Originally posted in ইনকিলাব on 6 March 2023
অস্থিরতায় আর্থিক খাত
দেশের আর্থিক খাতের অস্থিরতা কাটিয়ে উটতে সরকার একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। বাংলাদেশে গত প্রায় এক বছরে ধরেই ডলার সঙ্কট চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভও নিম্নমুখী। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব ইতোমধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি প্রধান শিল্প ও উৎপাদন খাতে পড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে ডলার সংকটে কাঁচামাল আমদানি করতে না পারা এবং এরই মধ্যে সঙ্কটে পড়েছে ওষুধ শিল্প, সিমেন্ট খাত, হালকা প্রকৌশল শিল্প, চামড়া শিল্প এবং মুদ্রণ শিল্প। এ কারণে রফতানি আয়ে এরই মধ্যে ধস নেমেছে। পাশাপাশি দিনে দিনে টাকার অবমূল্যায়নের প্রভাবে দেশে খাদ্য, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ঘন ঘন বৃদ্ধি পাওয়ায় শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে এবং কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। একই সঙ্গে আমদানি-রফতানিতে ধীরগতি ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমায় রাজস্ব আয়েও প্রভাব ফেলেছে।
জানতে চাইলে ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেছেন, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা এবং কর্মসংস্থান এই দুইটি সূচক দিয়ে মন্দা পরিস্থিতি বোঝা যায়। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা যদি কমে যায় আর কর্মসংস্থান যদি না বাড়ে, তাহলে মন্দা তৈরি হয়। আমাদের মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। আর কর্মসংস্থান কাক্সিক্ষত মাত্রায় নয়। প্রবৃদ্ধিও চাপের মুখে। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় কমছে। ফলে আমাদের অর্থনীতি চাপের মুখে আছে। মন্দার অন্তত একটি ইনডিকেটর স্পষ্ট।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুয়ায়ী, জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের রাজস্ব আয়ে ঘাটতি ১৭ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। এছাড়া যুদ্ধের কারণে দেখা দেয়া বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতিতে চড়া পণ্যমূল্যে এমনিতেই ধুঁকছেন দেশের ভোক্তারা। এরমধ্যে নতুন বছরে ৩ দফা বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি জীবনযাত্রায় ব্যয়ের বোঝায় আরও চাপ তৈরি করেছে। পণ্য ও সেবার মূল্যকে ঊর্ধ্বমুখী করে উচ্চ মূল্যস্ফীতির পারদকে উসকে দেবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতা ও ভোক্তা অধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিরা। এতে রফতানি শিল্প যেমন প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে, তেমনি দেশে শিল্প উৎপাদনও ব্যয়বহুল হয়ে যাবে বলে মনে করছে রফতানুমখী গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা। এদিকে করোনার পর জনশক্তি রফতানিতে রেকর্ড হলেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের মতো রফতানি আয়েও নিম্নগতি। সদ্য শেষ হওয়া ফেব্রুয়ারিতে বিগত চার মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরেক বড় খাত রফতানি আয়েও দেখা দিয়েছে তেমন ধারা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও টানা তিন মাস পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি রফতানি আয় দেশে এসেছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসে তা কমে নেমে এসেছে চার দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ কম। সবশেষ চার মাসের মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে সর্বনিম্ন। এখানেই শেষ নয়; দেশের অর্থনীতির প্রাণ ব্যাংক খাত। আর সেই ব্যাংক খাত নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে আন্তর্জাতিক ঋণমাণ সংস্থা ও আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মুডি’স ইনভেস্টরস সার্ভিস। মুডি’স এর প্রতিবেদন ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি বিনিয়োগকারী, গ্রাহক ও প্রতিপক্ষের আস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে, যা দেশের আর্থিক খাতে অস্থিরতা বাড়াতে পারে।
সূত্র মতে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পণ্য রফতানি থেকে ৩ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার এসেছিল দেশে। আগস্টে আসে ৪ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে আসে তা ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ও ৪ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। এরপর নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে রফতানি আয় ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ১০, ৫ দশমিক ৩৬ ও ৫ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো গত বৃহস্পতিবার রফতানি আয়ের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-৫ ফেব্রুয়ারি) বিভিন্ন দেশে পণ্য রফতানি করে মোট ৩৭ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এনেছেন রফতানিকারকরা। ৩৭ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অর্জন হয় শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ কম। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের এই ৮ মাসে ৩৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় দেশে এসেছিল। ইপিবি’র তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে মোট রফতানি আয়ের ৩১ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার বা ৮৪ দশমিক ৫৮ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস হচ্ছে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স। রফতানি আয়ের মতো ফেব্রুয়ারিতে রেমিট্যান্সেও ছিল নিম্ন গতি। গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক রেমিট্যান্স প্রবাহের যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারিতে ১৫৬ কোটি ১২ লাখ ৬০ হাজার ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা; যা চার মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। তবে রফতানি আয়ের মতোই ফেব্রুয়ারিতে দেশে আসা রেমিট্যান্স গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ১৪৯ কোটি ৪৪ লাখ ডলার।
এর আগে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ (২১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের এই ধীরগতির কারণে রিজার্ভ আরও কমেছে। গত বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের ১ মার্চ রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৬ বিলিয়ন ডলার। এদিকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে ৩২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। তার আগে ছিল প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার। এই সপ্তাহেই আকুর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদের ১ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এদিকে ব্যাংকিংখাতকে বলা হয় একটি দেশের অর্থনীতির ধারক ও বাহক। আধুনিক অর্থনীতিতে বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ব্যাংকিং খাত অর্থনীতির প্রাণ। কিন্তু নানাবিধ অনিয়ম, দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবে দীর্ঘদিন থেকেই ধুঁকছে দেশের ব্যাংকিং খাত। বিশেষ করে পরিচালকদের পারস্পরিক যোগসাজশে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ইচ্ছেমাফিক ঋণ এবং পরবর্তীতে তা পাচারে ব্যাংকিং খাত খাদের কিনারে। আর এরমধ্যে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে আন্তর্জাতিক ঋণমাণ সংস্থা ও আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মুডি’স ইনভেস্টরস সার্ভিস। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে বাংলাদেশে দুর্বল ব্যাংকগুলোর অবস্থা আরও দুর্বল হতে পারে; বিপদ বাড়তে পারে। যেসব ব্যাংকের কাছে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ড কম আছে তাদের এই সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে সম্প্রতি গ্রাহকদের কাছে পাঠানো নোটে এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে মুডি’স।
দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে মুডি’স এর সতর্কবার্তার ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণগ্রহণের খরচ ও পুঁজিবাজারে প্রবেশের ক্ষমতা প্রভাবিত হবে। পাশাপাশি মুডি’স এর দৃষ্টিভঙ্গি অবনমন হওয়ায় বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যয়বহুল হয়ে উঠতে পারে। এতে বাংলাদেশের সুনাম ঝুঁকির মধ্যে পড়বে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকিং ব্যয়বহুল হবে, যার ফলে দাম বেড়ে যাবে। আর তাই সংস্কারের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে সুশাসনে তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশে ৬২টি ব্যাংক রয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকগুলো ব্যাংকই উচ্চ নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল), প্রভিশন ঘাটতি এবং দুর্বল গভর্নেন্সসহ আরো কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি সামীর সাত্তার ইনকিলাবকে বলেছেন, প্রতিমাসেই বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করতে গিয়ে দাম বাড়াচ্ছে সরকার। এর নেতিবাচক প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্য, পণ্য উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, কস্ট অব ডুইং বিজনেস বৃদ্ধি, রফতানি সক্ষমতায় প্রভাব ফেলছে। যা মূল্যস্ফীতিকেও বাড়াচ্ছে। এতে করে আমাদের শিল্প ও ব্যবসায় বিনিয়োগ প্রতিযোগী সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ভর্তুকির চাপ সামলাতে আমাদের এখন স্বল্প মেয়াদে সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য আমাদের দেশের অপার সম্ভাবনা আছে। হতাশার জায়গা হলো, সেই সম্ভাবনার জায়গা কি শুধু সম্ভাবনার জায়গায় থেকে যাবে! সেই সম্ভাবনা বর্তমান হবে কখন। তিনি বলেন, সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে আমাদের কিছু হোমওয়ার্ক করতে হতো দ্রুত। আমাদের দেশে আয় ও সম্পদ পুঞ্জিভূত হচ্ছে। এই সময়ের হাই-ইনফ্লেশনের অভিঘাতটা সবচেয়ে বেশ পড়ছে স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। ফলে আয় বৈষম্য ও সম্পদের বৈষম্য আরো বাড়ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আমরা আরো কিভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে পারি, সেই জায়গাটায় জোর দিতে হবে নীতি-নির্ধারকদের। সেটি সোস্যাল সেফটিনেট প্রোগ্রাম দিয়ে কাভার সম্ভব নয়। এই প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা যে কর্মসংস্থান তৈরি করবো সেটি ভালো কাজ দেবে। এজন্য জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, আমাদের ইন্সটিটিউশনগুলোর মধ্যে গুড গভর্নেন্স প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে ভালো অর্থনৈতিক শক্তি গড়ে উঠবে এবং চলমান সঙ্কট নিরসন করা সম্ভব হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে অনেক দূর এগিয়ে এসেছি কিন্তু একটি সন্ধিক্ষণেও আছি। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা এবং গণমাধ্যম আমাদের প্রবৃদ্ধি কমার অন্যতম কারণ হিসেবে বলছে -দুর্নীতি। এটিকে অস্বীকার কারার কোনো উপায় নেই। এটি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, বাজারে আমদানি করা পণ্যের ঘাটতি শুরু হয়েছে। আমাদের মূল্যস্ফীতি যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, এখানই সেটি বন্ধ করতে হবে। এই সন্ধিক্ষণে আমাদের এই যাত্রা থেকে কাম-ব্যাক করতে হবে। এছাড়াও অর্থনৈতিক পলিসির পুনর্গঠিন করতে হবে। যাতে করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়।