Published in বণিক বার্তা on Saturday 6 May 2017
বসে থাকলেও বাড়ছে স্পিনিং মিলের সংখ্যা
দেশে এখন স্পিনিং মিলের সংখ্যা চারশর বেশি। এর মধ্যে গ্যাস সংকটসহ নানা কারণে উৎপাদনে নেই ৭৪টি মিল। তা সত্ত্বেও এ খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে চলেছেন ব্যবসায়ীরা। একের পর এক স্থাপন হচ্ছে নতুন নতুন ইউনিট।
গত কয়েক বছরে দেশের বস্ত্র খাতের স্পিনিং মিলগুলোকে বড় ধরনের গ্যাস সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে। খাত-সংশ্লিষ্টরাও গ্যাস সংকটের কথা স্বীকার করেছেন। ক্যাপটিভ পাওয়ারে গ্যাস সংযোগ না দেয়ায় ২০১৫ সালের শেষ ভাগে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় প্রায় ২৫টি মিল। আবার অনেক মিলে বিদ্যমান গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। পাশাপাশি কয়েক দফায় বেড়েছে গ্যাসের দাম। এ অবস্থায় উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যায় বেশকিছু কারখানায়। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে উৎপাদন বন্ধ (নন-অপারেশনাল) মিলের সংখ্যা ছিল ৭৪। কিন্তু এ পরিস্থিতির মধ্যেও ২০১৬ সালে নতুন করে ১১টি স্পিনিং মিল স্থাপন হয়েছে বলে জানায় সংগঠনটি।
বস্ত্র খাতের স্পিনিং মিলের এমন বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিল্প বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দেশের স্পিনিং মিলগুলোয় তুলার মতোই প্রয়োজনীয় একটি কাঁচামাল হলো গ্যাস। গ্যাস সংকটে বিদ্যমান কারখানাগুলোর উৎপাদন সামর্থ্যের ৩০-৩৫ শতাংশই অব্যবহূত থাকে। আবার গ্যাসের দামও বেড়েছে কয়েক দফা। এর প্রভাবে অনেক কারখানা বসে পড়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে স্পিনিং খাতে নতুন বিনিয়োগকে নজরদারির মধ্যে রাখা প্রয়োজন। শিল্প রুগ্ণ হওয়ার প্রবণতা রোধ করতেই স্পিনিং খাতের উদ্যোক্তাদের সচেতন হওয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, স্পিনিং খাতের চাহিদা এখনো আছে। একটি মিল স্থাপন করতে গেলে চার-পাঁচ বছর সময় লাগে। এখন যে প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ করছে, সেগুলোর পরিকল্পনা করার সময় গ্যাসের সংকট এতটা প্রকট ছিল না। তবে বর্তমানে যারা বিনিয়োগ পরিকল্পনা গ্রহণ করছে, তাদেরকে গ্যাস ও অবকাঠামোর মতো বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। স্পিনিং খাতে অনেক বড় ধরনের পুঁজি প্রয়োজন পড়ে। এ কারণেই আগ্রহী উদ্যোক্তাদের গ্যাস সংযোগ, সরবরাহের সঠিক সময় ও দামের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যত্ বিনিয়োগ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিটিএমএর তথ্যমতে, ১৯৮৫ সালে ২১টি মিল দিয়ে শুরু হলেও ২০০০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১২০। এর পর ২০১০ সাল নাগাদ স্পিনিং মিলের সংখ্যা ছিল ৩৬১। ২০১৬ সাল শেষে মিলের সংখ্যা হয়েছে ৪২৪। এ হিসাবে এক দশকে মিলের সংখ্যা বেড়েছে ১৭ শতাংশ।
১৯৮৫ সালে স্পিনিং খাতের স্পিন্ডল সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ১১ হাজার ৮৪। ২০০০ সালে স্পিন্ডল সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ লাখ ৫৬ হাজার ২০০। ২০১০ সালে স্পিন্ডল সংখ্যা বেড়ে হয় ৮৪ লাখ ৩৮ হাজার ৮৭৫। ২০১৬ সাল শেষে তা আরো বেড়ে ১ কোটি ১৬ লাখ ৫০ হাজারে উন্নীত হয়। এ হিসাবে গত এক দশকে স্পিন্ডল সক্ষমতা বেড়েছে ৩৮ শতাংশ।
বিটিএমএ-সংশ্লিষ্টদের দাবি, বর্তমানে সংগঠনের সদস্য স্পিনিং মিলগুলো বার্ষিক ২৪১ কোটি কেজি সুতা উৎপাদনের সামর্থ্য রাখে। খুব কম সংখ্যক মিল আছে, যারা কৃত্রিম সুতা উৎপাদনে মনোনিবেশ করতে শুরু করেছে। বিশ্ব ও স্থানীয় চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই স্পিনিং খাতের বিনিয়োগ বাড়ছে। বর্তমানে এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা, যার সিংহভাগই শুধু স্পিনিং মিলের বিনিয়োগ।
বিটিএমএ সহসভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের পোশাক খাতের নিট পোশাকের চাহিদার ৯০ শতাংশ সুতা বিটিএমএ সদস্যরা সরবরাহের সক্ষমতা রাখে। অর্থাত্ চাহিদার ১০ শতাংশ সরবরাহ সক্ষমতা এখনো বৃদ্ধির সুযোগ আছে। রফতানি চাহিদাকে লক্ষ্য করে সংকটের মধ্যেই বিনিয়োগ বৃদ্ধি করছেন স্পিনিং খাতের উদ্যোক্তারা। আবার এর পাশাপাশি স্থানীয় চাহিদাও আছে। সব মিলিয়ে স্পিনিং খাতের বর্তমান বিনিয়োগকে অতিরিক্ত বলা যাবে না।
বিটিএমএ নেতারা এ খাতে বিনিয়োগ খুব একটা বাড়েনি বললেও বাস্তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশকিছু নতুন বিনিয়োগ এসেছে দেশের স্পিনিং খাতে।
ম্যাকসন গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ম্যাকসন স্পিনিং মিলে ২০১৬ সালের ৩০ এপ্রিল নতুন ইউনিটের কার্যক্রম চালু হয়। বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানির মাধ্যমে নতুন ইউনিট স্থাপনের ফলে প্রতিষ্ঠানটির দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা ২২ হাজার কেজি থেকে বেড়ে ৫০ হাজার কেজিতে উন্নীত হয়। এ ইউনিট স্থাপনের পূর্বে প্রতিষ্ঠানটির স্পিন্ডল সংখ্যা ছিল ৫২ হাজার ৮০০টি, যা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৭ হাজার ৮০০টিতে।
মালেক স্পিনিং মিলেও সংস্কার, সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের (বিএমআরই) পাশাপাশি সাবসিডিয়ারির সক্ষমতা বাড়াতে মোট ১৭৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। পর্ষদে অনুমোদন পাওয়া ২০১৬ সালের বিএমআরই প্রস্তাব-১-এর আওতায় ৩২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হবে কারখানার স্থাপনা সংস্কার ও যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনে। এতে পণ্যের মানের এরপর পাশাপাশি উৎপাদন সক্ষমতাও বাড়বে।
উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি করছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের মতিন স্পিনিং মিলসও। এর জন্য প্রতিষ্ঠানটির ১৫১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ব্যয় হবে। কোম্পানিটি জানায়, সিনথেটিক ইয়ার্ন ইউনিটের উৎপাদন দৈনিক সাত টন থেকে ১৬ টন পর্যন্ত বাড়ানো হবে। এর জন্য কোম্পানিটির মোট ব্যয় হবে ১৫১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৮৬ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ২০ মিলিয়ন ডলার এইচএসবিসি ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নেয়া হবে। বাকি ৬৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা কোম্পানির নিজস্ব অর্থায়ন থেকে আসবে।
মোজাফফর হোসেন স্পিনিং ১৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন ইউনিট করতে যাচ্ছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি মোজাফ্ফর হোসেন স্পিনিং মিলস লিমিটেড। নতুন এ ইউনিট করার জন্য ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে কোম্পানি। এ ঋণ অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিআইডিএ)। বর্তমানে কোম্পানিটি ২০ কাউন্ট সুতা তৈরি করে। নতুন এ ইউনিটের মাধ্যমে ১০০ কাউন্ট পর্যন্ত সুতা তৈরি করতে পারবে। নতুন এ ইউনিট হবে ৪০ হাজার স্পিন্ডলের। উল্লেখ্য, কাউন্ট হলো মোটা ও চিকন সুতা পরিমাপক।
বিটিএমএ সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে বস্ত্র খাতের মূলধনি যন্ত্রের আমদানি। ২০১০-১১ থেকে ২০১৪-১৫ পর্যন্ত পাঁচ অর্থবছরে যথাক্রমে টেক্সটাইল মেশিনারির আমদানি হয় ৪ হাজার ৬০০, ৪ হাজার ৯১২, ৪ হাজার ৯৮৩, ৫ হাজার ৬৩ ও ৭ হাজার ১১৯ কোটি টাকার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রের আমদানি হয় ৮ হাজার ৩২২ কোটি ১২ লাখ ৬৬ হাজার ৪৭০ টাকার। এ হিসাবে ২০১০-১১ সালের তুলনায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রের আমদানি বাবদ ব্যয় বেড়েছে ৮০ শতাংশ। গ্যাস সংকটের সুরাহা না হলে এসব বিনিয়োগ অপবিনিয়োগে রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এ খাতের উদ্যোক্তা ও শিল্প বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে বস্ত্র পরিদপ্তরের পরিচালক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, স্পিনিং মিলে তৈরি সুতার চাহিদা অনেক ব্যাপক। সংকটের মধ্যেও বিনিয়োগ বাড়ছে মূলত বাজার চাহিদার কারণেই। গ্যাসের নিরবচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করতে পারলেই এ খাতের বিনিয়োগ কোনো সমস্যার মধ্যে পড়বে না। স্পিনিং খাতে আরো কিছু বিনিয়োগের সুযোগ এখনো আছে বলে আমি মনে করি।