অব্যবহৃত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খরচ বহন করতে হচ্ছে: খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Originally posted in The Daily Star on 2 November 2021

দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার নিজপাড়া গ্রামে একটি সৌর সেচ প্রকল্প। ছবি: কংকন কর্মকার/স্টার

নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ। গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য হারে কমানোর জন্যই মূলত এই উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছে।

এই উৎপাদনের অর্ধেক অর্থাৎ ২ হাজার ২৭৭ মেগাওয়াট আসবে সৌরশক্তি থেকে। পানি ও বায়ুর ব্যবহার করে উৎপাদন হবে যথাক্রমে ১ হাজার ও ৫৯৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

হালনাগাদ ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশানে (এনডিসি) বাংলাদেশ এই পরিকল্পনার বিস্তারিত অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং গ্লাসগোতে শুরু হওয়া ‘জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষ সম্মেলন কপ-২৬’কে সামনে রেখে জলবায়ু পরিবর্তন রূপরেখা সম্মেলনে (ইউএনএফসিসিসি) এটি জমা দেওয়া হয়েছে।

এই বৈঠকে অংশ নেওয়া ২০০ দেশ ২০১৫ সালে ‘প্যারিস চুক্তি’ সই করেছিল। সেই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, দেশগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে শিল্প বিপ্লবের আগের পর্যায়ে, অর্থাৎ ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে তাপমাত্রাকে ১ দশমিক ৫ সেলসিয়াসের মধ্যে নিয়ে আসার ব্যাপারেও চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল।

বাংলাদেশের এনডিসিতে বলা হয়েছে, কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ কমানোর এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য যথোপযুক্ত অর্থায়ন, প্রযুক্তি এবং সক্ষমতা তৈরিতে সহায়তার প্রয়োজন হবে।

বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে বাংলাদেশের অবদান ১ শতাংশেরও কম। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে জলবায়ু বিপর্যয় ঘটার সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ঝুঁকিতে আছে এমন দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম এবং এই উচ্চতা বাড়ার পেছনে মূলত গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণই দায়ী।

বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘জলবায়ু সহনশীল হতে হলে আমাদের প্রয়োজন হবে আর্থিক সহায়তা। এই বিষয়টির ওপর আমরা সম্মেলনে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করবো।’

বাংলাদেশের এনডিসিকে হালনাগাদ করার জন্য ভিত্তি হিসেবে ২০১২ সালকে বিবেচনা করা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় ক্রমবর্ধমান গ্যাস নিঃসরণ ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগকে আরও সম্প্রসারিত করা হবে, যাতে দেশ তার বৈশ্বিক দায়বদ্ধতা রক্ষা করতে পারে।

এনডিসিতে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমানোর জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ হাতে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যা দেশকে নিম্ন-কার্বন অর্থনীতির দিকে নিয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা হবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের হারকে ছাড়িয়ে না যাওয়া।

বিদ্যুৎ, শিল্প প্রক্রিয়া, পণ্যের ব্যবহার, কৃষি, বনায়ন ও ভূমির অন্যান্য ব্যবহার এবং আবর্জনা নিষ্কাশন খাতগুলোকে এসব উদ্যোগের আওতায় রাখা হয়েছে।

বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোগের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে কয়লা, গ্যাস ও ফার্নেস তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম এবং নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ।

২০০৮ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫ শতাংশ এবং ২০২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব না হলেও নতুন পরিকল্পনাগুলো প্রণয়ন করা হয়েছে।

বর্তমানে, বাংলাদেশে ১৪৬টি পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং অন্যান্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ২৪ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে মাত্র ৭৭৬ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত হচ্ছে, যা সর্বমোট সক্ষমতার প্রায় ৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ যদি এনডিসিতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে, তাহলে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশে পৌঁছাবে। সে সময় উৎপাদন সক্ষমতা বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ করে ৪৬ হাজার মেগাওয়াট করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ইতোমধ্যে।

টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলাউদ্দিন জানান, সম্প্রতি বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশ উন্নতি করেছে এবং এই খাত থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ২০২১ সালের শেষ নাগাদ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে।

তিনি বলেন, ‘ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ ১ হাজার মেগাওয়াটের চেয়েও বেশি বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত হবে। কিছু বড় আকারের সৌরশক্তি চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের কাজ এখন বাস্তবায়ন পর্যায়ে আছে।’

বর্তমানে ৯টি সৌরশক্তি চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে, যাদের সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা ৪৫০ মেগাওয়াট। এ ছাড়াও একটি বায়ু চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের কাজও চলছে, যেখান থেকে ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে।

এ ছাড়াও ১২টি সৌরশক্তি চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য চুক্তি করা হচ্ছে, যাদের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৫০০ মেগাওয়াট। আরও কয়েকটি বায়ু ও বায়োমাস বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কাজও চলছে, যাদের সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা ১৩০ মেগাওয়াট।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘নবায়নযোগ্য উৎস থেকে প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ পাইপলাইনে আছে এবং এর জন্য সরকার বেসরকারি খাত থেকে তহবিল নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ।’

তিনি যোগ করেন, ‘হালনাগাদ এনডিসির আওতায় বাকি ২ হাজার ১০০ মেগাওয়াটের জন্য সরকার কপ২৬ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক অর্থায়ন চাইতে পারে।’

তবে মোয়াজ্জেমের মতে, বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সক্ষমতা। অব্যবহৃত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার জন্য বাংলাদেশকে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খরচ বহন করতে হচ্ছে।

সম্প্রতি এক গবেষণা পত্রে সিপিডি জানায়, অব্যবহৃত সক্ষমতার পরিমাণ ৪৮ শতাংশ।

মোয়াজ্জেম আরও বলেন, ‘সরকারের উচিৎ প্রবাহ ও বিতরণের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া এবং কয়লাভিত্তিক ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেওয়া। এই উদ্যোগ নেওয়া হলে, নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে।’