বিগত সময়ে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমলেও অসমতা বেড়েই যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড চলামান থাকলেও এর সুফল সমাজের সকল মানুষের কাছে সুষমভাবে বণ্টিত হচ্ছে না। এর মধ্যে বাংলাদেশ সাম্প্রতিককালে আইএমএফ প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে; যেখানে আইএমএফের ঋণের শর্তগুলোর দিকে সরকারকে গুরুত্ব আরোপ করতে হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় যে, আইএমএফ এর সময়কালে অসুবিধাগ্রস্ত মানুষদের কথা সমাজে কিভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে এবং আইএমএফ তাদের জীবনে কতটুকু তাৎপর্য রাখতে পেরেছে?
এ প্রেক্ষাপটে বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির আলোকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও আসন্ন জাতীয় বাজেট থেকে তাদের প্রত্যাশা জানতে, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহের সহায়তায় সুপারিশ সংগ্রহ করেছে। এ সংগ্রহকৃত সুপারিশমালা উপস্থাপন করা হয় “আইএমএফ’এর সময়কালে অসুবিধাগ্রস্থ মানুষের কথা জাতীয় বাজেটে কীভাবে প্রতিফলিত হতে পারে?” শীর্ষক একটি নীতি সংলাপে। সিপিডি এবং নাগরিক প্ল্যাটফর্ম – এর যৌথ উদ্যোগে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় সংলাপটি অনুষ্ঠিত হয় ১৫ মে, ২০২৩ সোমবার, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, আগারগাঁও, ঢাকায়।
সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব এম এ মান্নান, এমপি, মাননীয় মন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। সংলাপে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব রানা মোহাম্মদ সোহেল, এমপি, সদস্য, অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ এবং ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, সাবেক সংসদ সদস্য। সংলাপে বিশেষ বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব আসিফ সালেহ্, নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক; মিজ ফেরদৌস আরা বেগম, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) এবং অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এবং কোর গ্রুপ সদস্য, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম।
সংলাপটি সভাপতিত্ব করেন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, কোর গ্রুপ সদস্য, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এবং সদস্য, সিপিডি বোর্ড অফ ট্রাস্টি।
সংলাপে প্রারম্ভিক বক্তব্য উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
সংলাপে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এবং আহ্বায়ক, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ।
এছাড়াও বিভিন্ন অসুবিধাগ্রস্থ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা উপস্থিত থেকে তাদের অভিমত তুলে ধরেন।
সংলাপের প্রধান অতিথি জনাব এম এ মান্নান, এমপি, বলেন যে, বাজেট তৈরি আইএমএফের উপর নির্ভরশীল নয়। মূল্যস্ফীতি এবং মজুরির বিষয়ে অনেকেই আপত্তি প্রকাশ করলেও সাম্প্রতিককালে মূল্যস্ফীতি কমছে এবং মজুরিও বাড়ছে। এছাড়াও তিনি বলেন যে, আসন্ন বাজেটে প্রতিবন্ধীদের ভাতা বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
সংলাপের বিশেষ অতিথি হিসেবে জনাব রানা মোহাম্মদ সোহেল, এমপি, বলেন যে, প্রয়োজন আছে বলেই আইএমএফের কাছে গিয়েছেন সরকার। আইএমএফের এই সময়কালে আমাদের যে বৈষম্যগুলো ছিল সেগুলো কমবে না; বরং বাড়বে। মজুরি বৃদ্ধি যেমন প্রয়োজন সে সাথে নিজ নিজ স্থান থেকে দক্ষতা বৃদ্ধির দিকেও নজর দিতে হবে।
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন যে, সরকারি হিসাবে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন হলেও এর পরিমাণ বাস্তবে ২২-২৩ বিলিয়ন বেশি নয়। এছাড়াও প্রয়োজনীয় পরিমাণে জ্বালানি আমদানি করতে না পারায় দেশব্যাপী লোডশেডিং অসহনীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান অসমতা এবং বৈষম্য কমানোর জন্য সরকারের উদ্যোগের কথা জানতে চাইলে আজ অবধি কোনো সদুত্তর পাননি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সংলাপের মূল প্রতিবেদনে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন যে, একটি ব্যতিক্রমধর্মী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আমরা আইএমএফের কাছে গিয়েছি। এ কারণেই আইএমএফ এর কর্মসূচি বর্তমানে আমাদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে সমাজের অসুবিধাগ্রস্থ মানুষের কাছে আইএমএফের তাৎপর্য নিয়ে এখনো আশংকা রয়ে গিয়েছে। তিনি আরো বলেন যে, শহরের ভেতর দারিদ্র্যের হার কম হলেও ক্রমাগত আয় এবং ভোগ বৈষম্য বেড়ে চলেছে। এছাড়াও সমাজে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। সরকার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মত বিভিন্ন দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি নিলেও এর সঠিক প্রচারের অভাবের ফলে অনেক সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীই তা সম্পর্কে অবগত হচ্ছেন না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষতা এবং জনবলের অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই প্রকল্প থাকার ফলেও তার সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
সংলাপে বিভিন্ন অসুবিধাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা আসন্ন জাতীয় বাজেট নিয়ে তাদের প্রত্যাশা তুলে ধরেন। যুব নারী প্রতিনিধি বলেন যে, বাজেটে বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য এবং শিশু অধিকার আইন নিশ্চিত করতে প্রান্তিক অঞ্চলের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। শিশু বিষয়ক কার্যক্রমের সাথে যুক্ত প্রতিনিধি সুপারিশ করেন, বাজেটে শিশু সম্পর্কিত বড় প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের বাজেটে শিশুদের অধিকারের বিশেষ প্রতিফলন থাকতে হবে। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসী বলেন, অতিরিক্ত লবণাক্ততার জন্য কৃষি জমির যে ক্ষতি হচ্ছে তা মোকাবেলায় বাজেটে কৃষির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। মেহেরপুর থেকে আগত নারী কৃষক প্রতিনিধি মহিলাদের জন্য আলাদাভাবে কৃষি মার্কেটের ব্যবস্থা করার ওপর জোড় দেন যেনো তারা নিজেদের উৎপাদিত পণ্য নিজেরাই বাজারে বিক্রি করতে পারেন। বাজেটে বৃদ্ধ কৃষকদের জন্য পেনশন বা বিশেষ ভাতার ব্যবস্থারও দাবি করা হয়। স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকা দলিত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি সনাতন পদ্ধতিতে পরিচ্ছনতা কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিত করার জন্য দাবি জানান। ট্রান্সজেন্ডার গোষ্ঠীর প্রতিনিধি তাদের জন্য বাসস্থান নিশ্চিত করার জন্য ‘সেফ হোম’ নির্মাণের কথা উল্লেখ করেন। আদিবাসী সমাজের প্রতিনিধি তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিজস্ব মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরেন। এছাড়াও তাদের সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি করেন। এসিড সহিংসতার শিকার এমন নারী প্রতিনিধি বলেন, তাদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার পেছনে গুরুত্ব দিতে হবে এবং তাদের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে।
সংলাপের শেষে সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, সরকার যদিও বৈষম্য বিরোধী বিভিন্ন আইন তৈরি করছেন, ভাতা দিচ্ছেন কিন্তু অসুবিধাগ্রস্ত মানুষরা তাদের দাবি নিয়ে দাঁড়াবেন এমন কোনো জায়গা নিশ্চিত করতে পারছেন না। স্বাধীন জাতি হিসেবে দাঁড়ানোর জন্য শুধু ভাতা দিলেই হবেনা মানুষকে তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে।