকারি ব্যাংক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে দিতে হবে। অভিজ্ঞ, বিজ্ঞ ও পেশাদারদের সমন্বয়ে একটা ‘ব্লু রিবন’ কমিটি করা যেতে পারে, যারা ব্যাংকে পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী নিয়োগের সুপারিশ অনুমোদন দেবে। ব্যাংকের পাশাপাশি এ ধরনের কমিটি দুদক, নির্বাচন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে হতে পারে। এতে করে রাজনৈতিক অনুগ্রহে নিয়োগের চর্চা বন্ধ হবে।
জ্বালানি খাতের জন্য একটা টাস্কফোর্স করতে হবে। ২৩ থেকে ২৪ হাজার মেগাওয়াটের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট কেন উৎপাদন করতে হচ্ছে এবং একই সঙ্গে আমদানি করতে হচ্ছে– টাস্কফোর্স তার ওপর প্রাথমিক একটা প্রতিবেদন দিতে পারে। রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও দায়মুক্তির বিষয়গুলোও সেখানে আসবে।

সমকাল: মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য নিরাপত্তা ইস্যুতে আপনার পরামর্শ কী?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সরকারের খোলাবাজারে বিক্রির ব্যবস্থা যুৎসই এবং টেকসইভাবে অব্যাহত রাখতে হবে। এর জন্য প্রথমে দরকার বর্তমানের খাদ্য মজুত পরিস্থিতি মূল্যায়ন এবং আমন সংগ্রহ অভিযান কার্যকরের পরিকল্পনা গ্রহণ। কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে হবে। খাদ্য উৎপাদনের সঠিক তথ্য প্রকাশ করতে হবে এবং ঘাটতি থাকলে আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বন্দর নিরবচ্ছিন্ন চালু রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সমকাল: সরকারের দায়দেনা পরিস্থিতি নিয়ে আপনি আগে অনেক পর্যালোচনা করেছেন। এখন কিছু বলবেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : দায়দেনা পরিস্থিতির হালনাগাদ মূল্যায়ন করতে হবে। আগের সরকার যেসব চুক্তি করেছে, কোনো অবস্থাতেই এসব অর্থায়ন আসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি যাতে না হয়, তা খেয়াল রাখতে হবে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ অন্যদের ঋণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে মনোযোগ থাকতে হবে। এদের অনেক টাকাই সামাজিক সুরক্ষার সঙ্গে জড়িত। কোনো অবস্থাতেই যাতে ভাতা বন্ধ না হয়, পরিধি সংকুচিত না হয়।

সমকাল: নতুন সরকারের কাছে জনমানুষের প্রত্যাশা কেমন বলে আপনার মনে হয়?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: নতুন সরকারের জন্য তিনটি জিনিস গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হলো– সামাজিক আকাঙ্ক্ষা, মাঠ পর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবতা ও নেতৃত্বের সক্ষমতা। এই তিন বিষয়ে নতুন সরকার কী পারবে বা পারবে না– তা সময়কালের ওপর নির্ভর করবে। সময়কাল তার কর্মপরিধি নির্দিষ্ট করবে। আর এ ধরনের আগের সরকারগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন আছে। যাই হোক, সরকারকে ন্যূনতম একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। আর প্রবলতম হলো– নতুন একটি সংবিধান রচনা করা। এ দুইয়ের মাঝে সরকারকে তো থামতে হবে। দিন পার হলেই বোঝা যাবে, কী পরিস্থিতিতে আমরা এগোচ্ছি।