Originally posted in Prothom Alo on 23 November 2023
ঋণ আর বাণিজ্যে এখন বড় অংশীদার ভারত
এক যুগের চিত্র
- ভারত যে ৬২টি দেশকে ঋণ দেয় তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮০০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ।
- তিনটি এলওসির ছাড় মাত্র ১৪৯ কোটি ডলার।
- এক দশকে ভারত থেকে আমদানি তিন গুণ বেড়েছে।
- গত ৫ বছরে ১২তম রপ্তানি গন্তব্য থেকে সপ্তমে উন্নীত ভারত।
- ট্রানজিট নিয়ে আলোচনা বেশি, অগ্রগতি কম।
প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক গত দেড় যুগে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এ সময়ে দুদেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য কয়েক গুণ বেড়েছে। ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতা দেশ এখন বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত যে ৬২টি দেশকে ভারতের এই ব্যাংকঋণ দিয়েছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ।
প্রায় দুই দশক আগে ভারতের এক্সিম ব্যাংক প্রথম লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) ধারণা নিয়ে বিভিন্ন দেশকে ঋণ দেওয়া শুরু করে। ২০০৩-০৪ অর্থবছরে এই উদ্যোগের যাত্রা শুরু। এক্সিম ব্যাংক ভারতের রপ্তানি, বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশকে ঋণসহায়তা দিতে থাকে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ১০০ কোটি ডলারের লাইন অব ক্রেডিট পায়।
এরপর গত এক যুগে বাংলাদেশ এক্সিম ব্যাংকের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতা দেশে পরিণত হয়েছে। ঋণগ্রহীতার এই তালিকায় আছে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, কিউবা, নাইজেরিয়া, সিরিয়া, মিয়ানমার, সেনেগাল, কঙ্গো, ঘানা, আইভরি কোস্ট, অ্যাঙ্গোলার মতো দেশ। তবে কোনো দেশই বাংলাদেশের অর্ধেক পরিমাণ ঋণও নেয়নি।
তিনটি এলওসির মাধ্যমে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাত শ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার চুক্তি করেছে। এ ছাড়া প্রতিরক্ষা খাতের একটি প্রকল্পের জন্য ৫০ কোটি ডলারের চুক্তিও হয়েছে। ভারতের এক্সিম ব্যাংক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
একই সঙ্গে গত এক দশকের বেশি সময়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় সম্প্রসারণ হয়েছে। গত পাঁচ বছরে ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে আড়াই গুণ। বেড়েছে আমদানিও। গত ১০ বছরে ভারত থেকে আমদানি বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। এক যুগ ধরে ট্রানজিট নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলেছে। তবে এ ক্ষেত্রে আলোচনাই বেশি হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্ট পথ এখনো চালু হয়নি।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক্সিম ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ ঋণের সুফল আমরা নিতে পারছি না। কারণ, এক্সিম ব্যাংকের ঋণের অনেক প্রকল্প আঞ্চলিক যোগাযোগ, ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু গত সাত বছরেও বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মধ্যে অবাধ যান চলাচল চালু করতে পারিনি। এই তিন দেশের মধ্যে অবাধ যোগাযোগ হলে বাংলাদেশ বেশি লাভবান হতো। অন্যান্য ট্রানজিট ও বাণিজ্য করিডর খুলে যেত।’
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, গত এক যুগে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণ হয়েছে। বাণিজ্য বৃদ্ধির আরও সম্ভাবনা আছে। ট্রানজিটসহ দুই দেশের পণ্য ও যাত্রী চলাচল নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, বাস্তবে তত অগ্রগতি হয়নি।
তিন এলওসিতে ছাড় মাত্র ১৪৯ কোটি ডলার
২০১০ সালে ১০০ কোটি ডলারের প্রথম এলওসি সই হয় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে। পরে এর ১৪ কোটি ডলার অনুদানে রূপান্তর করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দেয় ভারত। এরপর ২০১৫ সালে দ্বিতীয় এলওসির আওতায় ২০০ কোটি ডলারের চুক্তি হয়। দুই বছর পর ২০১৭ সালে ৪৫০ কোটি ডলারের তৃতীয় এলওসি হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, গত জুন মাস পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৪৯ কোটি ডলার ছাড় করেছে এক্সিম ব্যাংক।
তিনটি এলওসিতে সড়ক ও রেল যোগাযোগ, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ অবকাঠামো খাতের ৪২টি প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৪টি প্রকল্প শেষ হয়েছে। চলমান আছে আটটি প্রকল্প। বাকি ২০টি প্রকল্প পরামর্শ নিয়োগ, ঠিকাদার নিয়োগ, প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রস্তুত করা—এমন পর্যায়ে আছে।
নতুন এলওসি আর নয়
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, নতুন করে ভারতের কাছ থেকে আর গুচ্ছ ঋণ বা এলওসি না নেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। এখন থেকে প্রকল্প ধরে সরকারি সংস্থাকে আলাদাভাবে ঋণ দিতে চায় এক্সিম ব্যাংক। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনের (বিআরটিসি) জন্য ১০০টি ইলেকট্রিক বাস কেনার প্রকল্প নিয়ে আলোচনা চলছে।
এ ছাড়া চুক্তির শর্ত শিথিল করা নিয়েও এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলছে। যেমন এখন শুধু ভারতীয় ঠিকাদারেরাই এলওসি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের দরপত্রে অংশ নিতে পারেন। ফলে তাঁদের একতরফা দামেই কার্যাদেশ দিতে হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ অংশীদারত্বের বা জয়েন্ট ভেঞ্চার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও যাতে দরপত্রে অংশ নিতে পারে, তা নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। এলওসির কোনো প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ (কিছু ক্ষেত্রে শর্ত সাপেক্ষে ৬৫ শতাংশ) পণ্য বা সেবা ভারত থেকে কিনতে হবে, বর্তমানে এমন শর্ত আছে। এই শর্ত শিথিল করার জন্যও দর-কষাকষি চলছে।
আমদানি-রপ্তানি বেড়েছে কয়েক গুণ
গত এক দশকে বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানি তিন গুণ বাড়িয়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারত থেকে ৪৭৪ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল। এর পরের ১০ বছরে আমদানি বেড়েই চলেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এসে ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি বিল পরিশোধের চিত্র থেকে এই তথ্য জানা গেছে। অবশ্য পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি কিছুটা কমে ১ হাজার ৬৩ ডলার হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মোট আমদানির ১৮ শতাংশের বেশি আসে ভারত থেকে। ভারত হলো বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানি উৎস। শীর্ষে আছে চীন। সেখান থেকে মোট আমদানির ২৫ শতাংশ আসে।
বাংলাদেশের আমদানি করা ভারতীয় পণ্যের তালিকায় শীর্ষে আছে তুলা। মোট আমদানি খরচের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হয় তুলা আমদানিতে। এরপর আছে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য। এরপর রয়েছে রেলের বগি, ইঞ্জিনসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ।
তবে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ভারসাম্য ব্যাপকভাবে বাংলাদেশের বিপক্ষে। ভারত থেকে যত মূল্যের পণ্য আমদানি হয়, রপ্তানির পরিমাণ তার সাত ভাগের এক ভাগ। সম্প্রতি প্রতিবেশী এই দেশে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে বলে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশি পণ্য ও সেবার রপ্তানি গন্তব্যের তালিকায় ভারতের স্থান ছিল ১২তম। ওই বছর ভারতে ৮৭ কোটি ডলারের পণ্য ও সেবা রপ্তানি হয়। পাঁচ বছরের মধ্যে ভারতের অবস্থান হয়েছে সপ্তম। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৯৯ কোটি ডলারের রপ্তানি হয়েছে ভারতে। গত অর্থবছরে অবশ্য কিছুটা কমে ১৮৬ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় হয়েছে।
অল্প কিছু বাদে বেশির ভাগ পণ্যে বাংলাদেশকে শতভাগ শুল্ক সুবিধা দেয় ভারত। কয়েক বছর আগে এই সুবিধা দেওয়ার পর ভারতে রপ্তানি বাড়তে থাকে। তবে শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকলেও নানা ধরনের অশুল্ক বাধা এখনো বিদ্যমান।
রপ্তানিকারকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ভারতের এক রাজ্যে একেক ধরনের স্থানীয় কর আরোপ করা হয়। ফলে শুল্কমুক্ত সুবিধার পুরোটা ব্যবহার করতে পারেন না রপ্তানিকারকেরা। এ ছাড়া পণ্যের মান পরীক্ষার নামে দীর্ঘ সময় সীমান্তে রপ্তানি পণ্যের চালান আটকে থাকে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খাদ্য ও খাদ্যজাত পণ্য রপ্তানি করেন—এমন ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, চালানের মান সনদ পাওয়ার জন্য ত্রিপুরার আগরতলা সীমান্তে অনেক সময় এক মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, একসময় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি ভয়ংকর রকম নেতিবাচক ছিল, যা বাংলাদেশের অনুকূলে ছিল না। বর্তমান সরকার এক যুগের বেশি সময় ধরে এ নিয়ে কাজ করছে। বাণিজ্য, বিনিয়োগ, যোগাযোগ—সব ক্ষেত্রেই উন্নতি হয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতিও আগের চেয়ে কমেছে। এই ঘাটতি আরও কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশ-ভারতসহ এই অঞ্চলের বাণিজ্য সম্পর্ক কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নতি না হওয়ার কারণ উপমহাদেশের রাজনীতির শিকার এই খাতটি। এই রাজনীতির কারণে পারস্পরিক ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ট্রানজিটে অগ্রগতি কম
বছর দশেক ধরে ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তযোগাযোগ বৃদ্ধির নানা চেষ্টা চলছে। ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্ট, কখনোবা চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করা—এসব নিয়ে ভারতের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অগ্রগতি হয়েছে সামান্য।
বর্তমান সরকার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পরই ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, আন্তযোগাযোগ বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে আসে। ২০১১ সাল থেকে আশুগঞ্জ নৌবন্দর দিয়ে বহুমাত্রিক ট্রানজিট নিতে অনেক আগ্রহ দেখিয়েছিল ভারত। মাশুল নিয়ে কয়েক বছর দর-কষাকষির পর পাঁচ বছর আগে ঘটা করে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পথটি চালু করা হয়। কিন্তু বছরে চার-পাঁচটির বেশি চালান ভারতে যায় না।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের জন্য ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে দিল্লিতে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়। পরের বছর অক্টোবর মাসে এ পথে পণ্য পরিবহন পদ্ধতি নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড অব প্রসিডিউর (এসওপি) সই হয়। ২০২০ সালের জুলাই মাসে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে একটি পরীক্ষামূলক চালান আগরতলায় যায়। এখন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রামগড় হয়ে সড়কপথে ভারতের ত্রিপুরায় পণ্য নিতে আগ্রহী ভারত।
বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে অবাধ মোটরযান চলাচলের উদ্যোগ সাত বছর ধরে ঝিমাচ্ছে। সড়ক ও নৌপথে পরিবহনের সব উদ্যোগ অনেকটা পরীক্ষামূলক চলাচলের পর আটকে গেছে।
আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়াতে ভারত, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট দেওয়ার জন্য ২০১১ সালে তৎকালীন ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কোর কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সড়ক, রেল ও নৌসহ ১৭টি পথে ট্রানজিটের সুপারিশ করে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিল ওই কমিটি। গত এক যুগে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। ওই প্রতিবেদনে ট্রানজিট মাশুল, পথ নির্ধারণের পাশাপাশি কত বিনিয়োগ দরকার হবে, তা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।
তবে গত এক দশকে বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সরাসরি যাত্রী পরিবহনে কয়েকটি নতুন পথ চালু হয়েছে। যেমন রেলে খুলনা-কলকাতা; ঢাকা-শিলিগুড়ি; বাসে ঢাকা-আগরতলা; বিমানে ঢাকা-চেন্নাই ও ঢাকা-গুয়াহাটি।