Originally posted in প্রথম আলো on 4 May 2024
প্রতিষ্ঠানগুলোকে এতটা অকার্যকর করা হয়েছে, যা ৫৩ বছরেও ঠিক করা যাবে না: সেমিনারে বক্তারা
দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে এতটাই অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে যে দেশে কোনো দিন পরিবর্তন এলে এগুলো ঠিকঠাক করার কাজ ৫৩ বছরেও শেষ করা যাবে না। এ ছাড়া অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যাংক খাত এখন ভঙ্গুর। এ খাতে নিয়মনীতি করাই হচ্ছে দুর্নীতির প্রয়োজনে। আর দেশের সব ক্ষেত্রে জবাবদিহিতে ধস নেমেছে।
অরাজনৈতিক সংগঠন দ্য ঢাকা ফোরামের আয়োজনে আজ শনিবার ঢাকার ব্র্যাক সেন্টার ইনে অনুষ্ঠিত ‘রাজনীতি অর্থনীতি: বাংলাদেশ এখন’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। সেমিনার সঞ্চালনা করেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ।
সেমিনারে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জটিল অবস্থার মধ্যে আছে। এক বছর আগে আমরা বলেছিলাম, মূল সমস্যা সামস্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এই ফাঁকে নতুন করে এসেছে আরও দুই সমস্যা। তা হচ্ছে দায়দেনা পরিশোধের ঝুঁকি এবং প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে যাওয়া।’
রাজনীতিতে কম মাত্রার জবাবদিহিকে এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীর কুপ্রভাব খুব বেশি বেড়েছে। নাগরিকদের দুর্ভাগ্য যে এগুলো মোকাবিলা করার জন্য রাজনৈতিক জবাবদিহির অবস্থা নেই দেশে। বিরোধী দলের সমালোচনার সঙ্গে কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না, কিন্তু তারা দায়িত্ব পেলে সমস্যাগুলো কীভাবে মোকাবিলা করবেন, তা কিন্তু তাঁরা বলেন না।’
গত সংসদ নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের (বিএনপি) ২৭ দফা ও ৩১ দফা ভালো করে পড়েছেন বলে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তাঁদের উদ্দেশে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করেন। প্রশ্নগুলো হচ্ছে, ব্যাংক খাতের সমস্যা কীভাবে দূর করবেন? সরকার যা পারছে না, আপনারা কি তা পারবেন? আপনাদের আমলে যে দুর্নীতি হয়েছে, সে জন্য কি মাফ চেয়েছেন? লাখ লাখ মানুষ জমায়েত হয়েও তাঁরা হারিয়ে যান কেন? এসব জবাব না দিয়ে কীভাবে মানুষের আস্থা অর্জন করবেন?
‘আমরা গণতন্ত্রহীনতার ভেতরে পড়েছি’, এমন মন্তব্য করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘বিরোধী দল বলছে, সরকার ফেলে দেবে। ফেলে দিয়ে কী করবে, তা আর বলছে না। কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে তারা স্থানীয় নির্বাচনেও যাচ্ছে না। আগের চেয়ে দেশের মানুষ এখন অনেক সচেতন। এভাবে সম্পূর্ণভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে তারা কোন জগতে বসবাস করবে? রূপকল্প বাস্তবায়নে ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়েছে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনেরও পথে বাংলাদেশ। ভালো বিকল্প তৈরি করতে না পারলে মানুষ রাস্তায় নামবে না।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান মনে করেন, শুরুতেই গত ১৫ বছরের রাজনীতি ও অর্থনীতির একটা ভালো বিশ্লেষণ প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে গণতন্ত্রকে অত প্রাধান্য দিতে চায় না ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী। কেউ বলেন, দুর্নীতি থাকা সত্ত্বেও উন্নয়ন হয়েছে। আমার মতে, চিন্তার কাঠামোটা এভাবে তৈরি করাই ঠিক না।’
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, নতুন মডেলের মতো রাজনীতিতে নতুন বাস্তবতা দাঁড়িয়ে গেছে। দেশে নির্বাচনী বাস্তবতা অনুপস্থিত হয়েছে। শুধু গত ৭ জানুয়ারি নয়, ২০১৪ থেকেই এ প্রবণতা শুরু হয়েছে। ক্ষমতা হয়ে গেছে চূড়ান্তভাবে কেন্দ্রীভূত। আছে জবাবদিহির ঘাটতি।
অর্থনীতি পরিচালনায় তিনটি পদ্ধতিগত বৈশিষ্ট্য চোখে পড়েছে বলে জানান হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, একটি হচ্ছে উন্নয়নের অর্থায়ন ঋণনির্ভর হয়ে যাওয়া। অন্যটি হচ্ছে উন্নয়ন খরচের চরম অদক্ষতা বহুগুণ বেড়ে যাওয়া। আর তৃতীয়টি হচ্ছে সার্বিকভাবে জবাবদিহিতে ধস নামা।
ব্যাখ্যা করে হোসেন জিল্লুর রহমান আরও বলেন, ‘ব্যাংক খাতে নীতি পদক্ষেপ নেওয়াই হচ্ছে দুর্নীতির প্রয়োজনে। আবার যশোরে হাইটেক পার্ক করা হয়েছে, কিন্তু তা এখন ব্যবহৃত হচ্ছে কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে। অদক্ষ অর্থনৈতিক শাসনের পরিণতির জায়গাটি নিয়ে কথা বলা দরকার। আমার মতে, বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে একটি অগ্রহণযোগ্য, অনৈতিক ও মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী ভবিষ্যতের দিকে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক আসিফ নজরুল শুরুতেই বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে নির্বাচন বর্জনের যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে সিপিডিও ছিল। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের এ ধরনের বক্তব্য ‘অত্যাচারীকে আরও অত্যাচারী হতে এবং আরও একতরফা হতে সাহায্য করবে’ বলে মনে করেন আসিফ নজরুল। তবে তাৎক্ষণিকভাবেই সংশোধন করে দিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, নির্বাচন বর্জন নয়, বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তখন নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
আসিফ নজরুল দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের উদ্দেশে প্রশ্ন রাখেন, ‘গুম, বিচারহীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা না থাকা—এসব অত্যাচারকে আগে সমালোচনা করব নাকি একটা দল পরে ক্ষমতায় এসে কী করতে পারে, তার সমালোচনা করব? আর মানুষ রাস্তায় নেমে আসে না, তা কী করে বুঝলেন?’ তিনি নিজেই এর জবাব দিয়ে বলেন, ২০১৪ থেকে এ পর্যন্ত তিনটি গণ-আন্দোলন করেছে বিএনপি এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ৯০ শতাংশ আসনে বিরোধী দল জিতত বলে তাঁর ধারণা। মিয়ানমার, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া—এসব দেশের জনগণও তাদের সরকারকে পছন্দ করে না। তারপরও তারা ক্ষমতায় আছে। তাঁর আরও প্রশ্ন, ভুয়া নির্বাচন, অর্থ পাচার, গায়েবি মামলা দেওয়া—এগুলো কি রূপকল্পে ছিল?
পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে আসিফ নজরুল বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৫ বছরে ১২ জনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে কথা বলার অপরাধে। সামান্য কথার হেরফেরে নীল দলের একজনও শাস্তি পেয়েছেন? আর সাদা দল থেকে এখন কেউ নির্বাচন করার সাহস পান না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই এমন পরিস্থিতি। আগে হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়েও কথা বলা যেত। ১৭ বছরে শতাধিক বিচারপতি নিয়োগ পেয়েছেন। এখন ছাত্রসংগঠন থেকে সংবর্ধনা পাচ্ছেন বিচারপতি, কিছু বলতে পারছি?’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যেসব সংসদ নির্বাচন দেশে হচ্ছে, একে ইলেকশন না বলে বড়জোর সিলেকশন বলা যায়। ১৫ বছরে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমনভাবে অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে, কোনো দিন পরিবর্তন এলে এগুলোকে ঠিকঠাক করতে ৫৩ বছরেও শেষ হবে না।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অস্তিত্ব সংকটে রয়েছেন উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে আমার ঘাড়ে তো একটাই মাথা। তিনি আরও বলেন, তবে এটা ঠিক যে যারা ক্ষমতায় বসায়, তারা ক্ষমতা থেকে নামায়ও।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ অনলাইনে যুক্ত হয়ে বলেন, দেশে তিনটি সাজানো সংসদ নির্বাচন হয়েছে। আর ক্রমাগতভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে সিপিডির আরেক সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সুনির্দিষ্ট পথনকশা তৈরি করতে না পারলে মানুষকে আকৃষ্ট করা যাবে না। তিনি এ–ও বলেন, অর্থনীতির অর্জনগুলোকেও স্বীকার করে নিতে হবে। পাশাপাশি দ্বিতীয় প্রজন্মের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে বৈষম্য ও কর-জিডিপির হার বৃদ্ধি করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘প্রথমেই বলতে হবে অর্থনীতির এখনকার অবস্থা যে কাঠামোগত দুর্বলতার ফলাফল, তা আমরা স্বীকার করব কি না। এরপর বলা যায় দুর্নীতির কথা। রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে লাভবান হওয়ার প্রবণতা একশ্রেণির বড় ব্যবসায়ীর। এক অর্থে তারা যেন একটা ক্লাব বানিয়েছে এবং জনগণের সম্পত্তি ভাগ করে নিচ্ছে একশ্রেণির ব্যবসায়ীদের এই ক্লাব।’
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর আরও বলেন, ‘সংকট আওয়ামী লীগ-বিএনপির নয়। সংকট সবার। অর্থশাস্ত্রে পছন্দ বা বাছাই করার কথা বলা আছে। বাছাই করতে গেলে তো বাজার লাগবে। নিয়ন্ত্রক না থাকলে বাছাইটা করা হবে কীভাবে? রাজনীতির ক্ষেত্রেও বাছাই করতে দিতে হবে। সত্তরের নির্বাচনে জনগণ বাছাই করতে পেরেছিল বলেই একাত্তরে একটা দেশ পেয়েছিলাম।’
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘বছরে চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়বে বলে খবর দেখলাম। আরেকটা খবর দেখলাম, বিদ্যুতের ভর্তুকির ৮১ শতাংশই ক্যাপাসিটি চার্জ। অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে এটা দিতে হচ্ছে।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না বলেও মনে করেন আলী ইমাম মজুমদার।
অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, প্রধানত যে ব্যাংক খাত অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত, সে খাত এখন দুর্বল ও ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। তারল্যসংকট, খেলাপি ঋণের হার বৃদ্ধি এবং সুশাসনের অভাব এ খাতে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যাংকের পর্ষদের হাতে ঋণ অনুমোদনের দায়িত্ব আর থাকা উচিত নয় বলে তিনি মনে করেন।
আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ আরও বলেন, হল-মার্ক, বিছমিল্লাহ, পদ্মা ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত চুনোপুঁটিদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তবে দরকার বড়দের শাস্তির ব্যবস্থা করা।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সাবেক রাষ্ট্রদূত ইফতিখারুল আলম, শাহেদ আখতার, মাসুদ আজিজ, এম সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।