Originally posted in Shomoyer Alo on 15 January 2023
নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা আজ
মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো ও মুদ্রা বাজারে স্থিতিশীলতায় গুরুত্ব
আজ রোববার চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। এতে গুরুত্ব পাবে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রেখে জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে আনা, মুদ্রা বাজারে স্থিতিশীলতা আনা এবং কাক্সিক্ষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তগুলোকেও নতুন মুদ্রানীতিতে গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আইএমএফের চাপিয়ে দেওয়া শর্তের আলোকে নয়, মুদ্রানীতি হওয়া দরকার নিজস্ব প্রয়োজনের তাগিদে।
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল শনিবার সময়ের আলোকে বলেন, ‘আইএমএফ কী বলল সেটিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা ঠিক হবে না। তাদের শর্ত থাকতেই পারে, তবে সেটিকে নিজেদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব যেন না দেওয়া হয়। তাদের শর্ত মেনে করলে তাতে নিজস্ব স্বকীয়তা থাকে না। আমি মনে করি, এবারের মুদ্রানীতিতে বেশ কয়েকটি বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দেওয়া দরকার। যেমন, সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়টিকে। এরপর ঋণখেলাপি কীভাবে কমিয়ে আনা, মুদ্রার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা এবং ব্যাংক ঋণ ও আমানতের সুদের হারে পরিবর্তন আনা দরকার। মূলত এই চার জায়গাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার এবারের মুদ্রানীতিতে।
তিনি আরও বলেন, এর পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখা, রিজার্ভ কীভাবে বাড়ানো যায় সেদিকে জোর দেওয়া, খেলাপি ঋণ উদ্ধার করার ওপরও জোর দেওয়া দরকার। এগুলোকে আমলে নিয়ে বাস্তবতার নিরিখে মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে হবে। আইএমএফ সেব শর্ত দিয়েছে তার মধ্যে এসব বিষয়ও রয়েছে। সুতরাং এগুলোকে আমলে নিলে আইএমএফের শর্তকেও গুরুত্ব দেওয়া হলো এবং মুদ্রানীতিতে নিজস্বতাও থাকল।
আরেক অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ নতুন মুদ্রানীতির বিষয়ে সময়ের আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতি কমানো, মুদ্রার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি নতুন মুদ্রানীতিতে কীভাবে বিনিয়োগ বাড়ে, কীভাবে অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমানো যায়, বিশ^ বাজারের অস্থিরতা প্রশমনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ থাকা, সুদের হারকে বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা। এ ছাড়া মুদ্রার বিনিময় হার এমনভাবে সমন্বয় করা দরকার, যাতে রফতানিকারক এবং প্রবাসী-উভয়েই লাভবান হয়। এতে একদিকে যেমন রফতানি আয় বাড়বে, অপরদিকে রেমিট্যান্সও বেশি আসবে। ফলস্বরূপ রিজার্ভ সংকট দূর করা যাবে। তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হলো, মুদ্রানীতি ঘোষণার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেন স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ব্যাংক পরিদর্শন কার্যক্রম স্বাধীনভাবে করার দিকে জোর দিতে হবে। নতুন মুদ্রানীতিতে এসব বিষয়েও দিকনির্দেশনা থাকবে বলে আমি আশা করছি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এখন থেকে আবার এক অর্থবছরে (আর্থিক বছর, ১ জুলাই থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় ৩০ জুন) দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের ১ জুলাই ২০২২-২৩ অর্থবছর শুরু হওয়ার পর ওই মাসের শেষের দিকে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছিল।
গত কয়েক বছর ধরে এক অর্থবছরে একটি মুদ্রানীতিই ঘোষণা করা হতো। এবারও তেমনটিই হবে বলে সবাই ভেবেছিলেন। কিন্তু আইএমএফের পরামর্শে আজ রোববার চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। যেখানে গুরুত্ব পাবে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আটকে রেখে জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে আনা এবং কাক্সিক্ষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি (অর্থনৈতিক) অর্জনের উদ্যোগ।
বাজারে নগদ টাকার জোগান কেমন হবে? কতটা ঋণ দেওয়া হবে উদ্যোক্তাদের? সরকারই বা কতটুকু ধার করতে পারবে ব্যাংকিং খাত থেকে! মুদ্রানীতির মাধ্যমে এমন সব লক্ষ্যই নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত কয়েক বছর এই নীতি বছরে একবার প্রকাশ করা হলেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের আইএমএফের ৪৫০ কোটি (৪.৫ বিলিয়ন) ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে এখন তা আগের মতো ছয় মাস পর পর (এক অর্থবছরে দুটি) মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আইএমএফের এই ঋণের বেশ কিছু শর্তের মধ্যে অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল এক অর্থবছরে দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে হবে। বেশি কিছু সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের শর্তে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে এই ঋণের প্রথম কিস্তির টাকা ছাড় করা হবে বলে সরকারকে জানিয়েছিল আইএমএফ।
আজ রোববার দুপুর আড়াইটায় বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে নতুন এ মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় ডেপুটি গভর্নর, বিএফআইইউ প্রধানসহ ও নির্বাহী পরিচালকরা উপস্থিত থাকবেন। বর্তমান গভর্নরের মেয়াদে এটি তার প্রথম মুদ্রানীতি।
নতুন মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও তারল্য সরবরাহ ঠিক রাখা মুদ্রানীতির মূল কাজ। মুদ্রানীতি ঘোষণার আগে প্রতি বছরের মতো এবারও আমরা দেশের অর্থনীতিবিদসহ সব স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন দিক, মুদ্রা সরবরাহ, সংরক্ষিত মুদ্রা ও সুদহার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অর্থনীতির বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে। মুদ্রানীতি কেমন হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের ওপর ভিত্তি করেই মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ ঋণ বৃদ্ধির সংকুলান রাখা হয়। নভেম্বর পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ফলে নতুন মুদ্রানীতিতে এ রকম প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হতে পারে। সব ধরনের ঋণে ৯ শতাংশ সুদহারের যে ঊর্ধ্বসীমা রয়েছে তা একেবারে বাজারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে নতুন করে একটি সীমা দেওয়া হতে পারে।
জানা গেছে, ২০০৬ সাল থেকে বছরে দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলেও ২০১৯ সাল থেকে সাবেক গভর্নর ফজলে কবির বছরে একবার মুদ্রানীতি প্রণয়নের ঘোষণা দেন। সেই অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ওই বছরের ৩১ জুলাই একবারই মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন। পরবর্তী ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরেও একবারই মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।