Originally posted in মানবজমিন on 10 June 2022
সংযত বাজেটের লক্ষণ হলো- আগামী বছর মোট বিনিয়োগ গত বছরের সংশোধিত বাজেটে যে পরিমাণ ছিল তার থেকে কম; ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ। এবং সরকারি বিনিয়োগও ১ শতাংশের মতো কমে যাবে। আমরা যদি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেখি, গতবছরের তুলনায় এ বছরে জিডিপি’র প্রায় ৯.০৭ শতাংশ কোলন করা হয়েছে। ব্যয়ের দিকে দেখলে আমরা সামান্য বৃদ্ধি দেখি, যা ১৫.০২ শতাংশ। অর্থাৎ ঘাটতি বাড়বে। তার মূল কারণ হলো পরিচালন ব্যয় বাড়ার কারণে, উন্নয়ন ব্যয় না। আর ঘাটতি পূরণ করার জন্য অনেক ব্যাংক ঋণের প্রয়োজন মনে করবে এবং বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজন মনে করবে। বিশ্বব্যাংক এবং এডিবি’র কাছ থেকে যে সমস্ত বাজেট সাপোর্ট বা বাজেটের খরচের জন্য টাকা আনা হচ্ছে, সময়মতো এটা পাওয়া এবং খরচ করা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
অপরদিকে মনে করা হচ্ছে আগামী বছর ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহ যে খুব বেশি বাড়ার লক্ষ্য নেয়া হয়েছে তা না। গত বছর যদি ১৪.০৮ থাকে এবার ১৫ দেয়া হয়েছে। সেই অর্থে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের নতুন কোনো বাড়তি সংকেত আসবে- এটা বাজেট প্রণেতারা মনে করছেন না।
আপনি যদি আমদানি-রপ্তানির দিকে যদি দেখেন, উনারা যে বছর গেল তার চেয়ে রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ২০ শতাংশ কম করেছেন। আমদানিতে করেছে ১২ শতাংশ। গতবারে যা ৩০ শতাংশ ছিল, এটা কীভাবে করে যখন বিশ্বব্যাপী পণ্য মূল্য বৃদ্ধি হচ্ছে। এটা বাস্তবসম্মত নয়। অর্থাৎ উনারা বৈদেশিক লেনদেনের যে ঘাটতি ধরেছেন সেটা আরও অনেক বেশি হবে এবং যার ফলে বিদেশি মুদ্রা মজুতের পরিমাণ যে উনারা লক্ষ্য করেছেন সাড়ে ৪৬ বিলিয়ন ডলার এটা তার চেয়ে কম থাকবে বলে আশঙ্কা করেন।
খরচের দিক থেকে এই ধরনের নতুন কোনো পরিবর্তন আসেনি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা খাতে আগে ২ বা ১ শতাংশের নিচে থাকতো তাই আছে। কোনো পরিবর্তন নেই। ঘাটতির বড় কারণটাই হবে ভর্তুকি এবং সরকারি দায়দেনার সুদ। এটি একটি বড় বিষয়।
বাজেটে আয়-ব্যয়ের ঘাটতি কিছুটা বাড়বে। কারণ হলো, আয় এবং ব্যয় দুটো সংযত করা হলেও তারপরও ব্যয় বাড়ছে। ব্যয় বাড়ছে তার কারণ পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি। আর পরিচালন ব্যয় বাড়ছে তার কারণ হলো ভর্তুকি এবং অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদের কারণে। সে জন্য ঘাটতি কিছুটা বাড়বে এবং ঘাটতি মেটানো হবে মূলত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আর বিদেশি সাহায্য।
যে সমস্ত করসুলভ প্রস্তাব করা হয়েছে সেটা একদিক থেকে যৌক্তিক। সেটা হচ্ছে আরও বেশি প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে সরকার করের আওতায় নিয়ে আসতে চাচ্ছেন। ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে করকে যুক্ত করতে চাচ্ছেন। কো-অপারেট করার জন্য যে সুবিধা দিলেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের জন্য সে সুবিধা দিলেন না। তাদের করযোগ্য আয়ের সীমা বাড়ালো না। আর ওদিকে করপোরেটের নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর কর আড়াই শতাংশ করে কমালো।
আর সবচেয়ে খারাপ কাজ যেটা করলো। যেটা সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক প্রশ্নের জন্ম দেবে। যেটা আমার কাছে হটকারী সিদ্ধান্ত বলেই মনে হয়। অর্থমন্ত্রীর ভাষায় সেটা হলো- বিদেশি অর্জিত সম্পদ, আমাদের ভাষায় পাচারকৃত সম্পদ। সেটা ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন প্রকার সম্পদের এত কর সুবিধা দিচ্ছেন। টাকা যে বৈধভাবে সেখানে অর্জিত হয়েছে এর সনদটা কে দেবে। এবং কোনো প্রশ্ন ব্যতিরেকে এই দেশে যখন গ্রহণ করা হবে, তাহলে এদের বিরুদ্ধে কোনোদিন মানিলন্ডারিং বা পাচারের অভিযোগ আনার দরকার পড়বে না। পি কে হালদারকে আমাদের এখন তাহলে গলায় মালা দিয়ে নিয়ে আসা উচিত। এবং এটা নির্বাচনের আগের বছরে করা রাজনৈতিকভাবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। একইভাবে এই টাকা বিদেশে বিভিন্ন লোকজন খুঁজছে, সে সময়টা হচ্ছে এটাও একটা প্রশ্নের সম্মুখীন করবে। এটা একটি হঠকারী প্রস্তাব একইসঙ্গে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে যুক্তিহীন।
বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য আমদানি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা ভালো, কিন্তু এটা যথেষ্ট না। এটা দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা পুরোটা যাবে না। কারণ আপনি যতটুকুই আনবেন সেটুকুুই উচ্চমূল্যে আসবে। এটি মূলত আসবে জ্বালানি এবং সারের মাধ্যমে এবং আমরা যে খাদ্যশস্য আমদানি করি তার মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে তথাকথিত বিলাস পণ্য এটা অর্থনীতিতে আমদানিকৃত পণ্যভাণ্ডারে খুবই সামান্য। আর এটির জন্য দু’টি বিষয় দরকার। একটি হলো অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী শিল্পকে আরও বেশি প্রণোদনা দেয়া, যাতে তারা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। দ্বিতীয়ত, সীমিত আয়ের মানুষকে প্রত্যক্ষভাবে আর্থিক সহায়তা দেয়া এবং নির্ধারিত মূল্যে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করা। এটি করে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব। কিন্তু আগামী অর্থ বছরে কীভাবে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, ৫ দশমিক ৬-এ নেমে আসবে, বাজেটে এর কোনো সুনির্দিষ্ট পথরেখা আমরা পাইনি। কারণ শুধু আমদানি নিয়ন্ত্রণ দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো জটিল, সেই সুযোগ সীমিত। এখানে অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দুস্থ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা রক্ষা করাই হলো আসল কাজ।
বাজেটে আয়-ব্যয়ের ঘাটতি কিছুটা বাড়বে। কারণ হলো আয় এবং ব্যয় দুটো সংযত করা হলেও তারপরও ব্যয় বাড়ছে। ব্যয় বাড়ছে তার কারণ পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি। আর পরিচালন ব্যয় বাড়ছে তার কারণ হলো ভর্তুকি এবং অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদের কারণে। সে জন্য ঘাটতি কিছুটা বাড়বে এবং ঘাটতি মেটানো হবে মূলত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আর বিদেশি সাহায্য। আর বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে যে বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে সেগুলো যদি পায় তাহলে একটু সহজ হবে। তবে এক্ষেত্রে তাদের যে কৌশল- এখানে তারা ধরেই নিয়েছেন যে, এটা তুলনামূলকভাবে ধীর স্থিরের বছর হবে। এটা ভেতরে কোনো উচ্ছ্বাস বা উল্লম্ফলের বছর এটা না।