Originally posted in প্রথম আলো on 8 November 2025

স্বাধীনতার পরের ৫৪ বছরে এবং ছয়টি বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের (১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯১, ২০০৭ ও ২০২৪) পরেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌল চরিত্র ‘গণপ্রজাতন্ত্র’ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বরং এই রাষ্ট্র ক্রমেই একটি অভিজাততন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এ পরিচয়ে রাষ্ট্রকাঠামো শক্তিশালী হয়েছে, হচ্ছে এবং হয়তো ভবিষ্যতেও হতে থাকবে।
অভিজাততন্ত্রের রূপ একেক দেশে একেক রকম। বাংলাদেশে অভিজাততন্ত্রে যুক্ত রয়েছে রাজনৈতিক অভিজাত পরিবার, বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠান, চিহ্নিত আমলা, আইনশৃঙ্খলা ও প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কয়েকজন সদস্য, বিদেশি প্রভাবশালী গোষ্ঠী ইত্যাদি। দশকের পর দশক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকাকালে অভিজাততন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে। পাশ্চাত্যের মূল্যবোধকেন্দ্রিক অভিজাত শ্রেণি বাংলাদেশে স্বার্থকেন্দ্রিক অভিজাত শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে।
ক্ষমতার আসল উৎস কোথায়
প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার উৎস জনগণ—এ কথা সংবিধানে বলা হলেও বাংলাদেশে সব ক্ষমতার উৎস কয়েকটি অভিজাত গোষ্ঠী। এই শ্রেণির অবস্থান সরকারে, সরকারের বাইরে, প্রশাসনে, সিভিল সোসাইটিতে, দেশের বাইরে বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীতে। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারে ও সরকারের বাইরে বিরোধী পক্ষ হিসেবে যাদের দায়িত্ব পালন করার কথা, বেসরকারি খাত হিসেবে যাদের প্রতিনিধিত্ব করার কথা, তারা প্রকৃত অর্থে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেনি। বরং জনগণের নামে নিজের এবং অন্য কারও স্বার্থ রক্ষায় এরা ব্যস্ত। ফলে জনসাধারণ প্রতিনিয়ত বঞ্চিত, প্রতারিত হচ্ছে।
বঞ্চিত ও প্রতারিত জনগণের এমন অবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর উপায় সীমিত। রাষ্ট্রের দুর্বল অর্থনৈতিক ভিত্তি, দুর্বল মূল্যবোধ, দুর্বল নীতি, আইনের শাসনের অভাব, কালোটাকা ও পেশিশক্তির দাপটে সব সরকারের সময়েই জনগণ অভিজাততন্ত্রের বাস্তবতা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। সরকারপ্রধান জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হলেও মূলত অভিজাত শ্রেণির হয়েই কাজ করেন। তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নির্দেশে মন্ত্রিপরিষদ, আমলা, পদধারী ও সুবিধাভোগী সবাই নির্ধারিত হন। ফলে জনগণের সর্বময় ক্ষমতা নির্ধারিত হয় সরকারপ্রধান দ্বারা, তাঁর মর্জিমাফিক।
কথা ছিল অভিজাততন্ত্রের মূলোৎপাটন হবে রাষ্ট্রের তিন বিভাগ—আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের কার্যকর ও গতিশীল উদ্যোগে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তিনটি বিভাগই বহুলাংশে অভিজাততন্ত্রের করায়ত্ত। আইন বিভাগে জনগণের প্রতিনিধিরূপে যাঁরা নির্বাচিত হয়ে আসেন, তাঁদের সিংহভাগই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অভিজাততন্ত্রের পক্ষে কাজ করেন। জনকল্যাণমুখী আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের চেয়ে তাঁরা আইন প্রণয়নের সময় সংকীর্ণ ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে যেতে পারেন না। তাঁদের আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় জনগণের মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকে না।
মন্ত্রিসভা আইনের খসড়া বিল তৈরি করে সংসদে পাঠায়। মন্ত্রিসভার আইনের খসড়া করে দেন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট আমলারা। সংসদে জনপ্রতিনিধিদের বেসরকারি বিল উত্থাপনের সুযোগ থাকলেও তাঁরা তা করেন না। কালেভদ্রে বেসরকারি বিল উত্থাপন হলেও তা দ্রুতই বাতিল হয়ে যায়। ফলে জনগুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে আইন প্রণয়ন হয় না। অনেক সময় আইন ত্রুটিপূর্ণভাবে পাস হয়। ফলে সংসদে অনুমোদিত আইনে জনগণের প্রত্যাশা থাকে উপেক্ষিত।
বাজেট প্রণয়নে জনগণের ভূমিকা কতটুকু
জাতীয় বাজেট অনুমোদনের ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের বাজেট নিয়ে কার্যকর আলোচনার সুযোগ থাকে না। জনগণের জন্য যে বাজেট, সেখানে জনগণের মতামত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে জাতীয় বাজেট হয়ে দাঁড়ায় মন্ত্রণালয়ের বাজেট। বাজেটের প্রদত্ত রাজস্ব–সুবিধা চলে যায় প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ব্যবসা স্বার্থে। আর্থিক বিষয়াদির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ ও তদারকির জন্য সংসদে মন্ত্রণালয় ও আর্থিক বিষয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি রয়েছে। কিন্তু সেসব কমিটির চেয়ারম্যান ও সদস্যদের খুব কমই জনস্বার্থে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তা ছাড়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হলেও সরকারের মন্ত্রী-সচিবকে জবাবদিহির মধ্যে আনার আগ্রহ দেখা যায় না। এ অনাগ্রহের পেছনে বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর চাপ থাকে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি তদারক করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এর ফলে সরকারি দলের মন্ত্রী, সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্য, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, আমলা ও অন্যান্য ক্ষমতাধর ব্যক্তি বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
বিচার বিভাগের যে স্বাধীনভাবে বিচার করার ক্ষমতা প্রয়োগ করার কথা, অভিজাততন্ত্রের চাপে তা–ও থেকেছে উপেক্ষিত। দশকের পর দশক সরকারি কাজে অনিয়ম, দুর্বলতা, অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি অভিযোগের স্বাধীন তদন্ত, বিচার ও রায় না হওয়ার কারণে অভিজাততন্ত্র আরও জেঁকে বসেছে। বিচারকের নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যমান্য নিয়োগ বিধিমালা দশকের পর দশক ধরে মানা হয়নি। স্বাধীন বিচারের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে। স্বাধীন বিচার বিভাগ যদি আইন বিভাগের সঙ্গে পারস্পরিক বোঝাপড়ায় কাজ করতে পারত, তাহলে জনগণের শাসন, জনগণের আইন ও তার প্রয়োগ অনেক ভালোভাবে হতে পারত।
নির্বাহী বিভাগ অভিজাততন্ত্রের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে যথেচ্ছভাবে। বিভিন্ন খাতে সরকারের নীতি, কৌশল ও পদক্ষেপ নির্ধারিত হয়েছে প্রভাবশালীদের চাপে, দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর প্রভাবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় জনগণের কল্যাণের নামে তথাকথিত প্রকল্প তৈরি করে, অতি উচ্চ ব্যয় দেখিয়ে, পরিচিতদের টেন্ডারপ্রক্রিয়ায় কাজ দিয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করেছে। প্রকল্প থেকে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায়নি। প্রকল্প নেওয়ার জন্য সরকারের নীতি ও কৌশল সাজানো হয়েছে। আবার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থের অভাবে কাজ না হওয়ায় জনগণ বঞ্চিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ, সামাজিক সুরক্ষার অনগ্রসরতার কথা বলা যায়।
শোষণমূলক উন্নয়ন কাঠামো
বিগত দশকগুলোতে যে অপচয়মূলক ও শোষণমূলক উন্নয়নকাঠামো চালু হয়েছে তাতে জনগণের যে কিছুই উন্নয়ন হয়নি, তা নয়। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বিপুল অর্থের ব্যবহারে ‘চুইয়ে পড়া’ (ট্রিকল ডাউন) অর্থনীতি তৈরি হয়েছে, যা আংশিক হলেও জনগণের কাজে লেগেছে। তবে এ বিপুল উন্নয়ন ব্যয়ের মাধ্যমে জনগণের উপকার হতে পারত আরও বহুগুণ। বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে সরকার, আমলা, প্রশাসন ও ব্যক্তি খাতের একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী জনগণের উন্নয়নে কাঠামো নির্ধারণের দায়িত্ব কুক্ষিগত করেছে। এ কাঠামোতে প্রকৃত জনকল্যাণমুখী পরিবর্তন অসম্ভব। অভিজাততন্ত্রের কাঠামো ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন পছন্দ করে, বিকেন্দ্রীকরণ অপছন্দ করে। এ কাঠামোর সুবিধাভোগীরা স্থানীয় সরকারের হাতে বেশি ক্ষমতা দিতে চান না; জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করুন কিংবা স্থানীয় পর্যায়ে রাজস্ব উত্তোলন ও ব্যবহার করা হোক—এসব তাঁরা চান না। তাঁরা কেন্দ্রে বসে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চান।
প্রত্যাশা ছিল, দেশ অভিজাততন্ত্রের কাঠামো ভেঙে জনগণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হবে। রাজনৈতিক কাঠামোতে সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে; অর্থ ও পেশির দৌরাত্ম্য দূর হবে; রাজনৈতিক দলগুলোয় অর্থের অযাচিত ব্যবহার বন্ধ হবে; তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাবে স্বচ্ছতা আসবে। কেউ অর্থের বিনিময়ে পদ–পদবি বা টেন্ডার ইত্যাদি করায়ত্ত করতে পারবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নেতৃত্ব নির্ধারিত হবে নির্বাচনের মাধ্যমে; দলীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থে রাষ্ট্রকাঠামোর ব্যবহার হবে না।
প্রত্যাশা ছিল, অভিজাততন্ত্র রুখতে আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং শাসন বিভাগে মৌলিক পরিবর্তনের ব্যাপারে ঐকমত্য হবে। বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনের যেসব প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলো করেছে এবং ভবিষ্যতে করবে বলে অঙ্গীকার করেছে, সেখানে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার অনুপস্থিত। এর অর্থ, জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের প্রচলিত পন্থাই বহাল থাকবে; অভিজাত গোষ্ঠী, বিশেষত কয়েকটি পরিবার ও করপোরেট গোষ্ঠীর প্রতিনিধি, দেশি-বিদেশি স্বার্থগোষ্ঠী আগামী দিনেও সংসদে, সরকারে এবং বিচারপ্রক্রিয়ায় তাদের প্রভাব অব্যাহত রাখার সুযোগ পাবে।
জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধি—
স্থানীয় জনগণের প্রতিনিধি, শ্রমিক-কৃষকের প্রতিনিধি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি, নারীর প্রতিনিধি, যুব-যুবার প্রতিনিধি, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, প্রবাসীদের প্রতিনিধি, তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধি—আগামী দিনেও বহুলাংশে উপেক্ষিত থাকবে সংসদে, স্থানীয় সরকারে এবং অন্যান্য নির্বাচিত কাঠামোয়। এ উপেক্ষা দৃশ্যমান হবে আইন প্রণয়নে, সরকার পরিচালনায়, স্থানীয় সরকারের কর্মকাণ্ডে এবং এমনকি বিচারিক প্রক্রিয়ায়। এ দেশের কি অভিজাততন্ত্র থেকে মুক্তি নেই?
লেখক: গবেষণা পরিচালক, সিপিডি



