স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ টেকসই করতে করণীয় – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in বণিকবার্তা on 26 March 2021

বাংলাদেশ এ বছর পঞ্চাশ বছরে পা রেখেছে। দেশজুড়ে চলছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন। ঐতিহাসিক এ বছরে উন্নয়ন পথরেখায় আমাদের দেশ আরেকটি মাইলফলক ছুঁয়েছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসার যোগ্যতা অর্জন করেছে।

চলতি বছরের ২২-২৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপির) পর্যালোচনা বৈঠকে বাংলাদেশ এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে। এলডিসি গ্রুপ থেকে আমাদের দেশ আবারো তিনটি মানদণ্ড পরিপূরণে সমর্থ হয়েছে। ওই তিনটি মানদণ্ড হলো মাথাপিছু জাতীয় আয় (জিএনআই), মানবসম্পদ সূচক (এইচএআই) এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক (ইভিআই)। এখন সবকিছু ভালোভাবে চললে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের গ্রুপ থেকে বেরিয়ে আসবে।

এর আগে ২০১৮ সালের মার্চে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো তিনটি মানদণ্ড পূরণ করেছে। বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেটি সবগুলো মানদণ্ড পরিপূরণে সমর্থ হয়েছে।

উত্তরণের জন্য চূড়ান্তভাবে সুপারিশ পাওয়ার জন্য কোনো স্বল্পোন্নত দেশকে পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় ওই তিনটি সূচকের যেকোনো দুটিতে নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করতে হয়। অথবা মাথাপিছু জাতীয় আয় সীমারেখার দ্বিগুণ হতে হয়। তখন তা ওই দেশের ও জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মতামতের ভিত্তিতে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে কার্যকর করা হয়। বাংলাদেশ আবারো সাফল্য দেখিয়ে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণের চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৮২৭ ডলার, যা জাতিসংঘের নির্ধারিত সীমা ১ হাজার ২২২ মার্কিন ডলারের ওপরে ছিল। মানবসম্পদ সূচকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ৭৫.৩, যা জাতিসংঘের নির্ধারিত সীমা ৬৬-এর চেয়ে বেশি। আর অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ২৭.৩, যা ৩২ এর নিচে থাকলেই চলে।

তবে স্বল্পোন্নত দেশের জন্য তার পরবর্তী যাত্রায় বিভিন্ন ধরনের নতুন বাস্তবতা আসে। তবে দেশগুলোকে এর জন্য খুব ভালোভাবে প্রস্তুত থাকতে হয় এবং নিজেদের উত্তরণ অর্থবহ করতে বিশেষ প্রচেষ্টা নিতে হয়।

উত্তরণের পথ ধরে যেসব সুযোগ আসতে পারে

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নতুন পরিচয় আমাদের অর্থনৈতিক শক্তি ও সামর্থ্যের ইঙ্গিত দেয়। নির্দিষ্ট কোনো গ্রুপ থেকে আরেকটি গ্রুপে উত্তরিত হওয়া একটি দেশ নতুন ভাবমূর্তি ধারণ করে। নতুন ব্র্যান্ডিং দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সাহায্য করে। বৈশ্বিক ঋণদানকারী সংস্থাগুলো তাদের ঋণ ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে আরো বেশি আশ্বস্ত হয়। সুতরাং আমাদের ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা আরো বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতিযোগিতামূলক সুদে বাংলাদেশ অধিক বাণিজ্যিক ঋণ পাওয়ার সুযোগ পাবে। সবরেইন বন্ডের মাধ্যমে বিশ্ববাজার থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রতিযোগিতামূলক হারে বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রকল্পের জন্য ঋণ পাওয়া যেতে পারে। বৈশ্বিক আর্থিক বাজার থেকে ব্যক্তি খাত মূলধন-পুঁজি সংগ্রহে যে বাধার মুখোমুখি হয় আগামী দিনগুলোয় তা অনেকাংশে কমে আসবে বলে আশা করা যায়।

আন্তর্জাতিক কিছু সুযোগ-সুবিধা হারানোর চ্যালেঞ্জ

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের প্রধান চ্যালেঞ্জ আন্তর্জাতিক কিছু সুযোগ-সুবিধা (ইন্টারন্যাশনাল সাপোর্ট মেজার্স বা আইএসএম) হারানোর চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের জন্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের বাজারে আমাদের পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত বাণিজ্য প্রবেশাধিকার সবচেয়ে ফলপ্রদ সুবিধা হিসেবে বিবেচিত। অন্য স্বল্পোন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ বেশ সফলতার সঙ্গে আইএসএমগুলো ব্যবহার করতে পেরেছে। বেশ কয়েকটি দেশ জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রিফেরেন্সের (জিএসপি) অধীনে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার সুবিধা দিচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির সবচেয়ে বড় বাজার। তারা ‘এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ)’ উদ্যোগের অধীনে বাংলাদেশের পণ্যকে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। অতএব এ বাজার প্রবেশাধিকার হারানোর ফলে বাংলাদেশের রফতানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বৈকি।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) অধীনে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট বিশেষ ও ভিন্ন সুুবিধা (স্পেশাল অ্যান্ড ডিফারেনশিয়াল ট্রিটমেন্ট বা এসঅ্যান্ডডিটি) থেকেও সুফল পায়। বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধা স্বত্ব অধিকার (ট্রিপস) এ ধরনের একটি চুক্তি, যা স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে বিভিন্ন ধরনের ছাড় প্রদান করছে। ট্রিপসের ফলে বাংলাদেশ সাশ্রয়ী মূল্যে পাঠ্যবই প্রাপ্তি এবং অন্যান্য প্যাটেন্ট সম্পর্কিত নমনীয়তাসহ কিছু সুবিধা পায়। ট্রিপসের অধীনে ওষুধসংক্রান্ত ছাড়গুলো ২০৩২ সালের শেষ পর্যন্ত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য বলবৎ থাকবে। উত্তরণের পর এ ধরনের ছাড়গুলো বাংলাদেশ আর পাবে না। বাংলাদেশ তার প্রস্তুত করা ওষুধ একশটির চেয়ে বেশি দেশে রফতানি করে, যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই স্বল্পোন্নত দেশভুক্ত। কাজেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তির স্বল্পোন্নত দেশের জন্য সুনির্দিষ্ট এসঅ্যান্ডডিটি হারানোর ফলে দেশের ওষুধ শিল্পের উন্নয়ন কিছুটা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট তহবিল বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আমাদের দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বেশ নাজুক। বাংলাদেশ খুব কম গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন করলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ব্যাপক ক্ষতির শিকার। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তহবিল না পেলে তা আমাদের অভিযোজনসম্পর্কিত পদক্ষেপগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

স্বল্পোন্নত দেশের জন্য অর্থায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন অর্থায়নের খরচ ও ঋণ সার্ভিসিং দায় বাড়বে। তদুপরি আলোচনা ও আন্তর্জাতিক বৈঠকে স্বল্পোন্নত দেশের সদস্যপদ, বৈদেশিক সাহায্য, বাণিজ্যসম্পর্কিত কারিগরি সহযোগিতা, শিক্ষা বৃত্তি, জাতিসংঘে চাঁদার পরিমাণ কম থাকা, সাধারণ পরিষদ ও জাতিসংঘের অন্য বৈঠকগুলোয় অংশগ্রহণ করার জন্য খরচ ইত্যাদি আইএসএমও উত্তরণের পর চলে যাবে।

মসৃণ ও টেকসই উত্তরণের প্রস্তুতি

বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের মসৃণ উত্তরণের জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। এর মধ্যে প্রথম বিষয়টি হলো অর্থনীতির সার্বিক সক্ষমতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। অর্থনীতির বহুমুখীকরণ, প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন, দক্ষতা উন্নয়ন এবং প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিদেশী বিনিয়োগ সেখানেই যায়, যেখানে সহায়ক পরিবেশ, উন্নত অবকাঠামো, দক্ষ মানবসম্পদ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আছে।

দ্বিতীয়ত, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ-পরবর্তী সময়েও বাংলাদেশ বাজার প্রবেশাধিকারের সুযোগ পেতে পারে, যেটিকে ‘জিএসপি প্লাস’ বলা হয়। এটি পেতে শ্রম অধিকার, মানবাধিকার, পরিবেশগত সুরক্ষা ও সুশাসনসহ ২৭টি আন্তর্জাতিক কনভেনশন বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। অবশ্য এটিও মনে রাখতে হবে, জিএসপি ও জিএসপি প্লাসের অধীনে মোট শুল্ক লাইনের মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ শুল্ক সুবিধা দেয়। কাজেই আগে আংশিক বা ইবিএ উদ্যোগের অধীনে পুরোপুরি শুল্ক ছাড় পাওয়া কিছু পণ্য জিএসপি বা জিএসপি প্লাস উদ্যোগের অধীনে আর সুবিধা পাবে না।

তৃতীয়ত, বিভিন্ন ধরনের আইএসএম অবসানের কারণে সৃষ্ট ক্ষতি পোষাতে পণ্য ও বাজার উভয় ক্ষেত্রে রফতানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানো ও পণ্য বহুমুখীকরণ অত্যাবশ্যক। বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনের (বিমসটেক) মতো আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক উদ্যোগেও বাংলাদেশকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে এবং বিভিন্ন ধরনের ব্যাপকতর অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের অংশ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আসিয়ানের মতো কোনো একটি বড় সংঘের পর্যবেক্ষক সদস্য হওয়ার চেষ্টা করতে হবে এবং ভবিষ্যতে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের সদস্য হওয়ার চেষ্টা চালাতে হবে, যাতে বিভিন্ন ধরনের নতুন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়।

চতুর্থত, উত্তরণের পর বাংলাদেশকে বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা চালাতে হবে। দাতা সংস্থা এবং অন্য উৎসগুলো থেকে বাংলাদেশকে ঋণ নেয়াসহ বিভিন্ন ধরনের অর্থায়নের জন্য এগোতে হবে। ঋণের ক্ষেত্রে ফেরত দেয়ার সময়কাল হবে কম এবং সুদের হার বেশি হবে। এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি), নতুন উন্নয়ন ব্যাংক (এনডিবি) এবং অন্য বাণিজ্যিক উৎস থেকে অধিক সম্পদ সঞ্চালনের জন্য বাংলাদেশকে এখন থেকেই চেষ্টা করতে হবে। কিছুটা ব্যয়বহুল হলেও এনডিবির সদস্য হলে তা বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে সুফল বয়ে আনবে।

পঞ্চমত, এমনকি উত্তরণের পরও আরো কিছুদিনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ছাড় ও বাণিজ্য অগ্রাধিকার অব্যাহত রাখতে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে, যাতে উত্তরণের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুতি নেয়া যায়। অনেক স্বল্পোন্নত দেশ উত্তরণ-পরবর্তী সময়েও আন্তর্জাতিক সুযোগগুলো পেয়েছে। সেই উদাহরণগুলো সামনে তুলে ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার করতে হবে।

চূড়ান্তভাবে, বাংলাদেশ অর্থনীতির শক্তিমত্তা প্রমাণিত হয়েছে। গত পাঁচ দশকে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ে চলমান কভিড-১৯ মহামারীতে পর্যুদস্ত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ অর্থনীতি তার সহনশীলতা দেখিয়েছে এবং প্রবৃদ্ধির দিক থেকে বেশির ভাগ দেশের চেয়ে ভালো করেছে। তবে মহামারীর অভিঘাত থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে আরো বেশি কাজ করতে হবে। যুগপত্ভাবে, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মসৃণ উত্তরণের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে, যাতে এ অর্জন সংহত ও টেকসই হতে পারে এবং উন্নয়ন দেশের নাগরিকদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে।

 

ড. ফাহমিদা খাতুন: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)