সংস্কারে নিজের কর্তৃত্ব ব্যবহার করেননি অধ্যাপক ইউনূস: রেহমান সোবহান

Originally posted in প্রথম আলো on 24 August 2025

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের উচিত ছিল, কিছু নির্দিষ্ট সংস্কার এজেন্ডায় নিজের কর্তৃত্ব কাজে লাগানো। অন্তত তিনি সেগুলো বাস্তবিকভাবে শুরু করতে পারতেন এবং পরবর্তী সরকারের জন্য তা উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যেতে পারতেন।’

আন্তর্জাতিক পরিসরে অধ্যাপক ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে স্বীকৃত। ফলে সংস্কার কার্যক্রমের ক্ষেত্রে তাঁর বড় ধরনের কর্তৃত্ব ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি; তাঁর সরকারও করেনি বলে মন্তব্য করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান।

গতকাল শনিবার রাতে সমাজ গবেষণাকেন্দ্রের আয়োজনে জুম প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠিত ‘অর্থনৈতিক সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি: প্রতিশ্রুতি, প্রতিবন্ধকতা, বাস্তবতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এ কথা বলেন রেহমান সোবহান। আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সেলিম রায়হান।

রেহমান সোবহান বলেন, এই দায়িত্ব এসে পড়েছে নাগরিক সমাজের ছোট গোষ্ঠীর হাতে। ভিন্ন ভিন্ন ১০টি কমিশন থেকে আসা সংস্কার প্রস্তাব একত্র করার কঠিন চ্যালেঞ্জ নাগরিক সমাজের সামনে। এমনকি কমিশনগুলোর কার্যপরিধি ছিল না। সে কারণে সংস্কার প্রক্রিয়ায় সমন্বয় বা সংহতির অভাব দেখা গেছে; ছিল না অগ্রাধিকারের অন্তর্নিহিত ক্রম বা আদর্শিক ভিত্তি।

রেহমান সোবহান আরও বলেন, প্রতিটি কমিশনের কাজ ছিল নিজেদের খাত নিয়ে নিজেদের মতো করে ভাবনা-চিন্তা করা। এরপর তুলনামূলকভাবে ছোট এক গোষ্ঠীর ওপর এসে পড়ে বড় রাজনৈতিক কাজের দায়—১০০ রাজনৈতিক দলকে বসিয়ে সংস্কার নিয়ে সমঝোতায় আসা।

এখন একধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে কাজ হচ্ছে, যে সরকারের হাতে সম্ভবত আর ছয় মাস সময় আছে। এরপরই তারা নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে রেহমান সোবহান বলেন, এখন আলোচনাটা হওয়া উচিত—এই ছয় মাসে তারা কী করবে এবং এর ফলে কী ধরনের ফলাফল আসতে পারে।

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ছিলেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান। এশীয় প্রবৃদ্ধি ইনস্টিটিউট ও জাতিসংঘের উন্নয়ন গবেষণার সাবেক প্রধান নজরুল ইসলাম ছিলেন সঞ্চালক।

সংস্কার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ

অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে সেলিম রায়হান বলেন, সংস্কার নিয়ে ক্ষমতাবানদের আগ্রহ কম। যারা সংস্কার চায়, তাদের ক্ষমতা কম। আবার সংস্কারবিরোধী শক্তিশালী বলয় রয়েছে—ব্যাংকিং ও রাজস্ব খাতে তা দৃশ্যমান হয়েছে।

বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনৈতিক সংস্কারের বড় আশা তৈরি হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন সেলিম রায়হান। কিন্তু সফলতার পরিস্থিতি ভঙ্গুর। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংস্কার হয়েছে ব্যাংকিং খাতে। সেই সঙ্গে পরবর্তীকালে এসব কার্যক্রম চলমান থাকবে কি না, তা নিশ্চিত নয়।

ভবিষ্যতের করণীয় নিয়ে সেলিম রায়হান বলেন, বিগত সময়ে রাষ্ট্রীয় স্বকীয়তা কমে এসেছিল স্বজনতোষী পুঁজিবাদের কারণে। ক্ষমতাবান ব্যবসায়ী ও আমলারা ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে এসেছিলেন। তাই ভবিষ্যতে সংস্কার বাস্তবায়ন করতে রাষ্ট্রের স্বকীয়তা (স্টেট অটোনমি) বাড়াতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের বিষয়ে আগ্রহী হতে হবে। আমলাতন্ত্রকে পেশাদারভাবে তৈরি করতে হবে।

সংস্কারের বাস্তব চ্যালেঞ্জ

সংস্কার শব্দটির মধ্যে অনেক কিছু চাপা পড়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন পিপিআরসির নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, কী করা যাবে আর কী করা যাবে না, তা আমলারা নির্ধারণ করছেন। গোষ্ঠী শাসন (অলিগার্কি) থেকেও এখনকার বড় বিষয় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের মধ্যকার যোগসূত্র (নেক্সাস); এর সঙ্গে সুশীল সমাজও যুক্ত।

হোসেন জিল্লুর রহমান আরও বলেন, আমাদের ভবিষ্যৎ থমকে আছে দক্ষ মানবসম্পদ, প্রবৃদ্ধির নতুন চালিকাশক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির মধ্যে। আমাদের দেশ সামনে এগিয়ে যাবে, তবে কোন গতিতে এগোবে, তা এসবের ওপর নির্ভর করছে।

অর্থনৈতিক সূচকের উন্নতিকে সংস্কার বলে না, এটা সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা মাত্র। এর মাধ্যমে হয়তো রিজার্ভ বাড়ে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের সাবেক গবেষণা পরিচালক রুশিদান ইসলাম রহমান এ কথা বলেন। তিনি মনে করেন, সংস্কার বলতে সামগ্রিকভাবে বৈষম্য হ্রাস ও কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি বোঝায়; না হলে তা পুরোপুরি সংস্কার বলা যাবে না।

কিন্তু গত এক বছরে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান কিংবা মজুরি বাড়েনি। তাই সংস্কার করতে হলে কৃষি ও শিল্পের মতো খাতভিত্তিক সংস্কার করতে হবে বলে মনে করেন রুশিদান ইসলাম রহমান।

আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর চেয়ারম্যান এম এম আকাশ বলেন, সংস্কার নিয়ে জোরালো পদক্ষেপ নেই। বর্তমান পদক্ষেপগুলো চলমান থাকবে কি না, সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে। আমলা ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ক্ষমতাবানদের মধ্যে একধরনের বোঝাপড়া আছে।

বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হিসেবে এম এম আকাশ মনে করেন, শিক্ষায় গুরুত্ব না দেওয়া। তবে আগামী নির্বাচন ঠিকঠাক করতে পারলে সংস্কার ভবিষ্যৎ পথ দেখতে পাবে।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিশ্বব্যাংক ও আইএফসির সাবেক কর্মকর্তা সৈয়দ আখতার মাহমুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল প্রমুখ।