Originally posted in jagonews24 on 31 August 2023
ড: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অর্থনীতিবিদ ও গণনীতি বিশ্লেষক। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ও প্রথম নির্বাহী পরিচালক। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবেও কাজ করেছেন। লিখছেন, গবেষণা করছেন রাজনৈতিক অর্থনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে।
আসন্ন নির্বাচন ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
রাজনীতিবিদরা যখন নিজেরা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে পারেন না, তখনই সব ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা যদি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে না পারা যায়, তাহলে অবধারিতভাবে ভেঙে পড়বে। তখন অন্য কারও হাতে চলে যাবে।
জাগো নিউজ: আজকের যে রাজনৈতিক সংকট তার জন্য ১/১১ এর সরকার ব্যবস্থাও দায়ী বলে মনে করা হয়। অন্তত ওই সময়ের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরাজনীতিকরণের নানা কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কী বলবেন?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: প্রধানমন্ত্রী তো নিজেই বলেন, ১/১১ তার আন্দোলনের ফসল। আমার নেত্রী তো বলেছেন ১/১১ সরকার যা করবে তার বৈধতা দেওয়া হবে সংসদে। সুতরাং, এই দায় নাগরিক সমাজের ক্ষুদ্র স্কন্ধে কেন চাপানো হয়, তা বুঝি না।
রাজনীতিবিদরা যখন নিজেরা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে পারেন না, তখনই সব ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা যদি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে না পারা যায়, তাহলে অবধারিতভাবে ভেঙে পড়বে। তখন অন্য কারও হাতে চলে যাবে।
জাগো নিউজ: এখন কী বলবেন?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এখনকার সমস্যা যদি রাজনীতিবিদরা বুঝতে চেষ্টা না করেন তাহলে সংকট আরও বাড়বে। অন্যের মতামতকে সম্মান না করে যদি চালানো হয় তাহলে সেখানে নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কিছুই থাকে না।
বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে সাধারণ মানুষ যে অর্জন করলো অনেক ক্ষেত্রেই আমরা রাজনৈতিকভাবে সমর্থন দিতে পারিনি। এটিই হচ্ছে আমাদের জন্য বড় দুঃখ। যদি আমরা এ বাস্তবতা বুঝতে না পারি তাহলে বাংলাদেশের উন্নয়ন, অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়বে।
জাগো নিউজ: যেমন?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আমরা ইতিহাস ভুলে যাই। ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি খারাপ নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু সেই খারাপ নির্বাচন একটি ভালো উদ্যোগ সামনে আনে। আমরা সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। কিন্তু বর্তমান সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তা বাতিল করে এবং সংকট থেকেই যায়। যদিও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই ওই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে তা উল্টে দেওয়া হলো। এটি বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়।
জাগো নিউজ: পঞ্চদশ সংশোধনীর রায়ে আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথাও উল্লেখ ছিল।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: একদম। শেষ বিচারে আপনাকে রাজনীতিবিদদের কাছে আসতে হবে। রাজনীতিবিদরা যদি সমাধান দিতে না পারেন, তাহলে তার দায়-দায়িত্ব অন্যের ওপর চাপানো ঠিক হবে না।
আপনি যদি পেশাজীবী, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ীদের দায়ের কথা বলতে চান, তাহলে আমি বলবো আপনারা সাংবাদিকরা কি আগের মতো দায়িত্ব পালন করতে পারছেন? আপনি রাস্তায় যা দেখছেন, তা কি লিখতে পারছেন? যা দেখছেন, তা কি টেলিভিশনের শিরোনামে প্রকাশ পাচ্ছে? বিটিভির সঙ্গে অন্য মিডিয়া হাউজগুলোর তুলনামূলক মূল্যায়ন তো আমি করতে পারি।
আমরা জাতীয়ভাবে বহু মত ধারণ করার সহ্য ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি। বহু মত ধারণ করার ক্ষমতা না থাকলে সাধারণ গরিব মানুষের অধিকার সংকুচিত হয়ে যায়। আমাদের বড় উপলব্ধি হচ্ছে বাংলাদেশের উন্নয়নের চেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণ খাপ খায়নি। এ কারণেই আগামীর উত্তরণটা অতিগুরুত্বপূর্ণ। পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো উন্নয়নের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে চাইলে রাজনৈতিক সংকটের উত্তরণ জরুরি।
জাগো নিউজ: সমাধানের আগে সংকট নিয়ে ভাবতে হয়। এ মুহূর্তে সংকট কতটুকু অনুভব করছেন?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এই মুহূর্তে সংকট তীব্র অনুভব করছি। গত দুটি নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ ঠিকমতো ভোট দিতে পারেনি। এটি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ যুবক, তাদের অনেকেই ভোট দিতে পারেননি। তাদের ভোট ছাড়াই দেশ পরিচালনা হচ্ছে। এটি তো প্রকাশ্য সত্য। আপনি প্রতিযোগিতাপূর্ণ অর্থনীতি চাইবেন, আর প্রতিযোগিতাপূর্ণ রাজনীতি চাইবেন না, তা তো হতে পারে না। এজন্য এমন একটি ব্যবস্থায় নির্বাচন হতে হবে যেখানে মানুষের আস্থা আছে। কীভাবে করবেন সেটা রাজনীতিবিদদের ব্যাপার। কিন্তু যে ব্যবস্থা ভোটদানে প্রভাবিত করবে না, নির্বাচন প্রক্রিয়া-ফলাফল প্রভাবিত করবে না, নতুন সরকার গঠন করার ক্ষেত্রেও কোনো প্রভাব রাখবে না, এমন একটি ব্যবস্থা মানুষ এখন চাইছে।
আমাদের দেশের উচ্চবিত্তরা টাকা পাচার করে বিদেশে নিয়ে গেছে। এটি তো আমরা বুঝি। এটি সাধারণ মানুষের সমস্যা নয়। এটি উচ্চবিত্তদের সমস্যা। বিদেশিদের হস্তক্ষেপ বিষয়ে যদি কেউ দায়-দায়িত্ব নেয় তাহলে উচ্চবিত্তদেরই নিতে হবে।
জাগো নিউজ: সরকার ও সরকারবিরোধীদের যে অবস্থান তাতে কি ঘটবে?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সংকট বাড়লে রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতের বাইরে চলে যায়।
জাগো নিউজ: কোন হাতে পড়তে পারে?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: কোন হাতে পড়বে এটি আমি আপনি এই মুহূর্তে বলতে পারবো না। শুধু বলবো, এমটি হলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। আমি বলবো, হোঁচট খায়। পুনঃস্থাপন করতে গেলে বিশেষ ব্যবস্থার দরকার হয়। বাংলাদেশে এ অভিজ্ঞতা আছে এবং রাজনীতিবিদরা এ বিষয়ে বিজ্ঞ। তারাও পোড় খাওয়া মানুষ। আমার প্রশ্ন হচ্ছে তারা নিজেদের স্বার্থ বোঝেন কি না? কারণ রাজনীতি তাদের হাতের বাইরে চলে গেলে কেউ ভালো থাকবেন না। এজাতীয় উপলব্ধিটা সবার আগে বুঝতে হবে।
দৃশ্যমান সংলাপ দিয়ে আসলে কিছু হয় না। পর্দার অন্তরালে যে সংলাপ হয়, সেটাই মূল আলোচনা। আমি মনে করি দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলোচনা করে তারা একটি জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছাবে।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে বিদেশিদের তৎপরতা কীভাবে লক্ষ্য করছেন?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: যে দেশ গণতান্ত্রিকভাবে দুর্বল হয় এবং বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে সেখানে বিদেশিরা খুব হস্তক্ষেপ করেন। এটি খুব পরিষ্কার। সরকার যদি গণতান্ত্রিক বৈধতা, রাজনৈতিক বৈধতা ও নৈতিক বৈধতার জায়গাটা পরিষ্কার করতো তাহলে বিদেশিরা এভাবে কথা বলতে পারত না।
আমাদের দেশের উচ্চবিত্তরা টাকা পাচার করে বিদেশে নিয়ে গেছে। এটি তো আমরা বুঝি। এটি সাধারণ মানুষের সমস্যা নয়। এটি উচ্চবিত্তদের সমস্যা। বিদেশিদের হস্তক্ষেপ বিষয়ে যদি কেউ দায়-দায়িত্ব নেয় তাহলে উচ্চবিত্তদেরই নিতে হবে।
দেশকে এ অবস্থায় তারা আনলো কেন? আমাকে কেন অপমান করা হচ্ছে বিদেশিদের এমন হস্তক্ষেপের মাধ্যমে?
দ্বিতীয়ত, শেষ বিচারে মানুষের দৃশ্যমান মনোভাবের প্রকাশ লাগবে। এর জন্য গণঅভ্যুত্থানের দরকার নেই। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করবো আর নির্বাচনে হেরে যেতে পারি এটি মানবো না, তা হতে পারে না। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে আপনাকে জনতার মতামতকে সম্মান করতেই হবে। জনতার মতামতকে বাজেয়াপ্ত করে নিজে তার দায়িত্ব নিলে রাষ্ট্রযন্ত্র টেকে না।
আমি বহুদিন সমাজতান্ত্রিক দেশে থেকে এসেছি। সেসব দেশ গণতন্ত্রের অভাবের কারণে ভেঙে গেছে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো না থাকলে কার জন্য উন্নয়ন? এ উপলব্ধিটা সবার মধ্যে জাগ্রত হোক।