অসহযোগ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সহযোগিতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে – রেহমান সোবহান

Published in সমকাল on Monday, 26 March 2017

professor-rehman-sobhan

অধ্যাপক রেহমান সোবহান। ষাটের দশকের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। বয়স ২৬ বছর। তার সে সময়ের বিস্ফোরণাত্মক অভিমত- পাকিস্তানে চলছে টু ইকোনমি বা দুই অর্থনীতি। বাঙালি শোষিত, বঞ্চিত- আলোচনায়, লেখনীতে দৃঢ়ভাবে এ বক্তব্য প্রকাশ পেতে থাকে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে এ নিয়ে তার আলোচনা চলে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রণয়নে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের নবপর্যায়ে তিনি স্বাভাবিকভাবেই যুক্ত হন ‘বঙ্গবন্ধুর প্রশাসনে’র সঙ্গে। ২৫ মার্চের পর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ও প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন তিনি। স্বাধীনতার ৪৬ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সমকালের সহযোগী সম্পাদক অজয় দাশগুপ্তের সঙ্গে আলাপচারিতায় সে সময়ের কথা তুলে ধরেন স্বাধীনতার এই মহান সংগ্রামী

দিল্লিতে, ভারতের ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা

সেই কঠিন সময়ে- ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য স্থানে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা চালাচ্ছে- কীভাবে প্রথমে আগরতলা ও পরে দিলি্ল পৌঁছালেন? সে সময়ে ভারতের শীর্ষ নেতৃত্বের কেউই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে চিনতেন না। আপনিই তাকে ‘শনাক্ত’ করেন- এমনটিই জনশ্রুতি। অধ্যাপক রেহমান সোবহানের কাছে এভাবেই সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা জানতে চাই। তিনি বলেন, ১ মার্চ থেকেই বাংলাদেশ পরিচালিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায়। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িটি সবকিছুর কেন্দ্রে। প্রতিদিন সেখানে মুক্তিকামী মানুষের মিছিল যাচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারক ও বাস্তবায়নে জড়িতরা যাচ্ছেন। আমরা ধানমণ্ডি ও বেইলি রোডের আরও দুটি বাড়িকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত হরতাল, বাকি সময় যানবাহন চলে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। জনগণ তা মেনে নেয়। সবকিছু অচল করে দেয়। ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া সর্বত্র বাংলাদেশের পতাকা। বাংলাদেশের সর্বত্র ছাত্র-যুবকরা সামরিক প্রশিক্ষণ চালাতে থাকে প্রকাশ্যে। এমনকি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করতে গেছেন আমাদের পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে। প্রকৃতপক্ষে এ সময়টা ছিল পাকিস্তানের শাসকদের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের অসহযোগিতা। বাংলাদেশের মানুষ তাদের বর্জন করেছিল। অন্যদিকে চলছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সহযোগিতা। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন দেশের মতো প্রশাসন। আমি তাতে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়ি। ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা অভিযান শুরু। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি স্বাধীনতার বার্তা সর্বত্র পেঁৗছে দেন। সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ২৭ মার্চ কিছু সময়ের জন্য কারফিউ বিরতি হলে অজানার পথে বের হই। আমি যেহেতু বঙ্গবন্ধুর প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত থেকে কাজ করেছি, তাই অনেকে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। বর্তমানে জাতীয় সংসদ সদস্য, ১৯৭১ সালে তরুণ নেতা রহমতউল্লা, আমার বিশ্ববিদ্যালয় সহকর্মী ড. আনিসুর রহমান, শিল্পী ও টেলিভিশন কর্মকর্তা মোস্তফা মনোয়ারও আমাকে ত্রিপুরা যেতে সহায়তা করেন। সেখানে আরও অনেককে দেখতে পাই। ত্রিপুরায় তখন কংগ্রেস সরকার। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকীও সেখানে পেঁৗছে গেছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলার মুখে ভীতসন্ত্রস্ত অনেক নারী-পুরুষ ওই রাজ্যে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। ভারতের প্রশাসন বুঝে উঠতে পারছে না, কী করবে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন_ যেমন খালেদ মোশাররফ, তারা চাইছিলেন অস্ত্র। তিনি তো এক পাকিস্তানি আর্মি অফিসারকে বন্দি করেই ভারতে নিয়ে যান। বলতে পারেন, তিনিই প্রথম একজন শত্রুসেনাকে বন্দি করে বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করেন। কিন্তু তার মতো আরও যেসব সেনা অফিসার ও জওয়ান পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, তাদের কেউ চিনত না। তারা অস্ত্র চাইছিলেন। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকীসহ আমি দিলি্ল চলে যাই। তারা দু’জনই বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরতে হবে। এ জন্য আপনিই হবেন উপযুক্ত ব্যক্তি। আমার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরিচয় থাকার প্রশ্ন আসে না। কিন্তু তার স্টাফ হিসেবে কর্মরত পিএন ধর ও অশোক মিত্র ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাদের মাধ্যমেই আমি ইন্দিরা গান্ধীর মুখ্য সচিব পিএন হাকসারের সঙ্গে কথা বলি। তাকে সে সময়ে বলা হতো ইন্দিরা গান্ধীর পর সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে বলি, দিলি্লতে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দু-তিন দিনের কর্মকাণ্ড আমি পরিচালনা করতে বিশেষভাবে সহায়তা পেয়েছি ছাত্র জীবনের বন্ধু, পরবর্তীকালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেনের কাছ থেকে। তিনি সে সময়ে দিলি্লতে শিক্ষকতা করতেন এবং অশোক মিত্রসহ অনেকের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আমাদের দিলি্ল বিমানবন্দর থেকে অমর্ত্য সেন প্রথমে তার বাড়িতে নিয়ে যান। সেখান থেকে যাই অশোক মিত্র ও অন্যদের কাছে। তাদের কাছ থেকে পেয়েছি অপরিসীম সহায়তা, সহমর্মিতা।

স্বাধীনতার পেছনে ভারত- এ ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ড. অশোক মিত্র আমাকে পিএন হাকসারের ঘরে নিয়ে যান। এর আগের কয়েক ঘণ্টায় দিলি্লতে অমর্ত্য সেনের সুবাদে অনেক সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষকের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনোসাইড, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার পর স্বাধীনতা সংগ্রামের কে নেতৃত্ব দেবেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কীভাবে গঠিত, স্বাধীনতা সংগ্রাম কোন পথে অগ্রসর হবে- এসব বিষয়ে তাদের সামান্যই ধারণা ছিল। বঙ্গবন্ধু ভারতে এবং বিশ্বের আরও অনেক দেশে পরিচিত ছিলেন। তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে আলোচনার কেন্দ্রে। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী বা তার সহকর্মীদের জানা ছিল না- বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলাদেশের জনগণের হয়ে, আওয়ামী লীগের হয়ে কে কথা বলার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত। কার ওপরে তিনি ভরসা করতে পারেন। অথচ যুদ্ধ তার দোরগোড়ায়। আমি ত্রিপুরা হয়ে এবং তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতা হয়ে দিলি্ল পেঁৗছান। কলকাতায় তার সঙ্গে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ ও প্রশাসনের কয়েকজন নেতার কথা হয়। তারা তাকে দিলি্ল যাওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইছেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী সময় নিচ্ছেন বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং সম্ভাব্য নেতাদের সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত হওয়ার জন্য। বলতে পারেন, দিলি্লতে আমার উপস্থিতি এ কাজ সহজ করে দিয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদকে আমি অনেক বছর ধরে চিনি। ১৯৬৯ সাল থেকে তার সঙ্গে আমি একযোগে কাজ করি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নে দু’জনই যুক্ত ছিলাম। ড. কামাল হোসেনও ছিলেন। আমি বিশ্বের অনেক পণ্ডিত ব্যক্তির দেখা পেয়েছি। অনেকের সঙ্গে কাজ করেছি। এমন যোগ্য মানুষ আমি কম দেখেছি। তীক্ষষ্ট বুদ্ধি, বিচক্ষণ ও ঘটনাপ্রবাহ তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন- এমনসব বিরল গুণের অধিকারী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সব সময় তার সঙ্গে পরামর্শ করতেন। বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একযোগে তিনি নিজের সেরাটা দিতে পারতেন। আমি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যারা কাজ করেন, ভারতের সেসব বিশিষ্ট ব্যক্তির কাছে আমার অভিমত তুলে ধরেছি। আমার অভিমত হয়তো তাদের সিদ্ধান্তে পেঁৗছাতে সহায়তা করেছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত তো নিয়েছেন তারা। ইন্দিরা গান্ধী ভারতের অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাদের নীতি ও কৌশল নির্ধারণ করেছেন।

পাকিস্তানের শাসকরা সে সময় বলেছেন এবং পরবর্তী বছরগুলোতেও নানাভাবে প্রচার চালানো হয়েছে- বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের ফল। আমি এ প্রসঙ্গটি তুলে ধরি অধ্যাপক রেহমান সোবহানের কাছে। তিনি ১৯৭১ সালের ২ ও ৩ এপ্রিল দিলি্লর ঘটনাবলি তুলে ধরে বলেন, ২৫ মার্চের কয়েকদিন আগে ভারতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় এসেছেন। এমন সময়েই প্রতিবেশী দেশটিতে চরম অস্থিরতা। তাছাড়া ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর ঢাকা ও দিলি্লর সঙ্গে যোগাযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। যোগাযোগ কমে যায়। এখানকার নেতৃত্ব, রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনা- এসব ভালোভাবে বোঝার মতো সুযোগ কম ছিল। তবে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে সম্পর্ক, যোগাযোগ ছিল। অমর্ত্য সেন, অশোক মিত্রসহ আরও অনেকের সঙ্গে আমার ও আনিসুর রহমানের যোগাযোগ ছিল।

কীভাবে এত দ্রুত নতুন সরকার গঠিত হলো?

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ২৭ মার্চ ঢাকায় কারফিউ প্রত্যাহারের ৫-৬ দিনের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতা হয়ে এবং আমি আগরতলা হয়ে দিলি্ল যাই। ৩ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার বৈঠক হয়। ইন্দিরা গান্ধী দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তিনি তাজউদ্দীনকে বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠন করতে হবে দ্রুত। তার কাছে খবর ছিল, অনেক নির্বাচিত প্রতিনিধি পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার সীমান্ত দিয়ে ভারতে পেঁৗছেছে। তিনি বলেন, সরকার গঠিত হলেই কেবল আমরা আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারব, আপনাদের হয়ে বিশ্বের কাছে কথা বলতে পারব। বাংলাদেশের নেতৃত্বের মধ্যে তখন কেউ কেউ তাজউদ্দীনের বিরোধী ছিল। মতের পার্থক্য ছিল। তবে বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনের ওপর আস্থা রাখতেন। তার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতেন। ইন্দিরা গান্ধীও বিচক্ষণ রাজনীতিক ছিলেন। বাংলাদেশে তখন গণহত্যা চলছিল। প্রতিদিন রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সাধারণ মানুষ ভারতে পেঁৗছাচ্ছিল। আমাদের পাশে দাঁড়ানো ছিল ভারতের নেতৃত্বের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। তাজউদ্দীন যে উপযুক্ত ব্যক্তি, সেটা তারা বুঝতে পারেন।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সহযোগিতা

রেহমান সোবহান বলেন, ১ মার্চ থেকেই বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা সম্পর্কিত যাবতীয় কর্মকাণ্ড চলছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগের কর্মী, সরকার পরিচালিত বেতার-টেলিভিশনের কর্মকর্তা-কলাকুশলী-কর্মী সবাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলেন। তিনি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে বলেছেন। ১ মার্চ থেকেই জনগণ পাকিস্তানের সঙ্গে অসহযোগ করতে থাকেন এবং একই সঙ্গে তারা সহযোগিতা করেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। এ প্রসঙ্গে আমি সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের পদত্যাগপত্রের কথা উল্লেখ করতে পারি। ১ মার্চের পর তাকে বাঙালিদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। কিন্তু তিনি এতে অস্বীকৃতি জানান এবং পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। তাকে সরিয়ে সামরিক শাসক নিয়োগ করা হয় বেলুচিস্তানের কসাই হিসেবে কুখ্যাতি লাভকারী টিক্কা খানকে। পদত্যাগপত্রে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা সামরিক সমাধান সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় সরকার পূর্বাংশের জনগণের মনোভাব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি লিখেছেন, প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ শেখ মুজিবের হাতে চলে গেছে। তিনি এখন কার্যত প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করছেন। জনজীবনও নিয়ন্ত্রণ করছেন। সামরিক সমাধানের পথে চললে বিপুল সংখ্যক নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করতে হবে এবং পরিণতি ভালো হবে না। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ও টিক্কা খান এ পরামর্শ শোনেননি।

জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, বঙ্গবন্ধু ২৫ দিন স্বাধীন বাংলাদেশ পরিচালনা করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি একটি স্বাধীন দেশের নেতৃত্বভার নিয়েছিলেন। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী একটি স্বাধীন দেশের ওপর আক্রমণ করে। বিশ্ব এটাকে সেভাবেই দেখেছে। যেমনটি ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের ওপর জার্মানির আক্রমণের পর। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বুঝতে হলে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসকে বুঝতে হবে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এসেছে। ১ মার্চের পর এখানে পাকিস্তান সরকার ছিল না। বাংলাদেশ স্বাধীন ছিল। বঙ্গবন্ধু এ সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমাদের এ ভূখণ্ড বহুকাল বিভক্ত ছিল। তিনি এ দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেন। বিশ্ববাসী সেটা জেনেছে, দেখেছে। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। তিনি নির্বাচিত নেতা। স্বাধীনতা ঘোষণার একমাত্র বৈধ কর্তৃত্ব ছিল তার। তিনি নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন। সবার কাছে তিনি স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য হওয়ায় বাংলাদেশের নেতৃত্বের কাজ সহজ হয়ে যায়।

লন্ডন-ওয়াশিংটনে

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, তাজউদ্দীন আহমদ ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ নেয়। ৩ এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার বৈঠকের পর আমরা কয়েকদিন একসঙ্গে ছিলাম। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীসহ আওয়ামী লীগের নেতারা বিভিন্ন সীমান্তপথে ভারত পেঁৗছাচ্ছিলেন, সে খবর আমরা দিলি্ল বসে পাই। তিনি দ্রুত কলকাতা ও আগরতলা যেতে চাইছিলেন, যাতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে সকলকে অবহিত করা যায়। এ সময়ে খবর পাই ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত এম এম আহমদ যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি পাকিস্তানের জান্তার পক্ষে লবিং করবেন। তাকে মোকাবেলার জন্য তাজউদ্দীন আহমদ আমাকে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে বলেন। আমি লন্ডন হয়ে ওয়াশিংটনে যাই। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের কারণে আমার কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। আমি সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার বা অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। বিশ্ব নেতাদের কাছে আমার উল্লেখ করার মতো পরিচয় ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ততদিনে বিশ্বের কাছে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। আমি লন্ডন থাকার সময়ে একজন ট্যাক্সিচালক বলেন, তোমাদের নেতাকে আমি সমর্থন করি। একজন সিকিউরিটি অফিসার বলেন, বন্দি মুজিবের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেস সদস্য, পত্রিকা সম্পাদক, অর্থনীতিবিদ, জাতিসংঘের কর্মকর্তা- অনেকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সমর্থন করছেন পাকিস্তানকে। কিন্তু সে দেশে বসেই আমি বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার চাই। সেখানে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন বাংলাদেশের গণহত্যার খবর ফলাও করে প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও অর্থ ব্যবহার করছে পাকিস্তানিরা- এর নিন্দা উঠতে থাকে। ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইম এবং আরও অনেক পত্রিকা লেখে- পাকিস্তানকে কোনো সহায়তা নয়। তারা বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করে।

প্রশাসন পরিচালনার অভিজ্ঞতা

রেহমান সোবহান বলেন, মার্চ মাসের আন্দোলনের কারণেই আমাদের জন্য এ অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি হয়। এ মাসেই আমরা প্রথম প্রশাসন পরিচালনার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করি। আমরা শুল্ক ও কর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিই। এখানে প্রচলিত নোট ছাপা হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। ১ মার্চের পর নোটের সরবরাহে সমস্যা দেখা দেয়। আমরা এ বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত দিই, সবাই সেটা মেনে নেয়। বাঙালি ব্যাংকারদের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত বৈঠক হয়েছে। আমাদের কাজে বিশেষভাবে সহায়তা করেন নিম্নপদস্থ কর্মী ও কেরানিরা। তাদের সতর্কতা ও উৎসাহে বঙ্গবন্ধু প্রশাসনের নির্দেশ বাস্তবায়ন সহজ হয়। তারা ছিল আমাদের বড় শক্তি।

স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক

কোনো প্রশ্ন করার আগেই অধ্যাপক রেহমান সোবহান এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, কে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন- এ বিতর্ক অ্যাবসার্ড। বিশ্ব জানত যে, আমাদের নেতা কে। একজন সেনাবাহিনী মেজর, যার নাম কেউ শোনেনি- তিনি যদি কোনো ঘোষণাও দেন, তার কোনো দাম নেই। স্বাধীনতা ঘোষণা করতে হলে রাজনৈতিক বৈধতা, কর্তৃত্ব এসব থাকা চাই। এ অধিকার ছিল কেবল শেখ মুজিবুর রহমানের। জিয়াউর রহমানও এটা জানতেন। এ কারণেই তিনি ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা বলেন। তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকার সময় স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। এটা নিয়ে প্রচার শুরু হয় নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে। আমি ১৯৭১ সালের ১৩ মার্চ ফোরাম পত্রিকায় লিখি, পলাশী যুদ্ধের দুই শতাব্দীর বেশি সময় পর বাংলা এখন মুক্ত। জনগণ রাজনীতি, অর্থনীতি এবং অন্যান্য সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। মার্চের প্রথম দিন থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন ছিল এভাবে- আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে অসহযোগ নয়, বরং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সহযোগিতা। সে সময়েই আমরা শিখেছি, কীভাবে সরকার পরিচালনা করতে হয়।

স্বাধীন দেশের ৪৬ বছর

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, স্বাধীনতার ৪৬ বছরে বাংলাদেশের অনেক উন্নতি হয়েছে। প্রবৃদ্ধির হার ভালো। দারিদ্র্য কমছে। খাদ্য পরিস্থিতি উন্নত হয়েছে। শিক্ষার প্রসার ঘটছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ কোটির মতো ছাত্রছাত্রী। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন প্রত্যাশার তুলনায় ভালো। বিশেষ করে অনেক স্বল্পোন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অগ্রগতি লক্ষণীয়। পাকিস্তানের তুলনায়ও আমরা অনেক সূচকে ভালো করছি। বলা যায়, স্বাধীনতার যথার্থতা আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি। আমরা স্বাধীনতার ফসল পেয়েছি। অবকাঠামো খাত উন্নত হচ্ছে। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি অনেক ভালো। পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প নিজস্ব অর্থে নির্মাণ করতে পারছি। এ জন্য নিজেদের বাজেট থেকে অর্থের জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। আমাদের সম্পদ সব সময় ছিল। কিন্তু এখন নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছি। কীভাবে সম্পদের ব্যবহার করব, সেটা বুঝতে পারি। বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরতা কমে গেছে। পাইপলাইনে এখন অনেক বিদেশি সাহায্যের অঙ্গীকারের অর্থ জমা আছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য সমস্যা আছে- বাস্তবায়ন ক্ষমতা, দক্ষতা দুর্বল। এদিকে নজর দিতে হবে। প্রশাসনের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশি সময় প্রয়োজন পড়ছে। বিশেষ করে বড় বড় প্রকল্প সময়মতো শেষ হয় না। তিন বছরের জন্য নির্ধারিত কাজ ছয় বছরে শেষ হয়। এর ফলে ব্যয় বেশি পড়ে। এখন জরুরি করণীয়- প্রশাসনের মান বাড়ানো। বিশেষভাবে নজর দিতে হবে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতার ওপর। আমরা স্বল্পোন্নত দেশের সারি থেকে বের হয়ে যাচ্ছি। এ সারিতে থাকার কারণে আমরা অনেক সুবিধা পেয়েছি বিভিন্ন উন্নত দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে। বিশ্বব্যাংক আমাদের নামমাত্র সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিয়েছে অনেক বছর। আগামী কয়েক বছর এ সহায়তা পাওয়া যাবে। এ সুবিধা যেন আমরা কাজে লাগাতে পারি।