Published in আমাদের সময় on Tuesday, 1 May 2018
নুন আনতে তাদের পান্তা ফুরায়
গোলাম রাব্বানী
নিত্যপণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে জীবনযাত্রার খরচ। সে তুলনায় বাড়েনি শ্রমিকের আয়। ব্যয়ের তুলনায় আয় না বাড়ায় শ্রমিককে জীবনযাত্রার মানে আপস করতে হয়। অনেক চাহিদা ছাড় দিয়ে চলতে বাধ্য হচ্ছে। এ অবস্থায় জীবনযাপনের মৌলিক চাহিদাই তারা পূরণ করতে পারছে না। ফলে বিনোদন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে শ্রমিকের অন্তর্ভুক্তি নেই বললেই চলে। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করলেও তা সাধারণভাবে জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট নয় বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে শ্রমিকদের জীবনধারণকেই কেবল গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাদের
ভবিষ্যৎ জীবন, সঞ্চয়, সন্তানদের পড়াশোনা ও স্বাস্থ্যসহ অন্য নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নেওয়া হয় না।
দেশের মোট শ্রমশক্তির ৮৫ দশমিক ১ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমশক্তি সবচেয়ে বেশি হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা যে কোনো সময় কাজ হারিয়ে তারা বেকার হয়ে যেতে পারে। ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান কমে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। দেশের শ্রমিকদের মোট পরিসংখ্যান কোনো সংগঠন বা সংস্থার কাছে নেই। নিম্নতম মজুরি বোর্ড কর্তৃক দেশে প্রায় ৪২টি খাতের শ্রমিক ও কর্মচারীদের ৪১টি খাতে ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাসিক ৫২১ ও ৭৯২ টাকা বেতনেরও চাকরি রয়েছে।
দেশের প্রচলিত শ্রম আইনে পাঁচ বছর পর পর শিল্প খাতে কর্মরত শ্রমিকের মজুরি পর্যালোচনার কথা বলা আছে। কিন্তু নির্ধারিত সময় পেরোলেও মজুরি পর্যালোচনার উদ্যোগ নেই প্রায় ১৫ খাতে।
টাইপ ফাউন্ড্রি খাতে বেতন ৫২১ টাকা, যা সর্বশেষ নির্ধারণ করা হয় ১৯৮৩ সালে। এ ছাড়া পেট্রল পাম্পের ৭৯২ টাকা মাসিক বেতন নির্ধারিত হয় ১৯৮৭ সালে। পর্যালোচনা না হওয়া আরও খাতগুলো হচ্ছে আয়ুর্বেদিক কারখানা, আয়রন ফাউন্ড্রি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, টি-গার্ডেন, সড়ক পরিবহন, ওয়েল মিলস ও ভেজিটেবল প্রোডাক্টস, প্রিন্টিং প্রেস, রি-রোলিং মিলস, সল্ট ক্রাশিং, রাইস মিল, প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ, নির্মাণ ও কাঠ, কোল্ডস্টোরেজ, শিল্প প্রতিষ্ঠানে অদক্ষ শ্রমিক।
এ ছাড়া গার্মেন্টস, গ্লাস অ্যান্ড সিলিকেটস, অটোমোবাইল কারখানা, কটন টেক্সটাইল, অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্ড এনামেল ইন্ডাস্ট্রিজ, বেকারি খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতনের পর্যালোচনা চলমান প্রক্রিয়ায় রয়েছে। নতুন করে সিকিউরিটি সার্ভিসের বেতন নির্ধারণ করার কথা বলা হচ্ছে।
দারিদ্র্যসীমার ওপরের স্তরে অবস্থানকারী প্রায় পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারে ‘জাতীয় খানা আয়-ব্যয় জরিপ’ অনুযায়ী খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা কেনার ব্যয় মাসে ৯ হাজার ২৮০ টাকা। পরিবারের প্রধান উপার্জনকারীকে এ ক্ষেত্রে আয় করতে হবে ৬ হাজার ৪৪৫ টাকা।
সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মতে কাঙ্খিত পুষ্টিহার অনুযায়ী খাবার গ্রহণ ও জীবনধারণের জন্য একজন শ্রমিকের প্রতিমাসে ন্যূনতম মজুরি প্রয়োজন ১৭ হাজার ৮৩৭ টাকা। প্রকৃত খরচ অনুযায়ী বিবাহিত একজন শ্রমিকের মাসে আয় করতে হবে ১০ হাজার ৩৫২ টাকা।
বর্তমানে শ্রমিকদের মধ্যে অধিকাংশের বেতনই ১০ হাজারের কম। দেশের মোট শ্রমিকের সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান কোনো সংগঠন বা সংস্থার কাছে নেই। তবে দেশে গার্মেন্টস খাতে মোট শ্রমিকের পরিমাণ প্রায় ৪০ লাখ। এ ছাড়া অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ খাতে ২০ লাখ, দর্জি শিল্পে ১০ লাখ, নির্মাণ খাতে ৩৫ লাখ ও ট্যানারি খাতে ২৫ হাজার শ্রমিক রয়েছে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শ্রমিকের আয় বাড়ে না। ৫ বছর অন্তর ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের কথা থাকলেও বেশিরভাগ খাতে তা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে শ্রমিকরা অনেক মৌলিক চাহিদার ছাড় দিয়ে বেঁচে আছেন।
তিনি আরও বলেন, একটি শ্রমিকের পরিবারের সন্তানরা যদি শিক্ষিত না হয়। তা হলে তারাও ভবিষ্যতে শ্রমিকের গন্ডি থেকে বের হতে পারে না। শ্রমিকদের পরিবার শ্রমিকই থাকছে।
বিদ্যমান শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, কোনো কোম্পানির মোট মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিকের পাওনা। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন এবং ১০ শতাংশ কারখানা পর্যায়ে শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে ও বাকি ১০ শতাংশ সরকারের শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেছেন, ‘বিলস্’-এর অর্থায়নে গবেষণার সময় দেখা যায় গার্মেন্টস মালিকরা যদি তাদের অর্জিত মুনাফার মাত্র ৫ শতাংশ শ্রমিককল্যাণ তহবিলে জমা দিতেন তা হলেই প্রতিবছর সেখানে ৩০০ কোটি টাকা জমা হতো। এটা অনেক পুরনো আইন হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটার কিছুই মানা হয় না।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, শ্রমশক্তির বিশাল অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক। ফলে কাজের নিশ্চয়তা, কম মজুরি, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকা, বঞ্চনার পাশাপাশি নারী-পুরুষের মধ্যে ব্যাপক মজুরি বৈষম্য আছে।
এ বিশাল অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে অনেক সময় প্রয়োজন। তবে চলমান সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ বিষয়ে উদ্যোগ রয়েছে।
দেশের উল্লেখযোগ্য ১০টি শিল্প খাতের মধ্যে পোশাকশ্রমিকের মজুরিই সবচেয়ে কম। সবচেয়ে বেশি মজুরি পায় জাহাজভাঙা শ্রমিকরা। তাদের মাসিক বেতন ১৬ হাজার টাকা। বর্তমানে ট্যানারি শ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি ১২ হাজার ৮০০ টাকা। নির্মাণশিল্প ও কাঠের কাজ করেন এমন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ৯ হাজার ৮৮২ টাকা, তেল মিলের শ্রমিকের মজুরি সর্বনিম্ন ৭ হাজার ৪২০ টাকা, সড়ক পরিবহনে ৬ হাজার ৩০০ টাকা, রি-রোলিং মিলে ৬ হাজার ১০০ টাকা, কোল্ড স্টোরেজে ৬ হাজার ৫০ টাকা, ধান ভাঙানোর চাতালে আধা দক্ষ শ্রমিকের মজুরিও এখন ৭ হাজার ১৪০ টাকা, পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন ৫ হাজার ৩০০ টাকা, গ্লাস অ্যান্ড সিলিকেটস কারখানায় ৫ হাজার ৩০০ টাকা সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারিত আছে।