Originally posted in Kaler Kantho on 17 December 2023
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আইএমএফের ঋণ কতটা স্বস্তি দেবে। সংস্কার কতটা বাস্তবায়ন হবে। সংকট মোকাবেলায় করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিরাজ শামস
কালের কণ্ঠ: আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ায় বাস্তবে বাংলাদেশ কিভাবে লাভবান হবে?
মোস্তাফিজুর রহমান: প্রতি মাসে গড়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হচ্ছে।
সেখানে আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৯০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সরাসরি তেমন ভূমিকা রাখতে পারবে না, এটা ঠিক। আইএমএফের ঋণ মাত্র দুই মাসের জন্য সহায়ক হতে পারে। তবে এই ঋণের লাভকে ভিন্নভাবে দেখতে হবে।
দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ পাওয়ার ফলে এটা প্রমাণ হয়েছে যে আইএমএফের ঋণের শর্তে অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো করেছে।
যদিও রাজস্ব ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। ব্যাংক আইনসহ অন্যান্য আইনের সংস্কারসহ বেশ কিছু শর্ত বাংলাদেশ পালন করে চলছে। কৃচ্ছ্রসাধন ও রাজস্ব বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেরও উদ্যোগ আছে।
এসব পদক্ষেপের কারণে আইএমএফ মনে করে বাংলাদেশ সঠিক পথে আছে।
এই ঋণ পাওয়া মানে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা ইতিবাচক সংকেত পাওয়া। এটি অন্যান্য সংস্থার ঋণ পেতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। বিভিন্ন সংস্থা থেকে যে বাজেট সহায়তা আশা করা হচ্ছে, তাও চলে আসবে। এদিক থেকে লাভবান হচ্ছে বাংলাদেশ।
কালের কণ্ঠ: শর্ত অনুযায়ী সংস্কারের উদ্যোগ ও প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন বর্তমান প্রেক্ষাপটে কতটা সম্ভব?
মোস্তাফিজুর রহমান: বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন হবে, এমনটি জোর দিয়ে বলা যায় না।
রাজস্ব বোর্ড ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংস্কারে এর আগেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে অনুঘটক যোগ হয়েছে। এবার শর্ত বাস্তবায়ন না করলে নেতিবাচক সংকেত যাবে।
এই শর্ত বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সমর্থন ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর ভূমিকা লাগবে। সেটি কতটা সম্ভব হবে তা সময় বলে দেবে।
অতীত দেখলে মনে হয়, সঠিক কর্মসূচি গ্রহণে শৈথিল্য ও বাস্তবায়নে ধীরগতি ছিল। সংস্কারের ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা আছে। ব্যাংক কম্পানি আইন সংস্কারে পরিচালকরা টানা ১২ বছর থাকতে পারবে—এমন একটি বিষয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কর ও ঋণখেলাপির সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তি জড়িত থাকায় সেটা কতটা বাস্তবায়ন হবে, এ বিষয়ে শঙ্কা আছে। এ ক্ষেত্রে অনেক শক্তিশালী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শূন্য শৈথিল্য দেখাতে হবে এবং নজরদারি বাড়াতে হবে।
অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, পদক্ষেপ নেওয়া হলেও পরিপূর্ণভাবে কার্যকর হয়নি। শর্ত পালন করতে কর ও ঋণখেলাপি কমাতে পারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও শূন্য সহিষ্ণুতা। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রাবিনিময় হার ও সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। তবে যেভাবে হওয়ার কথা তার কতটুকু হবে, বলা যাচ্ছে না। যদিও আইএমএফ বলছে, শক্তিশালীভাবে শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে।
কালের কণ্ঠ: রাজস্ব ও ব্যাংক খাত সংস্কার নিয়ে আপনার পরামর্শ কী?
মোস্তাফিজুর রহমান: আইএমএফের সংস্কার কর্মসূচির মধ্যে রাজস্ব ও ব্যাংক খাতে সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে কর ও ঋণখেলাপি কমিয়ে আনার কথা বলছে আইএমএফ। আমরাও একই কথা বলে আসছি। তবে সংস্কার করতে গিয়ে কিছু ভর্তুকি ও সামাজিক সুরক্ষাগুলো যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সামস্টিক অথনীতি উন্নত করার কথা বলছে আইএমএফ। আমরা মনে করি, এটি সঠিক পরামর্শ। বিশেষ করে কর জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে। এটা বাড়ানো সম্ভব না হলে ঘাটতি বাজেট বাড়িয়ে দিয়ে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। এতে বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণ বড়বে।
আইএমএফ বলছে, নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। এটি আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য করা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো এবং আইন প্রণেতারা সংস্কারের পথে হাঁটছে। তার পরও ভালোভাবে বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা আছে। আমি বলব, এ ক্ষেত্রে বড় বাধা এলেও এগিয়ে যাওয়া উচিত।
কালের কণ্ঠ: শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থান এবং রিজার্ভ সংরক্ষণের শর্ত পূরণ কিভাবে সম্ভব হবে?
মোস্তাফিজুর রহমান: করখেলাপির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান ও তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিথিল হলে চলবে না। এখন পর্যন্ত রাজস্বের ক্ষেত্রে আইএমএফের টার্গেট পূরণ হয়নি। রিজার্ভ ঠিক রাখতে হলে দেশের অর্থ যেন পাচার না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স সঠিকভাবে আনতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের সময় হয়েছে। এই পদক্ষেপ ইতিবাচকভাবে নিতে হবে। তবে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, নির্বাচনের পর সংস্কার বড় আকারে দেখা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী রাজনৈতিক অঙ্গীকার গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখন অর্থনীতি বড় ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তায় আছে।
কালের কণ্ঠ: আইএমএফের ফর্মুলাভিত্তিক জ্বালানির দর সমন্বয় হলে এর প্রভাব মোকাবেলায় কী করণীয়?
মোস্তাফিজুর রহমান: জ্বালানির দাম বাজারভিত্তিক হলে ভালো হবে। কারণ এত দিন নিয়ন্ত্রণে রেখেও তেমন সুবিধা পাওয়া যায়নি। যখন জ্বালানির দাম কম ছিল তখন মুনাফা করেছে। আবার যখন দাম বাড়ছে তখন তা সমপরিমাণ হয়নি। আইএমএফের ফর্মুলা অনুযায়ী, বাজারমূল্যের সমন্বয় করাই ভালো। তবে এ ক্ষেত্রে শুল্ক কত রাখা হবে, সেটা বিবেচনা করে করতে হবে। যখন দাম বাড়বে তখন শুল্ক ছাড় দেওয়ার প্রয়োজন হবে। এ ক্ষেত্রেও ঝুঁকি আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ওঠানামার সময় সমন্বয় করে মানুষকে সহনীয় মূল্যে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
তবে কৃষি ও সামাজিক সুরক্ষায় ভর্তুকিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আইএমএফ এখন ঢালাওভাবে ভর্তুকি রহিতকরণ ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে কাটছাঁট থেকে সরে এসেছে। তারাও সামাজিক সুরক্ষা অব্যাহত রাখার কথা বলছে। তবে ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষেত্রে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনমতো দেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করতে হবে; যাতে নির্দিষ্টভাবে যৌক্তিক মানুষ পায়।
কালের কণ্ঠ: চলমান অর্থনৈতিক ও ডলার সংকট মোকাবেলায় আপনার পরামর্শ কী?
মোস্তাফিজুর রহমান: বর্তমানে বড় সমস্যা আর্থিক হিসাবের। বিভিন্ন ধরনের ঋণের অর্থ পরিশোধ করার চাপ আছে। কাঠামোগত সমস্যা থাকায় বিনিয়োগ বাড়ছে না। এ কারণে রিজার্ভ বাড়ানো যাচ্ছে না। যদিও চলতি হিসাবের উন্নতি হয়েছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে অর্থনীতির দিক থেকে সার্বিকভাবে দেখলে উৎপাদন কমেছে, নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। এতে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আমদানি বাড়াতে হবে। রপ্তানি ও বিনিয়োগ বাড়াতে নজর দিলে কর্মসংস্থান বাড়বে। তা ছাড়া পাইপলাইনে থাকা ৪০ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দ্রুত ছাড় করার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
কালের কণ্ঠ: আপনাকে ধন্যবাদ।
মোস্তাফিজুর রহমান: কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ।