Originally posted in কালের কন্ঠ on 13 February 2024
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের প্রবৃদ্ধি আমরা লক্ষ করছি। এখানে উৎপাদন বৃদ্ধি করে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে আরো অনেক কিছু করার আছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যেসব মার্কেটে যাচ্ছে, সেখানে অনেক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে। সুতরাং সেদিক থেকে আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করার সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ আগের তুলনায় বাড়ছে, তা আরো বাড়াতে হবে।
বাড়াতে গেলে যে ধরনের দক্ষতা-প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে, সেই জায়গায় আমাদের অনেক ঘাটতি রয়েছে। তবে বেশ কিছু বিদেশিও বাংলাদেশের এসব জায়গায় কাজ করছে। অন্য দিক থেকে আমরা যে দেখছি, উৎপাদনশীলতা আবার যেখানে বেড়েছে, সেসব জায়গায় শ্রম নিয়োগবিহীন একটা প্রবৃদ্ধি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সুতরাং অর্থনীতিতে যদি আরো দ্রুতভাবে প্রবৃদ্ধি না হয় তাহলে আরো শ্রম নিয়োগ বৃদ্ধি থেকে যাবে।
প্রবৃদ্ধির সঙ্গে নতুন নতুন শ্রম ও প্রযুক্তিনির্ভরতা সমন্বয় করলে অগ্রগতি হবেকর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি করতে হবে। সেদিক থেকে বাংলাদেশ রপ্তানি খাতে পোশাকশিল্পে ৮৪ শতাংশ রপ্তানি করে। রপ্তানির বৈচিত্র্যকরণ যেভাবে হওয়ার কথা উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে, শ্রম দক্ষতা বাড়িয়ে, পুঁজি দক্ষতা বাড়িয়ে, সে জায়গাটিতে আমাদের অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে; সেখানে বিনিয়োগ করতে হবে। মানসম্মত শিক্ষা, দক্ষতা, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও গবেষণায় আরো বিনিয়োগ করতে হবে।
এটাতে যেমন সরকারের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী দিক বিবেচনা করতে হবে, তেমনি বিনিয়োগ ও বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি যারা উৎপাদক-উদ্যোক্তা আছে, তাদেরও এসব জায়গায় আরো বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, পঞ্চম শিল্প বিল্পব—এগুলো আসছে, অনেক উৎপাদন দেখা যাচ্ছে যে ই-কমার্সের সঙ্গে সংযুক্ত। সুতরাং সার্ভিস সেক্টরগুলোতেও আমাদের নজর দিতে হবে। পোশাকশিল্পের মধ্যে বৈচিত্র্যকরণ আনতে হবে।
মূলত আমাদের পোশাকশিল্প তুলানির্ভর উৎপাদন। একে এখন কৃত্রিম তন্তুর বৈচিত্র্যকরণের দিকে যেতে হবে। কারণ বৈশ্বিক বাজার এখন নন-কটনের দিকে বেশি যাচ্ছে। তাই এই জায়গাগুলোতে আরো বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। বাজেট বরাদ্দও বাড়াতে হবে। অন্যদিকে আমাদের আঞ্চলিক বাজারে অনেক সুবিধা রয়েছে।
শোভন কর্মসংস্থান এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ; এবং এটা শ্রমিকদের উৎপাদনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিক বাজারের প্রেক্ষাপটেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি বেশি পণ্যের বাজারে প্রবেশের চেষ্টা করি তাহলে দেখা যাবে, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে হলেও এসব জায়গায় বেশি নজর দিতে হবে। কারণ শোভন কর্মসংস্থানের সঙ্গে উৎপাদনের একটা ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। আরেকটি বিষয়, যেটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, আমরা যে দেশগুলোর কাছে আমাদের পণ্য বিক্রি করি সেসব দেশ শোভন কর্মসংস্থানের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে। এখন এটি বাজার ধরার একটি অনুঘটক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাত্ তারা আমাদের কাছ থেকে পণ্য কিনবে না, যদি আমরা শোভন কর্মসংস্থান, শ্রমিক নিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয়ের দিকে গুরুত্বারোপ না করি। আর এ ধরনের শর্ত ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এ বিষয়গুলোকে রপ্তানি সক্ষমতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতার অংশ হিসেবেই দেখতে হবে।
শ্রম ও প্রযুক্তিনির্ভরতা সমন্বয় করলে অগ্রগতি হবেবাংলাদেশে এসডিজির সপ্তম বছর যাচ্ছে। আমাদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাও শুরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সূচক, যেমন—খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষাক্ষেত্রে অর্জন, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধিতে আমরা ইতিবাচক অবস্থানে ছিলাম। এই চলমান করোনা মহামারি এসব অর্জনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যে আমাদের যে অর্জন হয়েছিল, সেসব যে বাধাগ্রস্ত হলো, এখন সেসব কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে তা পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সাধারণত প্রান্তিক মানুষ যাতে সুফল পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এসডিজি বাস্তবায়নে আমাদের যে ধারাবাহিক অগ্রগতি ছিল, যেটি কভিডের কারণে পিছিয়ে গেছে, তা পুনরুদ্ধার করতে হবে। বৈষম্য কমিয়ে আনার বিষয়ে এসডিজিতে আমাদের সূচক ছিল ১০। মহামারিতে সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এভাবে নানা বিষয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এসডিজি বাস্তবায়নে দ্বিতীয় পর্যায় হিসেবে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরই মধ্যে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে শুরু হয়েছে এসডিজি বাস্তবায়ন। সেটি হচ্ছে প্রথম ফেজ। এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার হয়তো পুরো অর্থ জোগান দিতে পারবে না। কিন্তু অর্থ বরাদ্দ ও ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। এসডিজি বাস্তবায়নে বেসরকারি উদ্যোক্তা, জনপ্রতিনিধি, এনজিও, গণমাধ্যমসহ সব শ্রেণির ভূমিকা রয়েছে। সেটি কাজে লাগাতে হবে। এসডিজি ব্যাপক, রূপান্তরযোগ্য, সংহত এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তৈরি। এর লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের সময় নাগরিক অধিকারের প্রেক্ষাপটগুলো মাথায় রেখে পরিকল্পনা নিতে হবে। এসডিজি অর্জনের জন্য মানবাধিকার ও জেন্ডার সমতার বিষয়গুলো উপলব্ধি করা পথনির্দেশকের মতো কাজ করে। এগুলো নির্ভর করে উন্নয়নের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভারসাম্যের ওপর।
অর্থপাচারে বৈষম্য অবশ্যই বাড়ে। কয়েকটি পর্যায়ে বৈষম্য হয়। যে পরিমাণ অর্থ একজন পাচার করছে, সেটির ক্ষেত্রে পাচারকারী হয়তো ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছে অথবা কোনো দুর্নীতি করেছে। দুর্নীতি করলে সে হয়তো সাধারণ মানুষকে ঠকিয়েছে বা ঘুষ নিয়েছে। যেমন—বিদ্যুতের লাইন পেতে একজন যদি ১০০ টাকাও ঘুষ দেয়, সেটি তার আয় থেকে কমল। আর যে ঘুষ নিল তার আয় বাড়ল। এভাবেই বৈষম্যটা হয়। দুর্নীতি হচ্ছে বৈষম্যের একটি বড় উপায়। কারণ দুর্নীতি যে করছে সে সাধারণ মানুষের পকেট কাটছে। ২০১০ ও ২০১৬ সালে আমাদের বিবিএস যে খানা জরিপ করেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, আয়ের বিবেচনায় দেশের সর্বোচ্চ ৫ শতাংশে এবং সর্বনিম্ন ৫ শতাংশে অবস্থানকারীদের মধ্যে যে বৈষম্য, সেটি ২৩ গুণের জায়গায় ১২১ গুণ হয়ে গেছে। দুর্নীতিটা যখন হয়, তখন এক ধরনের বৈষম্য হয় ধনী-গরিবের মধ্যে। আর এই বৈষম্যই হলো এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণের বড় বাধা। অর্থপাচারের অভিঘাত সমাজের ওপরে বিভিন্নভাবে পড়ছে। সুতরাং সেটিকে আমাদের থামাতে হবে।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য সঠিকভাবে আমাদের এবারের বাজেটে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান—এসব ক্ষেত্রে যেসব প্রণোদনা রয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা জরুরি। সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। আর যেটি করতে হবে, সংস্কারের কাজ করতে হবে। অনেক দিন ধরেই আমাদের রাজস্ব সংস্কার করা হয় না। প্রত্যক্ষ কর আইন, শুল্ক আইন—এসব বিষয়ের আইনগুলো সংস্কার করতে হবে। অনেক দিন ধরেই আমরা এসব অর্ধেক করে রেখেছি। এসব দ্রুত সংস্কার করার বিষয়ে তাগিদ দিতে হবে। ভ্যাট আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে। নতুন বাজেটে এসব বিষয়কে চিহ্নিত করার পাশাপাশি বাস্তবায়নের একটি সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এখন অপ্রত্যক্ষ করের পরিমাণ যদি কিছুটা কমিয়ে আনা যায়, তাহলে সাধারণ মানুষ তার সুবিধা পাবে। কর আদায়ের ক্ষেত্র আরো বিস্তৃত করতে হবে। তবে সেটা করতে গিয়ে যেন সাধারণের ভোগান্তি বৃদ্ধি না পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সংস্কারগুলো করতে হবে। কম আয়ের মানুষদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য গত বাজেটে যে সুযোগ রাখা হয়েছিল, সেটি এবারও অব্যাহত রাখতে হবে। কিছু কিছু ভোগ্য পণ্য রয়েছে, সেসবের ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে আনতে হবে। তাতে কিছুটা সাশ্রয় হবে সাধারণ মানুষের। আর সর্বোচ্চ করের হার যেটি শুরুতে ৩০ শতাংশ ছিল, পরে সেটি কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছিল, আমার মনে হয় এটি আবার ৩০ শতাংশ করা উচিত। কারণ এটি ছিল অধিক আয় যাঁরা করেন তাঁদের জন্য। এ ছাড়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। শুধু বৃদ্ধি করাই নয়, এর ব্যবস্থাপনায়ও গুরুত্ব দিতে হবে। এ ছাড়া ডিজিটাল ডিভাইসসহ ইন্টারনেট খাতের ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে আনতে হবে। এসব পদক্ষেপ নিয়ে যদি তার বাস্তবায়ন সঠিকভাবে করা যায় তাহলেই আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দিকে যেতে পারব।
– মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি