Originally posted in ঢাকা মেইল on 4 January 2023
রিজার্ভ কমে যাওয়া, ডলার সঙ্কট, জ্বালানি সঙ্কট, মূল্যস্ফীতিসহ নানামুখী সঙ্কটে কেটেছে ২০২২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি। ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে পড়ে। আকস্মিকভাবে বেড়ে যায় ডলারের দাম। শুরু হয় সঙ্কট। এরমধ্যে জ্বালানি সঙ্কট ছিল চরমে। এসব সঙ্কটের বেশিরভাগই এখনো রয়ে গেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মূল্যস্ফীতির ধাক্কা। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ।
এত চাপ মাথায় নিয়ে শুরু হওয়া নতুন বছরের (২০২৩) অর্থনীতি কেমন যাবে? এ বিষয়ে ঢাকা মেইলের সাথে কথা হয় কয়েকজন অর্থনীতিবিদের। নতুন বছরে অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি কিছুটা উন্নতির সম্ভাবনাও দেখছেন তারা।
২০২৩ সালকে সংকট মোকাবেলার বছর হিসেবে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, এটা তো সঙ্কট মোকাবেলার বছর হবে। এই সঙ্কট বাড়তে পারে যদি ইউরোপে একটা বড় ধরনের মন্দা আসে। গত বছর বৈশ্বিক একটা সঙ্কট গেছে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, ডলার সঙ্কট বেড়েছে। আমাদের দেশের এক্সপোর্ট ভালো ছিল। এ বছর এক্সপোর্টটাও ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। কিছুটা হয়তো রিলিজ আসতে পারে যদি আন্তর্জাতিকভাবে দ্রব্যমূল্য কমে। ডলারের দাম আন্তর্জাতিকভাবে কিছুটা কমেছে। ওই দিক থেকে হয়তো কিছুটা সুবিধা হতে পারে। কিন্তু সেটার উপর ভরসা করে থাকা ঠিক হবে না।
কিছু পদক্ষেপ নিলে সমস্যা সমাধান হবে বলে আশাবাদী এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, সরকারকে কিছু বিষয় ভেবে দেখতে হবে। সঙ্কট মোকাবেলার জন্য সরকার যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে সেগুলো সঠিক ছিল, যেমন সরকারি ব্যয় অপচয়কেন্দ্রিক। সাশ্রয়ের কথা যদিও বলা হয়েছে কিন্তু মোটা দাগে এর তেমন কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। সরকারের পদক্ষেপ ঠিক আছে কিন্তু এর বাস্তবায়ন হচ্ছে কতটুকু? বাস্তবায়নে যেতে হবে।
তিনি বলেন, আরেকটা বিষয় হচ্ছে, সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো সমাধান না করে সঙ্কটটাকে বাড়িয়েছে। এর মধ্যে একটা হচ্ছে- গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের আশীর্বাদে মুদ্রা বিনিময় হারের একটা সিস্টেম করা হয়েছে। যার ফলে ডলার সঙ্কট আরও গভীর হয়েছে, রেমিটেন্সকে ব্যাপকভাবে আঘাত করেছে। আবার ধরেন লোডশেডিংয়ের ক্ষেত্রে বলব, কিছু কেন্দ্রে ডিজেল সাশ্রয়ের জন্য উৎপাদন বন্ধ করা হয়েছে। এর ফলে লোডশেডিংয়ে সাশ্রয় হলো ঠিকই কিন্তু উদ্দেশ্য তো ছিল বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা কমানো। কিন্তু সেখানে আমাদের অর্থনীতি যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, উৎপাদন ব্যাহত হয়, তাহলে তো এটা হিতে বিপরীত হওয়ার মতো অবস্থা। যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিন্তু সঠিক ছিল না সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
জাহিদ হোসেন বলেন, কিছু পদক্ষেপ যেটা নেওয়ার দরকার ছিল কিন্তু নেওয়া হয় নাই। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আর্থিক খাতের সুব্যবস্থাপনা। বিশেষ করে আর্থিক খাতে যে বিশৃঙ্খলা আছে, সেটা বন্ধ করার ব্যাপারে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখিনি। বরং উল্টো পথে চলেছে। যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বা নেওয়া যায় সেগুলোর দিকে সরকারকে মনযোগ দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ২০২৩ সালের অর্থনীতি আশা-নিরাশার মধ্য দিয়ে যাবে। এটা নির্ভর করছে গ্লোবাল সিনারির ওপর। আর ইকোনোমিক ম্যানেজমেন্ট আমরা কি রকম করতে পারি তার ওপর। জ্বালানি সঙ্কট বলতে আমরা না কিনতে পারলে সেটা সঙ্কট। বাংলাদেশ জ্বালানি কিনতে পারবে না তা না। অপচয়গুলো যদি বন্ধ করতে পারি। সব থেকে বেশি যেটা সমস্যা সেটা হচ্ছে অর্থপাচার।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের সঙ্কটের একটা অন্যতম কারণ হচ্ছে অর্থপাচার। অর্থপাচার তো আর বাংলাদেশি টাকায় হয় না। এটা হয় ডলারে। যার কারণে মার্কেটে ইউএস ডলারের চাহিদাটা বাড়ছে। বাড়ার কারণে বাইরে ডলারের দাম ১১০-১১২ টাকা। আর সরকারের রেট হচ্ছে ১০৫ টাকা। এ কারণে রেমিটেন্স আসে ভিন্ন পদ্ধতিতে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, শান্তি শৃঙ্খলা। ধনী লোকেরা বিশৃঙ্খলাকে খুব ভয় করে। তারা কিন্তু সিকিউরিটি ফোবিয়ায় ভোগে। তারা মার্কেট সিস্টেমের বাইরে লেনদেন করছে। এগুলো না থাকলে সঙ্কটটা হতো না। বাংলাদেশে এখনো এটা ম্যানেজ করার অবস্থায় আছে। আমরা আশাবাদী ২০২৩ সাল নিয়ে।
২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত অর্থনীতিতে ২০২২ সালের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকতে পারে বলে মনে করছেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ক্যালেন্ডারের প্রথম অংশ জানুয়ারি টু জুন অর্থনীতির যে অবস্থা যাচ্ছে তারই ধারাবাহিকতা থাকতে পারে। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়া লাগতে পারে। যদিও এর ভেতরে রফতানি কিছুটা বেড়েছে। রেমিটেন্সের ফ্লো কিছুটা বেড়েছে। তাও আসলে এগুলো এখনো বিপজ্জনক মাত্রায় রয়ে গেছে। রফতানির ধারাটা হয়তো অব্যাহত থাকবে। রেমিটেন্সের ব্যাপারটা এখনো অনিশ্চিত। মূল্যস্ফীতিও আসলে খুব সীমিত হারে কমছে। প্রথম অর্ধবছরে রিজার্ভের পরিস্থিতি আরও কিছুটা দুর্বল হবে। ফলে প্রথম অর্ধবছরটা খুব স্বস্তিকর যাবে বলে মনে হয় না। জ্বালানি চ্যালেঞ্জটা থাকবে। শীতকাল চলে গেলে আবার চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। ফলে সেটাকে হ্যান্ডেল করাটাও একটা চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, বছরের দ্বিতীয় সেশনে পরিস্থিতির যদি কিছুটা পরিবর্তন হয়, জ্বালানির মার্কেট যদি ঘুরে দাঁড়ায় বা যুদ্ধের ক্ষেত্রে যদি ইতিবাচক পরিবর্তন আসে, ডলার যদি কিছুটা দুর্বল হয়, তাহলে হয়তো আমদানি ব্যয় কিছুটা কমে আসবে। সব মিলে এই বছরটাও আসলে সরকারকে এক ধরনের নিম্ন প্রবৃদ্ধির ভারসাম্য কাটানোর মধ্যদিয়ে যেতে হবে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার সুযোগ কম।