Published in মানবজমিন on Sunday 21 June 2020
এবারের বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়াকে স্বাধীনতার চেতনা পরিপন্থি বলে মনে করেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও গণনীতি বিশ্লেষক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি মনে করেন, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ায় নাগরিকদের সমান সুযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটেছে। বাজেট পরবর্তী অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি ও আগামীর চ্যালেঞ্জ নিয়ে ডিফারেন্ট অপিনিয়ন পোডকাস্টে মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন সিপিডি’র প্রথম নির্বাহী পরিচালক ও বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আগামী দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রধান দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। একটি স্বাস্থ্যগত আর অন্যটি কর্মসংস্থান ক্ষেত্রে। সাক্ষাৎকারের শেষ অংশ প্রকাশিত হলো আজ-
প্রশ্ন: আপনার লেখাতে পড়েছিলাম, বিভিন্ন দেশে পট এবং নটের পরিবর্তন হতে পারে। একটু ব্যাখ্যা করবেন কি?
আমি বলেছি কারণ হলো যেই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে মানুষ যাচ্ছে। এই অভিজ্ঞতা তো শেষ পর্যায়ে মানুষের মনোভাবের প্রকাশের ভিতরে প্রতিফলিত হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে দেখুন এই মুহূর্তে ওই কালো মানুষটি মারা যাওয়ার ফলে যে ধরনের আন্দোলন সংগ্রাম চলছে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপেও হচ্ছে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য, নিপীড়নের বিরুদ্ধে। এমন কি রাষ্ট্রের ভূমিকা অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা সম্বন্ধে যে আলোচনা উঠছে। এটাতো এক ধরনের নতুনত্ব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নভেম্বর- ডিসেম্বরে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে যার ফলাফল কিছু দিন আগেও অনেকে বলতো নিশ্চিত দ্বিতীয়বার নির্বাচিত। এটা কি এখন বলতে পারছে? অর্থাৎ এই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন। ইউরোপের দিকে তাকিয়ে দেখুন একই রকম হচ্ছে। এই সাম্প্রতিককালে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে, এমন কি লেবানন থেকে শুরু করে অন্যান্য দেশে এগুলি হচ্ছে। সব জায়গাতে নতুন সামাজিক শক্তির উত্থান আমরা লক্ষ্য করছি। এই সামজিক শক্তি প্রথাগত রাজনৈতিক শক্তি না। অর্থাৎ যে দলীয় রাজনীতি ছিল সেই দলীয় রাজনীতিকে অতিক্রম করে একটি সার্বজনীন জাতীয় চেতনাকে সামনে নিয়ে আসছে। এটা শেষ পর্যায়ে গিয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার উপর প্রতিফলিত হয়। সেই চিন্তা থেকেই বলেছি পট এবং নটের পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের টাকা পাচার এক ধরনের রোগে পরিণত হয়েছে। আপনারা বলছেন, কাগজ লিখছে, মিডিয়ায় বলছে। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। কেন এই অবস্থা?
আমি এটাকে চরিত্রের অংশ হিসেবে দেখি এখন। অর্থাৎ আমরা যেই ধরনের নীতিমালা দেই অথবা যে ধরনের নীতিমালা কার্যকর করি, যে ধরনের মূল্যবোধকে সামনে তুলে ধরতে চাই, যে সমস্ত মানুষগুলোকে সামনে নিয়ে আসতে চাই, সেগুলো থেকেই এটা সোজাসুজিভাবে যুক্ত। এবার বাজেটে ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করতে পারবেন। এমনকি কোনো সংস্থা এটা নিয়ে কোনো কথা তুলবে না। এটা যদি অবৈধ উপায়ে উপার্জন করে থাকেন, মাদক চালান দিয়ে করে থাকেন, এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে না। এটা যদি অস্ত্র ব্যবসা দিয়ে করে থাকেন সেটা নিয়েও হবে না। চোরাচালান, মানবপাচার দিয়ে করে থাকলেও হবে না। টাকাটা থাকলেই হলো। ১০ শতাংশ জমা দিবেন। যদিও আমি আদৌ মনে করি না, কেউ কালো টাকা জমা দিবে। এটা দিয়ে সরকার বদনামটা নিলো, আসলে টাকা পাবে না। এটাকে অন্য রকম করা যেত। সার্বজনীন করোনার জন্য তহবিল তৈরি, সেখানে টাকা দিলে কর মওকুফ করে দেয়া হবে। সাউথ আফ্রিকাতে করেছে এটা। কর মওকুফ করার ব্যবস্থা করলে শিশুরা স্কুলের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে, আমাদের মত মানুষরা ২/৩ দিনের মাইনা বাঁচিয়ে, সরকারি কর্মচারী, গ্রামের মানুষ অনেকেই এখানে হয়তো টাকা জমা দিতো। এতে এক ধরনের রাজনৈতিক পূণ্য জীবনের জন্ম হতো। পুরো দেশকে নিয়ে এটা মোকাবিলা করার ব্যাপার। তার বদলে কিছু অন্যায়কারীদের সুযোগ দিলেন। আপনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনার বিরুদ্ধে সুযোগ দিলেন। অর্থাৎ সংবিধানে সব নাগরিকের সমান সুযোগ সেটাকে আপনি এখানে ব্যত্যয় করলেন। এরপর যখন আপনি ভালো কথাগুলো বলেন, তখন তা কালো হয়ে যায়। আমি মনে করি এই উদাহরণগুলো দেশের ভিতরে খুব জোরদারভাবে এই টাকা পাচার ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাদের ব্যবস্থা নেয় না। টাকা পাচারের সবচেয়ে বড় বার্তা আমাদের দেয় সেটা হলো যারা ধনী বিত্তশালী তারা কি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে বিশ্বাস করে না, যে তারা বাংলাদেশ থেকে টাকা অন্য দেশে নিয়ে গিয়ে বাড়ি-ঘর বানিয়ে থাকে। তাদের সন্তানরাও থাকে না। এটা কিভাবে সম্ভব। যারা খেটে খাওয়া মানুষ, তাদের পরিশ্রমের বাংলাদেশ। তারা এটা দেখে নিঃসন্দেহে উদ্যেগ বোধ করে। এমনকি তাদের দেশপ্রেম নিয়েও চিন্তা হয়।
প্রশ্ন: অর্থনীতির যে অবস্থা। এই মুহুর্তে কি ৭টি মেগা প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা দরকার ছিলো? নাকি অন্য কোনো প্রকল্প নেয়া উচিত ছিল যেখানে মানুষকে বাঁচানো যায়।
যে মেগা প্রকল্পগুলো নেয়া হয়েছে। আমি মনে করি বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য এগুলো প্রয়োজন। আমি মেগা প্রকল্পগুলোর উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয়তার যুক্তিকথা নিয়ে কথা বলি না। এটা কিভাবে অর্থায়ন হতে পারতো, বিকল্প কি সুযোগ ছিল, সেটা নিয়ে ভিন্ন আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এগুলো দরকার। এবং এগুলো আমাদের তাড়াতাড়ি শেষ করাও দরকার। ৫ বছরের প্রস্তুতিকালীন সময়কে ১০ বছর বানিয়ে ২ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পকে ২০ বিলিয়ন করার যে প্রথা আমাদের দেশে আছে। সেই প্রথার বিরুদ্ধে আমি। কিন্তু এবারের অর্থবছর খুবই জটিল একটা অর্থবছর। আপনি ৫টা প্রকল্পকে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ টাকা দিয়ে দিবেন। আপনি এই মুহুর্তে একটি মাত্র প্রকল্প রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সেটাতে প্রকল্প ব্যয়ের প্রায় ১৪/১৫ শতাংশ চলে যাচ্ছে। এমন ধরনের পরিস্থিতি আপনাকে অন্যক্ষেত্রে মনোযোগের ক্ষেত্রে টেনে ধরে। আমি মনে করি এগুলোকে এই বছরের জন্য অত্যন্ত ভিন্ন চিন্তা করে করার সুযোগ ছিল। বিশেষ করে সম্ভাব্য অব্যবহৃত টাকাগুলো বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ছিল। এবং রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রেও ছিল। সেগুলোকে নিয়ে এসে আরো বেশি স্বাস্থ্যখাতে গ্রাম পর্যায়ে যে কমিউনিটি ক্লিনিক, যেগুলো খুব বড় সেবা দিতে পারে না। কারণ তাদের বিল্ডিংগুলোই আছে। আর কিছু নেই। সেগুলোকে আরো বেশি সরঞ্জামাদি দিয়ে আমরা করতে পারতাম বলে আমি মনে করি। আমাদের অবকাঠামোয় য এক ধরনের মানসিক প্রশ্ন আছে সেই অর্থে দৃশ্যমান প্রকল্পে। সেখান থেকে বের হয়ে এসে জনমানুষের যে ব্যক্তি জীবনের উন্নতির দুর্বল স্থানে মনোযোগ দিলাম না।
প্রশ্ন: আমরা সবাই অর্থনীতিতে সেবা করতে চাই। কিন্তু আমরা ভুলে যাই অর্থনীতি আমাদের সেবক হয়ে গেছে। যেমন ধরুন দরকার হলে প্রাণ যাক। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হবে। কি বলবেন?
অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য প্রাণ যাক বললে তো আর অর্থনীতি চাঙ্গা হবে না। এটাতো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। উদাহরণ হিসেবে ধরুন আপনি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি খুলবেন। গার্মেন্ট শ্রমিকরা যদি রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা যদি কেউ কেউ মারাও যায়। এটা যে আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে কি পরিমান প্রচার হবে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশি ভোক্তারা কি কাপড় নিবে? এইসব কাজ সুচিন্তিতভাবে করা দরকার। খুলে দিতে হবে ধাপে ধাপে এটাও আপত্তির কিছু নাই। কিন্তু ঐ ধাপে ধাপে খোলার জন্য স্বাস্থ্যবিধিকে কার্যকর করা প্রয়োজন। সেগুলো করার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক, সামাজিক শক্তিকে একত্রে করে করা সেটা আমরা করছি না। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ভিতরে সমন্বয় দেখছি না। দেখছি না বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারায় তারা ঠিকমত কাজগুলো করছে। এটাই দুশ্চিন্তার জায়গা। সেহেতু আপনি জীবনের বদলে জীবিকাকে বেছে নিচ্ছেন। তার ফলে আপনার জীবিকা যে ঠিক থাকবে আমি সেটা মনে করি না। এটা একটি ভ্রান্ত দ্বৈত চিন্তা। একটা আরেকটার বিরুদ্ধে নয়। একটা আরেকটার পরিপূরক হিসেবে দেখি।
প্রশ্ন: আগামী দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কি ধরনের চ্যালেঞ্জ আসতে পারে?
প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে করোনা থেকে বের হওয়া। স্বাস্থ্যঝুঁকিটাই সবচাইতে বড় বিষয়। এটাকে চিন্তা করে মধ্যমেয়াদী উত্তরণের প্রক্রিয়া আমাদের চিন্তা করতে হবে। আমাদের বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচি এসডিজি বাস্তবায়নের বিষয়টিও সবচেয়ে পিছিয়েপড়া মানুষগুলোকে ওখানে ঢুকাতে হবে। এটা হলো প্রথম বিষয়। করোনা থেকে বের হওয়া। দ্বিতীয়ত হলো, অর্থনীতিতে বড় সমস্যা দেখছি কর্মসংস্থান। বাংলাদেশে এক তৃতীয়াংশের মতো মানুষ বেকার ছিল। যদিও সরকারি হিসেবে ৪/৫ শতাংশ বেকারের সংখ্যা। ওটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না। কিন্তু এর ভিতরে ২০ শতাংশের মতো মানুষ গরীব ছিল। এখন এসব গরিবের সঙ্গে দেখছি আরো ১৫ শতাংশ মানুষ গরিব হয়ে গেছে। প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে যদি চলে গিয়ে থাকে। এবং এর সঙ্গে যদি এক তৃতীয়াংশের সঙ্গে ৪০/৪৫ শতাংশ মানুষ যায়। তাহলে এটা একটা খুবই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য। এটার জন্য শুধু মাত্র ওএমএসে চাল বিক্রি, কিছু আর্থিক অনুদান, কিছু ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছান এটা প্রয়োজন। তবে যথেষ্ট হবে না। কর্মসংস্থানের মহাপরিকল্পনাকে বড় বিষয় মনে করি। এখন একটা হলো করোনা মোকাবিলা অপরটি হলো কর্মসংস্থান। এই কর্মসংস্থানের বাজারে এমন মানুষগুলো ঢুকেছে। যাদের আমরা গত ১০ বছরের প্রবৃদ্ধির ধারায় সামনে প্রশিক্ষিত করেছিলাম। হঠাৎ করে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ বেকারে পরিণত হচ্ছে। তারা কিন্তু হাত পেতে সাহায্য চাওয়ার মানুষ না। এই মানুষগুলোকে আমরা কিভাবে সাহায্য করবো। তার জন্য ডেটাবজে তৈরি করবো। কিভাবে তারা নিবন্ধন করবে। যদি কোনো সামাজিক সুরক্ষা দেয়ার সুযোগ থাকে। তা কিভাবে পৌঁছাবো। এটাকে সবচাইতে বড় কর্মযোগ্য হিসেবে দেখতে হবে। করোনাকে মোকাবিলা করে উত্তরণ, জীবন রক্ষা। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে নব্য যারা গরিব হয়েছে তাদের সাহায্য করা।