অনিশ্চয়তার মাঝেও এগিয়ে চলা – রওনক জাহান

কালের যাত্রা ২০২৫

Originally posted in দৈনিক সমকাল on 31 December 2024

গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা এক ধরনের স্বৈরাচারী শাসন কাঠামোর মধ্যে ছিলাম; যেখানে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল এক ব্যক্তির হাতে। এরপর মাত্র ৩৬ দিনের একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেই ব্যক্তিকে আমরা অপসারণ করতে সক্ষম হই।

যখন আকস্মিকভাবে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এমন একটি বিশাল রাজনৈতিক পট পরিবর্তন করা হয়, তখন কিছুটা অস্থিরতা থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। তবে যতটা না রাজনৈতিক অস্থিরতা আমি দেখতে পাচ্ছি; তার চেয়ে বেশি মানুষের মনে কাজ করছে অনিশ্চয়তা।

রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এক বিষয় নয়। মানুষের মনে এক ধরনের অনিশ্চয়তা আছে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। এই অনিশ্চয়তা যে খারাপ তাও নয়; এর একটা ভালো দিকও আছে। গত ১৫ বছরে আমরা এক রকমের রাজনৈতিক ব্যবস্থায়, রাজনৈতিক চর্চায় অভ্যস্ত ছিলাম। এ দেশের মানুষ সেই পুরোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার, পুরোনো রাজনৈতিক চর্চার পরিবর্তন চেয়েছিল। এখন ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক চর্চা কেমন হবে তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা।

আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলেছে, তারা আগামী এক বছর বা দেড় বছর থাকবে। এ সময়ে তারা কিছু সংস্কার করবে। এরপর একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাবে। যতদিন একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ না করবে, ততদিন ঠিক বোঝা যাবে না যে, আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা কেমন হতে চলেছে। সংস্কার এবং নির্বাচন– এই দুটি বিষয়েই রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐকমত্য নেই। কিছু শক্তি দ্রুত নির্বাচন চাইছে। কিছু শক্তি সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কতটুকু সংস্কার করা যাবে, অন্য সংস্কার প্রস্তাবের কী ভবিষ্যৎ, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। আমাদের আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হবে।

তবে সব দলই হয়তো জানে কিছু সংস্কার করতেই হবে। গণঅভ্যুত্থানের পর সংস্কারের পক্ষে একটি গণআকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছে। আগে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতাধারীর হাতে যেমন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ছিল, ভবিষ্যতে তাতে একটা ভারসাম্য আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রী, দলীয়প্রধান বা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে বেশির ভাগ দলই হয়তো রাজি হবে। আরও গভীর সংস্কার করার কথা যদি বলা হয়, যা এখনকার বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে আলাদা; যেমন– নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংখ্যানুপাতিক আসনের বিষয়ে বিএনপির মতো বড় দল হয়তো রাজি হবে না। তারা আগের নির্বাচনী কাঠামোয় অভ্যস্ত। জনগণও পুরোনো নির্বাচনী ব্যবস্থায় অভ্যস্ত। এ ছাড়া রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তন চাইছে অনেক মানুষ; যেমন– আমাদের নির্বাচনী কাঠামোয় ভোটে জিততে হলে প্রচুর অর্থ ও পেশিশক্তির প্রয়োজন; এসব বিষয়ের সংস্কার হয়তো দ্রুত আনা সম্ভব হবে না। বড় রাজনৈতিক দলগুলো চাইবে, গ্রহণযোগ্য ভোটের মতো পরিবেশ তৈরি করে দ্রুত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসতে।
২০২৪-এর আন্দোলনের একটা ভিন্নতা হলো– ছাত্ররা প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে নিজেদের একটা স্বতন্ত্র পরিচিতির প্রকাশ ঘটিয়েছে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে। আন্দোলনের পরও তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছে।

যে ছাত্ররা এই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে, তারা ইতোমধ্যে একটা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা হয়তো শিগগিরই একটা রাজনৈতিক দল করতে যাচ্ছে। তারা নতুন প্রজন্ম, নতুন বাংলাদেশ গড়তে চায়। কিন্তু ‘নতুন বাংলাদেশ’ বলতে তারা কী বোঝাচ্ছে, তাদের রাজনীতিটা কী হবে, পুরোনো ধারার রাজনীতির বদলে তারা নতুন কী রাজনীতির চর্চা করবে; তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক নীতি কী হবে এবং এর প্রক্রিয়া-পদ্ধতি কেমন হবে– এ বিষয়ে এখনও তারা পরিষ্কার ধারণা দেয়নি। এই অস্পস্টতাও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে।

ছাত্ররা একটা রাজনৈতিক দল গড়তেই পারে। তারা নিশ্চিতভাবেই একটা নতুন রাজনৈতিক শক্তি। তবে সেই নতুন শক্তি রাজনীতিতে কোনো গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারবে কিনা, তা এখনও বলা যাচ্ছে না। যদি তারা নির্বাচনে গিয়ে সেই পুরোনো ধারার রাজনৈতিক দলের মতোই প্রচারণা চালায়, পুরোনো রাজনৈতিক বিভাজনের পরিবর্তে নতুন বিভাজন সৃষ্টি করে, প্রতিহিংসার রাজনীতি করে তাহলে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসবে না। ছাত্ররা এখনও পর্যন্ত পুরোনো রাজনৈতিক শক্তি থেকে নিজেদের ভিন্নতা স্পষ্ট করতে পারেনি। এজন্য কিছু সময় অবশ্যই লাগবে। আশা করি, এ বছর যখন তারা রাজনৈতিক দল গঠন করবে, তখন এ বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট হবে।

আমি রাতারাতি বা ২০২৫ সালের মধ্যেই কোনো বড় পরিবর্তন আশা করি না। এখানে মানুষ একভাবে নির্বাচন ও নির্বাচনের রাজনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। যেখানে গোটা বিষয়টি ভোটের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখানে গত ১৫ বছরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনের রাজনীতি করেছে অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, জ্বালানির কথিত উন্নয়নের নামে। এ সময়ে মানুষের অধিকার বা জবাবদিহিতা নিয়ে কথা বলেছে বিরোধী দল, কিন্তু তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি বা তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়েছিল। এক বছর বা দেড় বছর পর নির্বাচন হলে এতদিন ধরে যেভাবে নির্বাচনের রাজনীতি চলেছে তার থেকে খুব বেশি গুণগতভাবে ভিন্ন কিছু হবে বলে আমার মনে হয় না। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন এবং অর্থনীতির লুটপাট যে হয়, সেটি জনগণ ভালোই জানে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা না হলেও জনগণ হয়তো শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত রাজনৈতিক দল দিয়েই দেশ পরিচালনা করার কথা বলবে। তারা নির্বাচনী প্রচারণা দেখে ভোট দেবে; কিন্তু রাজনীতিবিদদের কীভাবে প্রতিনিয়ত জবাবদিহিতার মধ্যে আনা যায়, সেই কৌশল এখনও জনগণের জানা নেই।

যদি আমরা রাজনৈতিক দলের অর্থায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারি বা নির্বাচনে বিপুল অর্থের ব্যবহার কমিয়ে আনা যায়; তাহলে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ও অর্থনীতিতে লুটপাট কিছুটা হয়তো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব। তবে আমাদের দেশে রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সব ব্যাপারে আমরা যে সংস্কার চাচ্ছি, তার কোনোটাই সম্ভব হবে না, যদি না আমরা এসব ব্যাপারে ব্যাপক একটি জনসমর্থন গড়ে তুলতে না পারি। রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তুলতে হলে দরকার হবে সংস্কার প্রশ্নে বিপুল জনসমর্থন।

৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এক স্বৈরাচারী শাসনের পতন হয়েছে। এরপর গণতন্ত্রের পথে নতুন করে যাত্রা শুরুর অনেক আকাঙ্ক্ষা জন্ম নেয়। তবে এখানে পুরোনো অনেক অগণতান্ত্রিক চর্চা রয়ে গেছে। এখানে প্রথম যা দেখতে হবে, তা হলো– ছাত্ররা একটা রাজনৈতিক দল গঠন করলে তারা কোন ধরনের নতুন গণতান্ত্রিক রাজনীতি জনগণের কাছে কতটা পৌঁছাতে পারছে, এর গ্রহণযোগ্যতা আছে কিনা এবং তারা মানুষকে আরও ব্যাপকভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে পারছে কিনা। নতুন রাজনৈতিক অবস্থার জন্য মানুষ কতটা প্রস্তুত, তার সঙ্গে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন সম্পর্কিত।

ছাত্ররা নীতিগতভাবে বলছে, আমরা পুরোনোটা চাই না; নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়তে চাই। নতুন রাজনীতি কেমন হবে; তেমনটা তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এখনও স্পষ্ট নয়। তাই তাদের রাজনীতি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত টানার জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। আবার এমনও নয় যে ছাত্ররা বিফল হলে আরও অনেক র‍্যাডিক্যাল শক্তির উত্থান হবে। এজন্য একটা সংগঠিত শক্তির প্রয়োজন। আমাদের ডান-বাম কোনো পক্ষেই এমন সংগঠিত শক্তি আমি দেখি না।

এ অবস্থায় নির্বাচন হলে হয়তো এখন সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ভোটে জিতে সরকার গঠন করবে। সেখানে খুব বড় কোনো পরিবর্তন হয়তো হবে না। তবে সেটা হয়তো গত ১৫ বছরের মতোও হবে না। হয়তো সেখানে বাক্‌স্বাধীনতা থাকবে, ভিন্নমতের অবস্থান থাকবে; কিন্তু দুর্নীতি-চাঁদাবাজি হয়তো চলমান থাকবে। অর্থ ও পেশিশক্তির ব্যবহার হয়তো বন্ধ হবে না। কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। রাজনীতিতে এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের জন্য যে ব্যবস্থাপনা দরকার তার জন্য দরকার একটি সামষ্টিক বোঝাপড়া। আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে; তবে সেই অনিশ্চয়তার মাঝেই আগামীর এগিয়ে চলার পথ।

লেখক: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী
সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)