Published in অর্থসূচক on Tuesday 9 June 2020
পরিস্থিতি মূল্যায়ন না করে দেওয়া হচ্ছে গতানুগতিক বাজেট
দেশব্যাপী মহামারি আকার ধারণ করেছে নভেল করোনা ভাইরাস। যার ফলে লণ্ডভণ্ড দেশের অর্থনীতি। ধস নেমেছে রপ্তানি আয়ে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেই আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট দিতে যাচ্ছে সরকার। এদিকে প্রস্তাবিত বাজেট তৈরির ক্ষেত্রে পরিস্থিতিকে মূল্যায়ন না করে বরাবরের মতো হিসেব মিলাতে ব্যস্ত বাজেট কর্তারা। রাজস্ব আহরণ, ব্যয় নির্ধারণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন সব ক্ষেত্রেই সরকার বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারির কারণে অর্থনীতিতে সৃষ্ট সংকটকে বিবেচনায় না নিয়ে টাকার হিসাব মিলিয়ে আগের ধারাবাহিকতায় একটি বাজেট তৈরি করা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার প্রভাব শিগগির যাচ্ছে না। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনা করেই বাজেটের বিভিন্ন খাতের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা জরুরি ছিল। কিন্তু বাজেটে যেভাবে রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে সেগুলো অর্জন করা একেবারেই অবাস্তব। কেননা, করোনার প্রভাবে অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ কারণে রাজস্ব আয় অনেক কমে গেছে। এর মধ্যে আরও বেশি রাজস্ব আহরণ সম্ভব নয়। এ বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সরকারকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, গতানুগতিক কর্মসূচির মধ্যে না থেকে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার এবং সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষার কথা চিন্তা করা উচিত।
তিনি বলেন, প্রতি বছরের চেয়ে এবারের বাজেটে মানুষের প্রত্যাশা ভিন্ন। তবে আয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারের চ্যালেঞ্জেও ভিন্নতা রয়েছে। মোটা দাগে এবারের বাজেটে ৪টি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হল- করোনায় সৃষ্ট স্বল্পমেয়াদি সমস্যার সঙ্গে মধ্যমেয়াদি কর্মসূচির সম্পর্ক স্থাপন, বাজেটে অর্থায়ন, প্রবৃদ্ধি নির্ভর উন্নয়ন চিন্তা বাদ দিয়ে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক মানুষের আয় বাড়ানো এবং বাজেট বাস্তবায়ন।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে সংশোধিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৫০০ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায় হতে পারে ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা কম। স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম আগের বছরের তুলনায় রাজস্ব আদায় কম হচ্ছে। গত জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) মনে করে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে। এ ঘাটতিকে বিবেচনায় না নিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। যা একেবারেই অসম্ভব বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
সূত্র জানায়, সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে দেশি-বিদেশি ঋণের ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভর করেছে। ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। করোনার কারণে বিভিন্ন দেশেও এখন মহামন্দা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় বহুজাতিক সংস্থা আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক সব দেশকেই জরুরি ঋণ দিচ্ছে। এর বাইরে অন্য সংস্থাগুলো ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা হারিয়েছে। ফলে তাদের কাছ থেকে ঋণ পাওয়া কঠিন হবে। একই কারণে দেশীয় উৎস থেকেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নতুন বছরে সরকারকে টাকার জোগান দেওয়া কঠিন হবে।
এদিকে এবার বাজেটে বরাদ্দ বাড়ছে স্বাস্থ্য, প্রতিরক্ষাসহ ৯টি খাতে। পাশাপাশি বরাদ্দ কমছে শিল্প, গৃহায়ন, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে। ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বের ভিত্তিতে উল্লিখিত খাতে পরিচালনা ও উন্নয়ন উভয়ে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও হ্রাস করা হয়েছে। করোনা ভাইরাস মোকাবিলা, ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও গরিব মানুষকে পুনর্বাসনে বেশি বরাদ্দ কাজে লাগানো হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট আগামী ১১ জুন জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। নতুন বাজেটের আকার হচ্ছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এই মোট ব্যয়ের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ৪.৭ শতাংশ, জনপ্রশাসন খাতে ৬.৮ শতাংশ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ৬.১০ শতাংশ, প্রতিরক্ষায় ৫.৪ শতাংশ, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় ৪.৯ শতাংশ ব্যয় করা হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে ৫.১ শতাংশ, জ্বালানি ও বিদ্যুতে ৪.৮ শতাংশ, শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে ১৫ শতাংশ, কৃষিতে ৩.৬ শতাংশ, পরিবহনে ১১.৪ শতাংশ, গৃহায়নে ব্যয় করা হবে ১.২ শতাংশ। আর বিনোদন সংস্কৃতি ও ধর্মতে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ, শিল্প ও অর্থনৈতিক খাতে শূন্য দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং বিবিধ খাতে ব্যয় করা হবে ২৯.৪৭ শতাংশ।
জানা গেছে, করোনা ভাইরাসের কারণে সবেচেয়ে বেশি গরিব মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে। প্রায় তিন কোটি নিম্ন আয়ের মানুষের রুটি-রুজিতে আঘাত করেছে। তাদের পুনর্বাসনের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। ফলে নতুন বাজেটে এ খাতে ব্যয় করা হবে ৩২ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অবশ্য চলতি বছরে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ হচ্ছে ৩১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। সব মিলে বরাদ্দ বাড়ছে ১ হাজার ১৬ কোটি টাকা।
এদিকে করোনা ভাইরাসের কারণে আগামী বছর স্বাস্থ্য খাতে অনেক পরিবর্তন আনবে সরকার। অতীতে স্বাস্থ্য খাতে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে এ বাজেট হবে অনেকটা করোনা মোকাবিলার বাজেট। ফলে আসন্ন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়বে ৫ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। এ খাতে মোট বরাদ্দ থাকছে ২৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ৫ দশমিক ১ শতাংশ। চলতি বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ হচ্ছে ২৩ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা।
কোভিড-১৯ কৃষি খাতেও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে ফেলছে। ফলে কৃষকদের টিকিয়ে রাখতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি থাকছে আগামী বাজেটে। কৃষক টিকিয়ে রাখতে পারলে খাদ্য নিয়ে সমস্যা হবে না। এজন্য নতুন বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ২ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ২ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। আসছে বাজেটে এ খাতে মোট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা, এটি মোট বাজেটের ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৭ হাজার ২৩ কোটি টাকা।