গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ কাঠামো বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় যে দ্বিতীয় কমিশনটি গঠন করেছে, সম্প্রতি প্রকাশিত তার কিছু সুপারিশ এ বিষয়ে আমাকে লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে। যেহেতু প্রচারমাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তাই এ বিষয়ে আমার ভাবনা তুলে ধরা প্রয়োজনীয় মনে করছি।
জননীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন কমিশন :কমিশন ইতিমধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের নূ্যনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা উচিত বলে সুপারিশ করেছে। এ ধারণা কমিশনকে এই সুপারিশ করতে উদ্বুদ্ধ করছে যে, সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে শিল্প ব্যাংকের কাছাকাছি কোনো আইনি কাঠামোয় এনে গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করুক। এই নতুন কাঠামোয় গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ার থাকবে, যা ৫১ শতাংশের কম হবে না।
কমিশনের এই প্রস্তাব রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় সরকারের শেয়ার কমিয়ে আনার বর্তমান ও বিগত সরকারগুলোর দীর্ঘস্থায়ী প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বর্তমান অর্থমন্ত্রী নিজেই কয়েক বছর আগে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোকে তাদের শেয়ারের অংশবিশেষ বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে না দিলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন বলে শাসিয়েছিলেন।
এখন গ্রামীণ ব্যাংকের মতো একটি সুশাসিত প্রতিষ্ঠানে, যার প্রশাসনে সরকারের কোনো রকম ভূমিকাই নেই, সরকারের মালিকানা প্রসারিত করার চেষ্টা একটি বিপথগামী পদক্ষেপ বললে কমই বলা হবে। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের মতো একটি দুর্ভাগা ও দেউলিয়া প্রতিষ্ঠানের কাঠামোকে গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য অনুসরণীয় মডেল হিসেবে উপস্থাপন বিশেষভাবে দুর্ভাগ্যজনক মনে হচ্ছে।
গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন মালিকানার ইস্যু ছাড়িয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা/সদস্যরা কীভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন এ বিষয়েও মত দিতে শুরু করেছেন। সারাবিশ্বে এমনকি বাংলাদেশেও লাখ লাখ শেয়ারহোল্ডার নিয়ে অনেক কোম্পানি পরিচালিত হচ্ছে। এসব কোম্পানিকে বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠান বা শেয়ারহোল্ডারদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য তাদের লাখ লাখ শেয়ারহোল্ডারকে জমায়েত করার প্রয়োজন হয় না এবং গ্রামীণ ব্যাংকের মতো তারাও এর সমাধানের উপায় বের করেছে।
এ ব্যবস্থা নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের মহিলা শেয়ারহোল্ডাররা কখনও আপত্তি তোলেননি এবং গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায়ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেনি। যে কমিশনের সদস্যদের কোনো বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে_ কোনো ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান তো দূরের কথা, তাদের পক্ষে একটি সুশাসিত প্রতিষ্ঠানের কাঠামো পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত প্রস্তাব নিয়ে আসাটা বিপথগামী অনুকরণপ্রবণতা ও কাণ্ডজ্ঞানহীন অগ্রাধিকারের আরেকটি উদাহরণ ছাড়া আর কিছু নয়।
বোর্ড সদস্যদের শিক্ষিত করা প্রসঙ্গে :বোর্ড সদস্যদের জন্য একটি নির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা মানদণ্ড হিসেবে নির্ধারণের জন্য কমিশনের প্রস্তাব থেকে বোঝা যায়, যে প্রতিষ্ঠানটি পর্যালোচনা করতে কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার পটভূমি ও প্রকৃতি সম্পর্কে তারা কতটা অজ্ঞ। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল, যেমনটি এর প্রতিষ্ঠাতা নোবেলবিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস ভেবেছিলেন, এটি নিশ্চিত করা যে ব্যাংকটি যাদের সেবা দেওয়ার জন্য তৈরি তারাই এর মালিক হবে এবং এর ব্যবস্থাপনা দেখাশোনা করবে।
এই বৈশিষ্ট্যটিই গ্রামীণ ব্যাংককে বাংলাদেশের হাজারো ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনন্য করে তুলেছে এবং সারাবিশ্বে একে ছড়িয়ে দিয়েছে। মহিলা ঋণগ্রহীতাদের মালিকানার ধারণাটি তাদের ক্ষমতায়নের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরই সেবা প্রদানের জন্য তৈরি প্রতিষ্ঠানটির কাজকর্ম দেখাশোনার দায়িত্ব তাদের হাতে দেওয়ার উদ্দেশ্যে চিন্তা করা হয়েছিল।
সংসদ সদস্যপদের জন্য, একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য, যাদের আইন তৈরি করতে হয় এবং দেশ পরিচালনার জন্য অত্যন্ত জটিল চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়, তাদের যদি কোনো শিক্ষাগত মানদণ্ডের প্রয়োজন না হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের একজন বোর্ড সদস্য হওয়ার জন্য কেন শিক্ষাগত মানদণ্ডের প্রয়োজন হবে?
এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, গ্রামীণ ব্যাংকের অল্পশিক্ষিত মহিলা বোর্ড সদস্যরা গত তিন দশকে তাদের দায়িত্ব পালনে অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যে কোনো নিরপেক্ষ মূল্যায়নে গ্রামীণ ব্যাংক কেবল দেশের মধ্যেই নয়, পৃথিবীর অধিকাংশ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কর্মদক্ষতায় শ্রেষ্ঠতর, বাংলাদেশের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংকের তুলনায় তো বটেই। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার কিছু প্রমাণ নিচে দেওয়া হলো :
গ্রামীণ ব্যাংকের আদায়যোগ্য ঋণের আকার ১৯৮৩ সালের ৩৩ কোটি থেকে বেড়ে মার্চ ২০১৩-এ হয়েছে ৮ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা।
গ্রামীণ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের শতকরা হার এ সময়ে ১-৩ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে, যা সরকারি-বেসরকারি যে কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের, যেগুলো তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ পরিচালকদের দ্বারা চালিত, তুলনায় উৎকৃষ্ট। এই উচ্চ আদায় হার গ্রামীণ ব্যাংককে তার ঋণ কার্যক্রম ক্রমাগতভাবে সম্প্র্রসারিত করতে সক্ষম করেছে_ যার ফলে ব্যাংকের সদস্যসংখ্যা ১৯৮৩ সালে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার সময়ে ৫৮ হাজার ৩২০ জন থেকে ২০১২ সালের শেষে হয়েছে ৮৪ লাখ। গ্রাহক সংখার এরকম বিপুল বৃদ্ধি এবং একই সঙ্গে গুণগত মান সর্বোচ্চ রাখার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল।
গ্রামীণ ব্যাংকের উচ্চমানের আর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানটিকে আর্থিক স্বয়ম্ভরতা অর্জনে এবং রাষ্ট্রীয় বা দাতা সংস্থার ওপর নির্ভরতা ছাড়াই এর ঋণ কার্যক্রম সম্প্র্রসারণে সক্ষম করেছে।
সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষিত পরিচালক ও পরিচালনাগত ব্যর্থতা : গ্রামীণ ব্যাংকের অর্জন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চারটি ব্যাংকের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যেতে পারে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পরিষদে স্বাভাবিকভাবেই ‘শিক্ষিত’ সদস্যরা রয়েছেন। এই ব্যাংকগুলোর সঙ্গে জড়িত অসংখ্য দুর্নাম, দুর্নীতি ও কুকর্ম এই সাক্ষ্য বহন করে যে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষা কোনো যোগ্যতা নয়। এ ব্যাংকগুলো বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে এসেছে। ফলে এই ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষা করতে বিভিন্ন সময়ে সরকারকে জনগণের টাকা খরচ করতে হয়েছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি সংসদে প্রদত্ত অর্থমন্ত্রীর বিবরণ অনুযায়ী, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২ পর্যন্ত ৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধনী লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। এটি ব্যাংকগুলোর ঋণদান কার্যক্রমকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং ভবিষ্যতেও এই ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে আরও সরকারি সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে। সর্বশেষ বাজেটেও অর্থমন্ত্রী আর্থিকভাবে দুর্বল এই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক পুনর্গঠনে করদাতাদের ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হিসেবে রেখেছেন।
সর্বশেষ এবং সবচেয়ে মর্মান্তিক দুর্নীতিটি ঘটেছে সোনালী ব্যাংককে নিয়ে, যা দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবং সম্ভবত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যেও সর্ববৃহৎ। ব্যাংকটিতে বিপুল পরিমাণে ঋণ খেলাপি ঘটেছে এবং এতে আরও পুঁজি সরবরাহ করতে হবে। অর্থমন্ত্রী ভালো করতেন যদি তিনি এই ব্যাংকটির জন্য একটি তদন্ত কমিশন গঠন করতেন, যা শুধু ব্যাংকটির পারফরম্যান্স নয়, এর পরিচালকদের দায়িত্বে অবহেলাজনিত ভূমিকাও তদন্ত করে দেখত। এই কমিশন অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে এটাও তদন্ত করে দেখত, সোনালী ব্যাংকের একটিমাত্র শাখা যখন একজনকে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল, তখন ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ ঘুমিয়েছিল কি-না। সোনালী ব্যাংকের পরিচালকদের শিক্ষাগত, পেশাগত, রাজনৈতিক বা নৈতিক যোগ্যতা তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য উপযুক্ত ছিল কি-না তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
সহজ বুদ্ধিই বলে দেয় যে সরকার তার পূর্ণ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে খারাপ করছে এবং সরকারের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে, সেগুলো তদন্ত করার জন্য জরুরিভাবে তদন্ত কমিশন গঠন করবে। সরকার কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোই নয়, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, রেলওয়ে বোর্ড, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর, নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং যে কোনো সংখ্যক মন্ত্রণালয় বা সরকারি বিভাগ যাদের পারফরম্যান্স লক্ষণীয়ভাবে ও ক্রমাগতভাবে দুর্বল, তাদের নিয়ে তদন্ত শুরু করতে পারে। সেটাই হওয়া উচিত ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
সঠিক অগ্রাধিকার :সরকারের দায়িত্বাধীন বিভিন্ন সরকারি খাত ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাসগুলোর গুরুতর সমস্যার প্রেক্ষাপটে সুপরিচালিত ও বিশ্বব্যাপী দক্ষতার জন্য সুপরিচিত একটি প্রতিষ্ঠানের, যেখানে সরকারের মালিকানা মাত্র ৩ শতাংশ, পরিচালনা নিয়ে অতি আগ্রহ সম্পূর্ণ যুক্তিবিবর্জিত। সরকার কী কারণে অন্য সব সরকারি ব্যাংক এবং ভগ্নপ্রায় প্রতিষ্ঠান ছেড়ে গ্রামীণ ব্যাংক তদন্ত করতে গেল তার ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত।
সরকার কেবল গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর অপসারণ ও তার প্রতিস্থাপনের সঙ্গেই যুক্ত হননি, এর কার্যাবলি পরীক্ষার জন্য দুটি কমিশন-কমিটিও তৈরি করেছে। সর্বশেষ কমিশন গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের কাঠামো পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বোর্ডে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণী-সদস্যদের প্রতিনিধিত্ব সংকুচিত করার সুপারিশের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের লাখ লাখ মালিকদের, যাদের অধিকাংশই মহিলা, ক্ষমতাহীন করার চেষ্টা করছে।
এ ধরনের চেষ্টা কেবল অন্যায় ও অগণতান্ত্রিকই নয়, রাজনৈতিকভাবেও অদূরদর্শী, যেহেতু এই মহিলারা ভোটারও বটে।
অধিকন্তু এটি দরিদ্র ও মহিলাদের ক্ষমতায়নে জাতিসংঘের কাছে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসারও ইঙ্গিত বহন করতে পারে।
একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান এবং একজন মাত্র ব্যক্তিকে নিয়ে, যিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের সবচেয়ে খ্যাতিসম্পন্ন ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের একজন, সরকারের এই বাড়াবাড়ি, বিশেষ করে সরকারের ক্ষমতার শেষ মাসগুলোয়, সরকারের দুর্বল বিবেচনার পরিচয় বহন করে।
সরকার তার ক্ষমতার শেষ মাসগুলোয় রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে হানিকর এবং অর্থনৈতিকভাবে লোকসানমূলক অপশাসিত প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তদন্ত শুরু করে সরকারি ক্রিয়াকর্মে তার অগ্রাধিকার-জ্ঞান প্রদর্শন করতে পারত। এতে বোঝা যেত যে, সরকার এই গুরুতর সমস্যাগুলোর বিষয়ে অবহিত এবং সরকারের মেয়াদকালের অবশিষ্ট অংশে কিছু প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
রেহমান সোবহান : চেয়ারম্যান, সিপিডি