Originally posted in সমকাল on 6 August 2023
অর্থনৈতিক অবনতি কারণে মধ্যবিত্ত আজ বড় অসহায়। তারা না ট্রাকের চাল নেওয়ার লাইনে দাঁড়াতে পারে, না ঋণ করে খেয়ে শোধ করতে পারে। আবার সরকারি সুযোগ ভোগ করতেও মধ্যবিত্তের সম্মানে বাধে। জমানো টাকা শেষে তাদের একটা বড় অংশ এখন সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর বাইরে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থা তুলে ধরছে এক অস্থির সামাজিক বাস্তবতা। লিখেছেন শাহেরীন আরাফাত
নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল ও আটা এবং ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য কিনতে স্বল্প আয়ের মানুষের দীর্ঘ লাইন এখন এক সাধারণ চিত্র। এ লাইনে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে মধ্যবিত্তরা। হাসিবা সুলতানা মোহাম্মদপুরে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াতেন। করোনাকালে তাঁর চাকরি চলে যায়। স্বামী ব্যাংকার। একার আয়ে দুই সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি সন্তানদের টিউশনি বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনটাই জানালেন ওএমএসের লাইনে দাঁড়ানো হাসিবা।
তেজগাঁও এলাকায় একটি পত্রিকার সাংবাদিক হিমেল সারোয়ার (ছদ্মনাম)। কোনো কোনো মিডিয়ায় বেতন অনিয়মিত হলেও তাঁর পত্রিকায় এমন সমস্যা নেই। তবে গত চার বছরে সবকিছুর দাম বাড়লেও তাঁর বেতন বাড়েনি। তাঁর স্ত্রী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। দু’জনের আয়ের কারণেই মূলত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া দুই মেয়েকে এখনও বাজারমূল্যের চাপ অনুভব করতে হয়নি। ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা যেন শেষ হওয়ার নয়। ফ্ল্যাটের ব্যাংক ঋণ আর ইএমআই তো তাদের আয়ের একটা বড় অংশ কেড়ে নিচ্ছে। সম্প্রতি সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় অনেকটা অসহায় হয়ে হিমেল পরিবারের ঘুরতে যাওয়ার জন্য যে অর্থ বরাদ্দ ছিল, তা বাদ দিয়েছেন। এমনকি দাওয়াতে অংশগ্রহণও কমিয়ে দিয়েছেন। এখনও এ পরিবারটির খাবারের তালিকায় কাটছাঁট করতে হয়নি। প্রসঙ্গত, খাবারের তালিকা থেকে মাছ-মাংসসহ অনেক কিছুই বাদ দিয়ে ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছেন অনেকে। এমনই একজন নজিউর রহমান। মতিঝিলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় কর্মকর্তা। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ভাত না খেয়ে রুটি-কলা খাচ্ছিলেন। জানালেন, এখন বাইরে এক বেলা সবজি, ডাল, ভাত খেতেও শতাধিক টাকা লেগে যায়। সংসারের খরচ বেড়ে যাওয়ায় তিনি দুপুরে নিজের খাবার থেকে কাটছাঁট শুরু করেছেন।
চলতি বছরের মার্চের শেষভাগে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের (সিপিজে) জরিপ অনুযায়ী, আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে টিকে থাকতে খাবারের ব্যয় কমানো মানুষের হার ছিল ৪৩ শতাংশ; যা পরবর্তী চার মাসে ধাপে ধাপে বেড়ে ৫০ শতাংশে ঠেকেছে। ওই জরিপে জানানো হয়, গত বছরের জুনে যেখানে ৬৪ শতাংশ মানুষ জানিয়েছিলেন তাদের আয় কমেছে, সেখানে ডিসেম্বরে হারটি দাঁড়ায় ৫৩ শতাংশে। তারপরও দেখা যাচ্ছে, অর্ধেকের বেশি পরিবারের আয় আগের পর্যায়ে ফেরেনি।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) জানায়, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়েছে। দেশের আটটি বিভাগের ১ হাজার ৬০০ নিম্নআয়ের পরিবারের ওপর সেপ্টেম্বর ২০২২-ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সময়ে পরিচালিত সানেমের জরিপে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, সেগুলো হলো– ১৮ শতাংশ পরিবারকে কখনও কখনও পুরো দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে; ৭১ শতাংশ পরিবার প্রয়োজনের তুলনায় কম খাবার খেয়েছে; ৩৭ শতাংশ পরিবার মাঝেমধ্যে কোনো একবেলা খাবার না খেয়ে থেকেছে; ৮১ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল, ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম, ৮৮ শতাংশ পরিবার মাছ এবং ৯৬ শতাংশ পরিবার মাংস খাবার কমিয়েছে; ৯০ শতাংশ পরিবারের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে; ৪৫ শতাংশ পরিবার ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ সুদের হারে ধার করেছে; ৮৫ শতাংশ পরিবার মনে করে, আগামী ৬ মাসে আরও ধার করতে হবে; ৩৫ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছে এবং ৫৫ শতাংশ পরিবার সঞ্চয়বিমুখ হয়েছে। জরিপের তথ্য উপস্থাপনের পর সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান যা বলেছেন, সেটি ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘এ জরিপে দেশের সামগ্রিক অবস্থার একটা ধারণা অন্তত পাওয়া সম্ভব। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্নআয়ের পরিবার ছাড়াও অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার চাপে আছে। মধ্যবিত্তের অনেকে ভাবছেন, তারা এখন নিম্নআয় গোষ্ঠীর মধ্যে চলে এসেছেন।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, ‘যদি আয় না বাড়ে তাহলে সাধারণ বা কম আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমে যাবে। তারা আরও চাপে পড়বে। খাবার কিনতেই তাদের প্রায় সব আয় চলে যাবে। এখন তাই প্রবৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি জরুরি। সামাজিক সুরক্ষামূলক কর্মসূচির ব্যাপ্তি ও প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মতে, যে প্রক্রিয়ায় আমাদের দেশে বর্তমানে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে, সেটিই সমস্যাপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে আমাদের দেশে মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে গ্রামের কৃষিভিত্তিক পরিবার থেকে আসা শিক্ষিতদের মাধ্যমে। কারণ তারা জানতেন, ব্যবসা করে তারা মধ্যবিত্তে যেতে পারবেন না। ভালো করে পড়াশোনা করার মধ্য দিয়েই কেবল তা সম্ভব। যে কারণে ওই মধ্যবিত্তের মধ্যে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা কাজ করেছে। এটি সে অর্থে একটি গুণগত বর্গ, শুধু আর্থিক বর্গ নয়। বাংলাদেশ পর্বে তা দেখা যায়নি। শিক্ষার মান কমে যাওয়া এবং জনতুষ্টিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে মধ্যবিত্তের বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গাটা খর্ব হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তখনকার মধ্যবিত্তরা এখনকার মতো ভঙ্গুর ছিল না। কোনো দুর্যোগ এলেই তাদের অবস্থান নিচে নেমে যেত না। এখনকার পেশাজীবী, মধ্যবিত্তের পুঁজি হলো আর্থিক, বুদ্ধিবৃত্তিক নয়। বিভিন্ন আর্থিক দুর্যোগের সঙ্গে তাদের অবস্থান পরিবর্তিত হয়। তাদের অবস্থা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। নদীতে নাক বরাবর পানিতে দাঁড়িয়ে থাকলে যে অবস্থা হয়, তাদের অবস্থাটা এমনই। হালকা ঢেউয়ে তলিয়ে যেতে পারে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘মধ্যবিত্ত কারা– এ নিয়েও বিতর্ক আছে। মধ্যবিত্তের মধ্যে আবার ভাগ আছে– উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্তের একটা ছোট অংশ বিভিন্ন অর্থনৈতিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে উচ্চ মধ্যবিত্তে পৌঁছে গেছে। আমরা যদি ওই অংশটাকে গোনায় ধরি, যাদের সীমিত আয় এবং পেশাজীবী– দেখা যাবে, গত কয়েক বছরে এই অংশটার মধ্যে একটা ভাঙন এসেছে।
মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। তাদের একটা বড় অংশ কোনো সুযোগ গ্রহণ করতে না পেরে নিম্ন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তে নেমে গেছে। করোনার আগেও যে তাদের আয় খুব নিশ্চিত ছিল এমন নয়। আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম, পৃথিবীর অন্যতম কম। গত ১০-১৫ বছরে চাহিদার মধ্যেও কিছু পরিবর্তন এসেছে। যেমন কম্পিউটার-ল্যাপটপ একটা সময়ে বিলাসিতা ধরা হতো, এখন তা জরুরি খরচ। এসব চাহিদার সঙ্গে আছে গণপরিবহনের খরচ বৃদ্ধি। আমাদের দেশে দুধ, ডিম, সবজির যে দাম; যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে তা আমাদের এখানে আয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক গুণ বেশি। মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশই থাকে ভাড়া বাড়িতে।
বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ব্যাপক পরিমাণে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুটি প্রধান খরচ– শিক্ষা ব্যয় ও চিকিৎসা ব্যয়। মধ্যবিত্তকে প্রতিনিয়ত অতিরিক্ত খরচ সামলাতে গিয়ে একটা বিকল্প খরচের পথ সন্ধান করতে হয়। এর একটা উপায় হলো, পরিবারের একাধিক সদস্য শ্রমবাজারে প্রবেশ করা। এ জন্য সুযোগ থাকলে মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই শ্রমে যুক্ত হতে দেখা যায়। দু’জন কাজ করেও কুলানোটা কষ্টকর হয়ে যায়। সরকারি কর্মকর্তারাও এই বেতনে খুব ভালো অবস্থায় থাকার কথা নয়। তবে তাদের অনেকেই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নেন অথবা অনৈতিক আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেন। ফলে তারা এ বেতনে ভালো অবস্থায় থাকতে পারেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা মিডিয়ায় কাজ করাদের জন্য কর্মঘণ্টার কোনো শেষ নেই। তাদের মূল কাজের বাইরে একটা বাড়তি আয়ের চিন্তা করতে হয়। একজনের আয় দিয়ে এখন মধ্যবিত্তের জন্য চলা সম্ভব নয়। তাই তাঁকে সবসময় একটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকতে হচ্ছে। সবসময় ভবিষ্যৎ নিয়ে, সন্তানদের নিয়ে চিন্তা করাটা এখন মধ্যবিত্তের বাস্তবতা। এর ফলে মধ্যবিত্তরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। অতিরিক্ত কাজ ও পুষ্টিহীনতার কারণে মানসিক চাপ বাড়ছে। এর ফলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ফুসফুস, কিডনির রোগ বা ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।’
একটা সময় ছিল, যখন অপরিচ্ছন্ন বা পুরোনো কাপড় থেকে গরিব মানুষ চিহ্নিত করা গেছে। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, পোশাক নতুন দরিদ্রদের অদৃশ্য করে রাখছে। এই নতুনবর্গের মানুষের দুর্দশা তাদের বেশভূষা দেখে বোঝা যাবে না। এ জন্য তাদের দৈনন্দিন খাবার গ্রহণের মাত্রা ও মানিব্যাগের দিকে তাকাতে হবে। মধ্যবিত্ত থেকে তৈরি হওয়া এই ‘নতুন দরিদ্র’দের প্রকৃত সংখ্যা জানতে এখনও কোনো সরকারি জরিপ হয়নি। এ সংখ্যা যে বাড়ছে, তা নিশ্চিত করেই বলে দেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে গোটা সমাজের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে সামাজিক অস্থিরতাও সামনে নতুন রূপে হাজির হতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।