Originally posted in প্রথম আলো on 14 September 2024
পোশাক খাতে বিক্ষোভ থামাতে সেই পুরোনো কৌশল
বিভিন্ন দাবি আদায়ে গাজীপুর ও সাভারের আশুলিয়ায় টানা দুই সপ্তাহের শ্রমিক বিক্ষোভে তৈরি পোশাকশিল্প বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শুরুতে শ্রমিকদের দাবিকে পাত্তা না দিয়ে উসকানিদাতা, বহিরাগত হামলাকারী ও ঝুট ব্যবসায়ীদের দায়ী করেন মালিকপক্ষের নেতারা। তারপরও পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শ্রমিকদের দাবি আংশিকভাবে মেনে নেওয়া হয়। তত দিনে শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত মাসে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি ওষুধ খাতের শ্রমিকেরা বিভিন্ন দাবি আদায়ে বিক্ষোভে নামেন। এ খাতের উদ্যোক্তারা নিজ নিজ কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে কিছু দাবি মেনে নেন। ফলে সপ্তাহখানেকের মধ্যে ওষুধ খাতের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকে। আর পোশাকশিল্পে উল্টো চিত্র। পরিস্থিতির উন্নতি না হয়ে বরং খারাপ হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সাভার-আশুলিয়া ও গাজীপুরে ৯৪টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে মালিকপক্ষ। এর বাইরে দেড় শ কারখানায় ওই দিন উৎপাদন ব্যাহত হয়।
তৈরি পোশাক খাতের চলমান অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আশুলিয়া। এখানে দেশের বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কারখানার অবস্থান। একই সঙ্গে বিজিএমইএর কয়েকজন সাবেক সভাপতি ও বিদায়ী সরকারের ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী মালিকদের কারখানাও আছে এখানে। এই মালিকেরাই মজুরিসহ অন্যান্য আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কলকাঠি নাড়েন।
পোশাকশিল্পে দুই সপ্তাহ ধরে চলমান এ অস্থিরতা নিরসন না হওয়ার জন্য মালিকপক্ষের পুরোনো কৌশলকেই দায়ী করছেন শ্রমিকনেতারা।
তাঁরা বলছেন, গত দেড় দশকে স্থানীয় মাস্তান দিয়ে ভয়ভীতি ও মারধর এবং মামলা–গ্রেপ্তার করে শ্রমিক বিক্ষোভ বা আন্দোলন দমন করেছে মালিকপক্ষ। এমনকি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সামনে নিয়ে আসা হয়। এবারও শ্রমিকদের দাবি পাশ কাটিয়ে পুরোনো কৌশলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে মালিকপক্ষ। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে সেটি সম্ভব হয়নি।
তবে পোশাকশিল্প মালিকেরা মনে করেন, বর্তমান অস্থিরতার পেছনে বড় কারণ ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় রাজনীতিকদের দ্বন্দ্ব। তাঁরাই শ্রমিকদের উসকে দিচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগের মতো ভূমিকা রাখতে না পারায় পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ বিজিএমইএর বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন নেতা আত্মগোপনে থাকায় নেতৃত্বেও কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে।
দেশের পণ্য রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক খাত থেকে আসে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে গত দুই মাসে কয়েক দফা উৎপাদন ও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয় খাতটিতে। সেই ধাক্কা কাটিয়ে না উঠতেই শুরু হয় অস্থিরতা। এতে তৈরি পোশাকের বিদেশি ক্রেতারা উদ্বিগ্ন। তারা আগামী মৌসুমের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ক্রয়াদেশ অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা।
বিক্ষোভ থামাতে পুরোনো কৌশল
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গাজীপুর, সাভার-আশুলিয়াসহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলের ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে তৎপর হয়ে ওঠেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। নতুন করে একাধিক পক্ষের প্রবেশের পাশাপাশি পুরোনোরা ঝুটের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চাইলে অস্থিরতা তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে গত ১৯ আগস্ট ঢাকা ইপিজেডের ফটক অবরুদ্ধ করে পোশাক কারখানার চাকরিতে নারী-পুরুষের সম–অধিকার দাবি করে বিক্ষোভ করেন একদল চাকরিপ্রত্যাশী।
কয়েক দিন পর আশুলিয়ার ডংলিয়ন ফ্যাশন নামের একটি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করলে অস্থিরতা তৈরি হয়। ২৭ ও ২৯ আগস্ট যথাক্রমে স্কাই লাইন ও পার্ল গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা বিভিন্ন দাবি আদায়ে রাস্তায় নামেন। ৩১ আগস্ট নাসা গ্রুপের প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক ১৫ দফা দাবিতে রাস্তা অবরোধ করেন। পরদিন নাসার শ্রমিকেরা আশপাশের কিছু কারখানায় ঢিল ছোড়েন। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে এ এলাকার ৪০টি গ্রুপের কারখানা শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে দেয়।
তারপরই মূলত বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকেরা বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়ে কর্মবিরতি শুরু করেন। তখন বহিরাগত লোকজন কারখানা ফটকে হামলা চালিয়ে শ্রমিকদের বের করে আনতে শুরু করেন। সঙ্গে চাকরিপ্রত্যাশী লোকজনের আন্দোলনও চলতে থাকে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিজিএমইএর নেতারা শুরুতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। তাতে কাজ না হলে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবির যৌথ অভিযান পরিচালনা করাতে সরকারকে রাজি করান তাঁরা। শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতায় জড়িত থাকা ও ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগে যৌথ বাহিনী সাভার ও আশুলিয়া থেকে ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
এরপর বহিরাগতদের হামলা ও চাকরিপ্রত্যাশীদের বিক্ষোভ থামলেও সাধারণ শ্রমিকেরা কর্মবিরতি চালিয়ে যান। শ্রমিকদের শান্ত করতে ৯ সেপ্টেম্বর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আশুলিয়ার কারখানা মালিক ও শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিজিএমইএর নেতারা। প্রায় ছয় ঘণ্টার বৈঠকে আশুলিয়ার শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস ২২৫ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া টিফিন বিল বাড়ানো; নারী ও পুরুষ নয়, দক্ষতার ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ এবং শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্তি বাতিল করার দাবি মেনে নেওয়া হয়। এরপরও পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বুধবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ করতে শুরু করেন মালিকেরা।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি পর্যায়ে মালিক ও শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে সাধারণ শ্রমিকদের দাবিদাওয়া পর্যালোচনা করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। শ্রমিকদের আশ্বস্ত করে তাঁদের কাজে ফেরার আহ্বান জানানো ছাড়া বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গত বছর নিম্নতম মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকার মজুরি প্রস্তাব দেন। এর বিপরীতে মালিকপক্ষ ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরির প্রস্তাব করে। প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় শ্রমিকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলনে নামেন। ওই সময় তিন সপ্তাহের আন্দোলনে চার পোশাকশ্রমিক মারা যান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে মালিকপক্ষ নতুন করে সাড়ে ১২ হাজার টাকা মজুরির প্রস্তাব দেয়, সেটিই চূড়ান্ত হয়। তারপরও আন্দোলন চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ, মামলা ও গ্রেপ্তারের পথ বেছে নেন মালিক ও সরকারপক্ষ। তখন কারখানা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ বিভিন্ন অভিযোগে শুধু গাজীপুর ও আশুলিয়ায় ৪৩টি মামলা হয়। এসব মামলায় ১১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
শ্রমিকের দাবি কতটা যৌক্তিক
বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের দাবিদাওয়া পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কারখানাভেদে ৮ দফা থেকে ২৫ দফা দাবি জানিয়েছেন শ্রমিকেরা। দাবির মধ্যে রয়েছে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি ১০-১৫ শতাংশ বৃদ্ধি, হাজিরা বোনাস ৮০০-১০০০ টাকা করা, টিফিন বিল ৫০ টাকা, দুই ঈদে ১২ দিন করে ছুটি, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ইত্যাদি। এ ছাড়া কারখানার মধ্যম সারির কিছু কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করার দাবিও রয়েছে।
আশুলিয়ার কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে প্রথম আলোর প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁদের অভিযোগ, কারখানায় গালিগালাজসহ নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন শ্রমিকেরা। সময়মতো বেতন না পাওয়ার ভোগান্তিতে পড়ছেন। আবার ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের নির্ধারিত বেতন-ভাতা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকে। দাবি নিয়ে কথা বলতে গেলে চাকরিচ্যুতির শিকার হন অনেকে।
একটি কারখানার এক শ্রমিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই মাস ধরে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে। আন্দোলনজনিত কারণে গত শনিবার সন্ধ্যা সাতটায় ছুটি চাইলে কর্মকর্তারা দুর্ব্যবহার করেন। প্রোডাকশন বোনাস, হাজিরা বোনাস, টিফিন বিলের ৩০ টাকা বৃদ্ধি এবং বার্ষিক ছুটির টাকা দেওয়াসহ কয়েকটি দাবি জানাই। কিন্তু কর্মকর্তারা জানিয়ে দেন, কোনো দাবি পূরণ করা হবে না।’
শ্রমিকনেতা বাবুল আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে শ্রমিকদের চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। শ্রমিকদের সব দাবি এক জায়গায় করে সরকার-মালিক-শ্রমিকপক্ষের ত্রিপক্ষীয় কমিটিতে আলোচনা হতে হবে। কারখানা বন্ধ কিংবা শ্রমিক ছাঁটাই করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
বিজিএমইএর নেতৃত্বে দুর্বলতা
বিজিএমইএর শীর্ষ নেতারা বরাবরই সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সুনজরে থাকেন। গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠরা সংগঠনটির সভাপতি হয়েছেন। সর্বশেষ গত মার্চের নির্বাচনে সভাপতি হন এস এম মান্নান, তিনি ঢাকা উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
সরকার পতনের আগেই দেশ ছাড়েন বিজিএমইএর সভাপতি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংগঠনটির নির্বাচনকেন্দ্রিক জোট ফোরামের নেতা-কর্মীরা সভাপতিসহ পুরো পর্ষদের পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে পদত্যাগ করেন এস এম মান্নান। নতুন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম। যদিও পর্ষদ ভেঙে দিতে ফোরামের বিভিন্ন তৎপরতায় বর্তমান পর্ষদ সদস্যদের মধ্যে অস্বস্তি কাজ করছে। সভাপতি, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতিসহ দু–চারজন ছাড়া পর্ষদের বাকিরা অনেকটাই নিষ্ক্রিয়।
বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত এক মাসে যেভাবে কাজ করেছি, কোনো বাণিজ্য সংগঠন সেভাবে করতে পারেনি। অতীতের মতোই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এবার প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। আমরা খুবই প্রগ্রেসিভ (প্রগতিশীল) চিন্তাভাবনা নিয়ে কাজ করেছি। আশা করি, দ্রুতই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে শ্রমিকদের দাবিদাওয়া উপেক্ষা ও পরে আংশিকভাবে মেনে নেওয়া মালিকপক্ষের সনাতনী প্রক্রিয়া। এভাবে সমস্যা জিইয়ে রাখা হয়। আগে আন্দোলন দমাতে শিল্প পুলিশ বড় ভূমিকা রাখত। তারা নিষ্ক্রিয় থাকায় যৌথ বাহিনীর সঙ্গে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটিও শ্রমিক অসন্তোষ দমানোর প্রক্রিয়া বলে মনে হচ্ছে।’
গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, মালিকপক্ষকে আইনি কাঠামোর মধ্যে শ্রমিকদের দাবি মানার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে কাজটি করে তারপর যৌথ ঘোষণা দিয়ে শ্রমিকদের জানাতে হবে।