Originally posted in সমকাল on 6 June 2021
পেনশনের বরাদ্দ কেন সামাজিক নিরাপত্তায়
বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তায় মোট বরাদ্দ ১ লাখ ৭৬১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে পেনশনে বরাদ্দ ২৬ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা
আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে মোট বরাদ্দের ২৫ শতাংশই সরকারি চাকরিজীবী ও তাদের পরিবারের পেনশন বাবদ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্রের সুদের জন্য বড় অঙ্কের বরাদ্দ সামাজিক নিরাপত্তা হিসেবে দেখানো হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সরকারি কর্মী ও সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের যে সুবিধা দেওয়া হয়, সেটা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় রাখা উচিত নয়। কারণ, এ দুটি খাতের সুবিধাভোগীদের অধিকাংশই সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও সচ্ছল ব্যক্তি। সামাজিক নিরাপত্তা হচ্ছে রাষ্ট্রের এমন কর্মকাণ্ড, যা সমাজের দরিদ্র ও ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হবে। পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবনমান উন্নয়ন হবে। কিন্তু এ দুই খাতের মাধ্যমে সে উদ্দেশ্য কতটুকু পূরণ হয়, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বাজেটে বরাদ্দের এই ধারা বছরের পর বছর ধরেই চলে আসছে।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দ বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২০টি কর্মসূচিতে এক লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যা জিডিপির ৩ দশমিক ১১ শতাংশ। এর মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী ও তাদের পরিবারের পেনশন বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৬ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা, যা মোট সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দের ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ মোট বরাদ্দের চার ভাগের এক ভাগই এ খাতে ব্যয় করা হবে। এ বরাদ্দ থেকে ৭ লাখ ৫৩ হাজার মানুষ সুবিধা পাবেন। বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে পেনশনে ২৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। সুবিধাভোগীর সংখ্যা ছিলেন ৬ লাখ ৩০ হাজার জন।
সঞ্চয়পত্রের সুদের হারে সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম হিসেবে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। যা চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল বাজেট বরাদ্দের তুলনায় ২৮৪ কোটি ও সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৯৩ কোটি টাকা বেশি। আগামী অর্থবছরে ৬১ লাখ ৬০ হাজার মানুষ এ সুবিধা পাবেন বলে এবারের বাজেটে প্রাক্কলন করা হয়েছে। কয়েক বছর ধরে সঞ্চয়পত্রের সুদহারে সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম হিসেবে বাড়তি একটা অংশ যোগ করে মোট সুদহার নির্ধারণ করে সরকার। সামাজিক প্রিমিয়ামের মুনাফার অংশ সামাজিক নিরাপত্তার বরাদ্দের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। চলতি অর্থবছরে এ বাবদ ৬ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা আছে। যদিও বাজেটের প্রাক্কলনের চেয়ে এ খাতে ব্যয় বেশি হচ্ছে। সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষ অনেক বেশি। অনেকে দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। ফলে সামাজিক নিরাপত্তা বলতে দরিদ্র ও ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা ও উন্নয়নে নেওয়া কর্মসূচিই হওয়া উচিত। পেনশন বা সঞ্চয়পত্রের সুদে দেওয়া প্রিমিয়ামকে সামাজিক সুরক্ষা বলা যথার্থ নয়।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পেনশন বাবদ বরাদ্দ যুক্ত করেই সামাজিক নিরাপত্তার মোট বরাদ্দ জিডিপির ৩ শতাংশ বা তার কিছু বেশি দেখানো হয়। কিন্তু এটা আলাদা করা উচিত। যাতে বোঝা যায় দরিদ্র ও ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ বরাদ্দ থাকছে। পেনশন ছাড়াও সঞ্চয়পত্রের সুদহারের প্রিমিয়াসহ কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো সামাজিক নিরাপত্তার বরাদ্দের আওতার বাইরে রাখা উচিত।
তিনি বলেন, দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। অনেকে কাজ হারিয়েছেন। এ বিবেচনায় সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ আরও বাড়ানো দরকার ছিল। সরকার জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল নিয়েছে। সেখানে সামাজিক নিরাপত্তা থেকে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমে যাওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। সে বিষয়ে এ অর্থবছরে উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু বাজেটে সেরকম কিছু নেই। সামগ্রিকভাবে বলতে হবে সামাজিক নিরাপত্তার কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়নি। সংস্কার উদ্যোগও দেখা যায়নি। আবার চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম।
২০১৫ সালে সরকার জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়ন করেছে। কৌশলের মূল উদ্দেশ্য দেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করতে সব উপযুক্ত নাগরিককে বিশেষ করে দরিদ্র ও ঝুঁকিগ্রস্ত নাগরিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। নীতিমালায় সব নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। একজন মানুষের জীবনকালের সব পর্যায়েই (শিশু থেকে বৃদ্ধ) এ সহায়তা নিশ্চিত করতে চায় সরকার। জীবনের প্রতিটি পর্যায়েই ঝুঁকি মোকাবিলায় সামাজিক সুরক্ষা থাকবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের উদ্দেশ্য অবশ্যই মহৎ। কিন্তু এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যে ধরনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি দরকার, তা এখনও আসেনি। ফলে এখন সমাজের দরিদ্র ও ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে সবার আগে সহায়তা করতে হবে।
বিশ্নেষকরা বলছেন, কৃষি ভর্তুকি, কৃষি পুনর্বাসন, পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনকে তহবিল, করোনার প্রভাব মোকাবিলায় এমএসএমই খাতে দেওয়া ঋণের সুদ ভর্তুকির বরাদ্দ সামাজিক নিরাপত্তায় দেখানোও যৌক্তিক নয়। এগুলো অন্যান্য হিসেবেও তুলে ধরা হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, অবসরপ্রাপ্তদের পেনশন সামাজিক সুরক্ষার আওতাভুক্ত করার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি আছে। অনেকে বলছেন এটা সামাজিক সুরক্ষার মধ্যে পড়ে না। কারণ সরকারি চাকুরেদের অবস্থা অন্যদের তুলনায় ভালো। আবার বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত মানুষের জীবনযাপনের জন্য বিকল্প কিছু নেই। অন্যদিকে গ্রামের বয়স্ক নাগরিকদের জন্য বয়স্কভাতা থাকলেও, শহরের বয়স্ক নাগরিকদের জন্য সরকারের বিশেষ কোনো কর্মসূচি নেই। এজন্য সঞ্চয়পত্রের সুদহারে সামাজিক নিরাপত্তা বাবদ একটা প্রিমিয়াম যোগ করা হয়েছে।