Originally posted in প্রথম আলো on 6 August 2024
বড় ক্ষতি ব্যবসা–বাণিজ্যে
দেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচক খারাপ অবস্থায় রয়েছে। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ জীবন চালাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন।
গত কয়েক দিনের সহিংসতায় দেশের ব্যবসা–বাণিজ্যের বড় ক্ষতি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ছোট ব্যবসায়ীরা। অর্থনীতিতে দীর্ঘ সময় ধরেই সংকট চলছিল। গত কয়েক সপ্তাহে চলা অস্থিরতা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করেছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এখন ব্যবসা-বাণিজ্য তথা সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, অর্থনীতিতে এখন দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে। একটি হলো সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করা। অপরটি হলো অর্থনীতিতে থাকা সংকটগুলোর সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া।
এক-দেড় বছর ধরে দেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচক খারাপ অবস্থায় চলে গেছে। বিশেষ করে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ক্ষয়িষ্ণু রিজার্ভ, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে গতি কম, চাহিদা অনুসারে শুল্ক-কর আদায়—এসব সূচক অর্থনীতিকে ভোগাচ্ছে। রয়েছে কর্মসংস্থান তৈরি করা ও বিনিয়োগের ঘাটতি। লম্বা সময় ধরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের কাছাকাছি রয়েছে। ফলে সাধারণ ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে জীবন চালাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনীতি এখন চরম খারাপ অবস্থায় আছে। অর্থনীতির শক্তিমত্তার জায়গাগুলো দুর্বল হয়ে গেছে। যেমন উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ক্ষয়িষ্ণু রিজার্ভ, ঋণের দায়দেনা, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়, নিম্ন বিনিয়োগ। দ্রব্যমূল্যের কারণে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সুশাসন ও জবাবদিহির অভাব আছে। এসব বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।
ছোট ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত
তিন সপ্তাহ ধরে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছেন। এ আন্দোলনকে ঘিরে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ, সাধারণ ছুটি ঘোষণাসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছিল। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ছোট ব্যবসায়ীরা। পাড়া-মহল্লার দোকান, রেস্তোরাঁ, ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের অনেকে দোকানপাট খুলতেই পারেনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, দেশে ২৫ লাখের বেশি খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ী আছেন। তাঁদের বেশির ভাগই লোকসানে পড়েছেন।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি
অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের দাম অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ভুগছেন। গত কয়েক সপ্তাহের অনিশ্চয়তায় অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত ১২ মাসের মধ্যে ৭ মাসই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। গত বছরের আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে উঠেছিল, যা ছিল অর্থবছরে সর্বোচ্চ।
সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা অর্থবছরওয়ারি হিসাবে অন্তত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।
রিজার্ভ সংকট
গত এক বছরের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত (রিজার্ভ) প্রায় এক হাজার কোটি ডলারের মতো কমেছে। সর্বশেষ জুলাই মাস শেষে আইএমএফের গণনাপদ্ধতি অনুসারে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৮ কোটি ডলার। এক বছর আগেও তিন হাজার কোটি ডলারের বেশি রিজার্ভ ছিল।
প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়—দুটি খাতই রিজার্ভ বাড়ানোর প্রধান উৎস। কিন্তু প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ে বড় কোনো অগ্রগতি নেই। এদিকে ডলারের দামও বাড়তি। অন্তত ১১৮ টাকা দরে ডলার কিনে আমদানি ও অন্যান্য বৈদেশিক দায় মেটাতে হচ্ছে। ফলে রিজার্ভের মজুত থেকে বেশি ডলার খরচ হচ্ছে।
রাজস্ব আদায়ে শ্লথ গতি
অর্থনীতির আকার বাড়লেও রাজস্ব আদায় তেমন বাড়েনি। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত এখনো ১০ শতাংশের নিচে। পৃথিবীর সবচেয়ে কম রাজস্ব-জিডিপি অনুপাতের দেশের একটি বাংলাদেশ। বিদায়ী অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। সাম্প্রতিক অস্থিরতার কারণে শুল্ক কর আদায় তেমন একটা হয়নি। এনবিআরের কর্মকর্তারা মনে করেন, শুল্ক-কর আদায় গত বছরের জুলাই মাসের তুলনায় অর্ধেকে নামবে।
রাজস্ব প্রশাসনের সংস্কারের পাশাপাশি সহজে কর দেওয়ার ব্যবস্থাসহ পুরো রাজস্বব্যবস্থা অটোমেশন করার জন্য অনেক দিন ধরেই পরামর্শ দিয়ে আসছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদেরা।
আর্থিক খাত সংস্কার
গত কয়েক বছরে ব্যাংক খাতের দুর্বল ও ভঙ্গুর অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছে। ব্যাংক খাতে এখন ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকার মতো খেলাপি ঋণ আছে। অভিযোগ আছে, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া শত শত কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
ব্যাংক খাতে নানা ধরনের সমস্যা আছে। যেমন ঋণপ্রাপ্তিতে স্বজনপ্রীতি, ভুয়া কাগজে ঋণ প্রদান—এসব ব্যাংকের সমস্যার সমাধান জরুরি। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ব্যাংক খাতে পেশাদারি মনোভাব ও তদারকব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন।