আগামী দিনে রাষ্ট্রকে আরো কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যাবে – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Published in মানবজমিন on Saturday 20 June 2020

একটি বিতর্ক প্রায়ই চলে- জীবন না জীবিকা, কোনটি আগে। কেউ বলেন জীবন, কেউ বলেন জীবিকা। কিন্তু প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও গণনীতি বিশ্লেষক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিষয়টি দেখেন একেবারেই ভিন্ন আঙ্গিকে। তিনি মনে করেন, এ কথাগুলোর মধ্যে একটি ভ্রান্ত দ্বৈততা রয়েছে। রাষ্ট্র নাগরিকের সুরক্ষা দিতে পারছে না বলেই মানুষকে জীবিকার সন্ধানে পথে নামতে হচ্ছে। শুধু জীবন ও জীবিকার প্রশ্ন নয়, আগামী দিনের এমন নানামুখী চ্যালেঞ্জ নিয়ে ডিফারেন্ট অপিনিয়ন পোডকাস্টে মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন সিপিডি’র প্রথম নির্বাহী পরিচালক ও সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, করোনা থেকে আমাদের একেবারে বের হওয়ার সুযোগ নেই। এ নিয়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বই অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ সময়ের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে।

সামনের দিনগুলোতে আমাদেরকেও অনিশ্চিয়তা নিয়েই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। বর্তমানে পরিস্থিতি যেদিকে এগুচ্ছে তাতে আগামী দিনগুলোতে রাষ্ট্রকে আরো কর্র্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যাবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যক্তিখাতের চেয়ে রাষ্ট্রের প্রাধান্য আরো বাড়বে। সাক্ষাৎকারের প্রথম অংশ প্রকাশিত হলো আজ-

প্রশ্ন: আমাদের সবার জীবন নতুন এক বাঁকে দাঁড়িয়ে, এক সময় বাঁচার তাগিদে আমরা স্বেচ্ছায় বন্দি হয়েছিলাম। একই কারণে আবার বেরিয়ে পড়েছি। কি দেখছেন চারদিকে?

বাংলাদেশ শুধু না, পৃথিবী, বিশ্বসভ্যতা একটি অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা এমন একটা শত্রুর মোকাবিলা করছি। তার সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা ছিল না। এখন পর্যন্ত তাকে পূর্ণভাবে বুঝে উঠতে পারিনি। সেহেতু আমাদের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ ভিতের এক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। এবং এটা বেশ কিছুদিন থাকবে। এই অনিশ্চয়তার ভিতরে কিভাবে আমরা সমাজ, অর্থনীতি, ব্যক্তি জীবনকে ধারণ করবো এটা নিয়েই সবাই এখন চিন্তিত এবং সেটার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। বাংলাদেশও তার ভিতরে আছে। বাংলাদেশের জন্য এখন যে সমস্যাটা সবচেয়ে বড়, আমাদের বোঝার ব্যাপার এই মুহুূর্তে প্রতিদিন ৩০/৪০ জন করে মানুষ মারা যাচ্ছেন। হাজার হাজার নতুনভাবে শনাক্ত হচ্ছেন। এই বক্ররেখা চূড়ার দিকে যাচ্ছে? আমরা কি শীর্ষ বিন্দু অতিক্রম করছি? নাকি আরো সামনে আছে? যদি আমরা শীর্ষ বিন্দু অতিক্রম করিও তাহলে দ্বিতীয় বার আঘাতের মুখমুখি হবো কি না সেটাও একটা চিন্তা। তৃতীয় চিন্তা হলো যারা একবার আরোগ্য লাভ করলেন, তারা কি আবার দ্বিতীয় বার আবার রোগগ্রস্থ হতে পারেন? এই দুশ্চিন্তাও আছে। যে ধরনের প্রতিষেধক নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেই প্রতিষেধকটি কতখানি সময় আমাদের জন্য কার্যকর থাকবে? এটা কি ৬ মাস, ১ বছর নাকি আরো বেশি। এ সমস্ত বিষয় রয়ে গেছে। যে শত্রুর সঙ্গে আমরা মোকাবিলা করছি, অন্য যেকোন ভাইরাসের থেকে এটা ভিন্ন। কারণ হলো কলেরা বা ম্যালেরিয়ার যে বীজ এটাকে আমরা পর্যবেক্ষণ করার সময় অনেক পেয়েছি। এমনকি নিপা ভাইরাস, সার্স ইত্যাদিও আমরা গবেষণা করার জন্য অনেক বেশি সময় পেয়েছি। এটার সময় মাত্রই কয়েক মাস। সেহেতু আমাদের এই অনিশ্চয়তাটা বিজ্ঞানের দিক থেকে, সামাজিক দিক থেকে, অর্থনৈতিক দিক থেকে এবং ব্যক্তি জীবনে এক ধরনের অনিশ্চিয়তা নিয়েই আগামী দিনকে আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। এই প্রস্তুতিটা এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন: আতঙ্ককে সঙ্গী করে মানুষ নেমে পড়েছে জীবিকার সন্ধানে। দেখি না কি হয়।  এটা কি সমাধানের সূত্র নাকি অতিমারির কাছে অসহায় আত্মসমর্পন?

একটি বিতর্ক প্রায়ই চলে জীবন নাকি জীবিকা। কেউ বলে জীবনকে প্রধিকার দিতে হবে, কেউ বলে জীবিকাকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমার কাছে এই ভাগটি, এই বিভাজনটি,  দ্বৈততাকে আমার এতটি ভ্রান্ত দৈততা মনে হয়। কারণ জীবনধারণ করতে হলে, আপনার শারীরিক পরিস্থিতিকে অক্ষুণ্ন রাখতে হলে, অবশ্যই আপনার আহার করতে হবে। এবং আহার করতে হলে, আহারের জন্য স্বাস্থ্যসেবার জন্য কোনো না কোনো আর্থিক ব্যবস্থা থাকতে হবে। এখন সেই আর্থিক ব্যবস্থা নিজে ব্যক্তিগতভাবে আয় করে করতে পারেন অথবা রাষ্ট্র আপনাকে দিতে পারে। সমাজ আপনাকে সুরক্ষা দিতে পারে। কিন্তু যিনি বলছেন, আমাদের মানুষকে নেমে পড়তে হচ্ছে জীবিকার সন্ধানে, আত্মসমর্পন এটা আসলে জীবনকে ধারণ করার জন্য যে সমর্থন দেয়া দরকার। সেটা দিতে পারছিনা বলে সমস্যাটা হচ্ছে। রাষ্ট্র যদি প্রত্যেককে স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিতে পারতো। সবচেয়ে পিছিয়েপড়া মানুষগুলোকে যদি খাবার দিতে পারতো। তাহলে তো এই মানুষগুলোকে বাসা থেকে বের হতে হয় না। কোনো কোনো দেশে সেই ব্যবস্থা আছে। আমার দেশের রাষ্ট্রের সেই ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম। যেটুকু বা আছে সেটুকু ব্যবহার করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি যথেষ্ট নয়। এখানে দুর্নীতিও হয়। এসব মিলে আমাদের দেশের ভিতরে অবাঞ্চিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অবাঞ্চিত পরিস্থিতিটা আরো বেশি গুরুতর হয়ে গেছে জন্য আমরা সব খুলে দিচ্ছি। এই খুলে দেয়া সুদীর্ঘ চিন্তার ফলশ্রুতি, সেটা অনেক সময় মনে হয় না। সরকারের একেক প্রতিষ্ঠান একেকভাবে বলেন। কথার ভিতরে অনেক সময় সমন্বয় নেই। দ্বিতীয় হলো যে, আজকে যেটা বলেন, কালকে আবার সেটা সংশোধন করেন। সেহেতু একটা চিন্তার ভিতর দিয়ে এটা আসছে বলে মনে হয় না।

প্রশ্ন: নতুন করে লকডাউন শুরু হওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। অলরেডি হয়েছে কয়েক জায়গায়?

লকডাউন করা বা জোনিং করা লাল, নীল, সবুজ এগুলোতো বহু আগেই করা হয়েছে। সরকার একটি দ্বৈত চাপের ভিতর আছে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। সেই অর্থে সরকারের অবস্থান যথেষ্ট সহমর্মিতার সঙ্গে দেখি। কিন্তু ওই অবস্থানকে, ওনাদের ওই চাপকে মোকাবিলা করার জন্য যে সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি বা যে সমস্ত সুযোগ ছিল সেগুলো সরকার ব্যবহার করছে কিনা আমি জানি না। আমি উদাহরণ হিসেবে বলি এটা একটা জাতীয় অতিমারি এবং এটাকে জাতীয়ভাবে মোকাবিলা করা দরকার। সরকার এটা একা করে উঠতে পারবে না। সরকারের সঙ্গে ব্যক্তিখাত, এনজিও, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এবং নাগরিকদের সম্পৃক্তি খুবই দরকার। যে চিকিৎসা দেয়া হলো তার ভিতরে প্রথম দিক থেকে ব্যক্তিখাতের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করা হলো না। গ্রামে গ্রামে ত্রাণ বিতরণ করা হলো কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে যেসব এনজিও যুক্ত আছে তাদেরকে যুক্ত করা হলো না। সেহেতু আমি মনে করি সরকারের এটাকে পুরো সমাজকে, পুরো দেশকে নিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। রাষ্ট্র যেন একা করবে? সরকার কেনো একা করবে? রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে যারা আরো আছেন নাগরিক থেকে, সংগঠন থেকে, ব্যক্তিখাত থেকে এমন কি বৈদেশিক আমাদের যারা সহযোগী আছেন তাদের সকলকে নিয়ে এটা মোকাবিলা করতে হবে। তাহলে আমার মনে হয় অনিশ্চয়তার মাত্রা এবং প্রস্তুতি আরো দৃঢ় হতো।

প্রশ্ন: স্বাস্থ্য ব্যবস্থাতো একেবারে ভেঙে পড়েছে? যেটা আগে ভাবিনি এ রকম অবস্থায় আমার আছি?

বাংলাদেশে সংস্কারের অভাবে এই প্রবৃদ্ধিমুখী উন্নয়ন আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যখাতে আমাদের যে বরাদ্দ, সেই বরাদ্দ জিডিপি’র ১ শতাংশের নিচে। এটা যেকোন নিম্ন আয়ের দেশের গড় মাত্রার চেয়েও নিচে। আমাদের অঞ্চলে সবার চেয়ে নিচে। এটা আমরা আগেও বলেছি। সেটার ফলাফল এখন প্রকাশ পাচ্ছে। আমাদের এখানে উচ্চবর্গের মানুষরাও এই রোগে মারা যাচ্ছেন। এখানে একটু অক্সিজেন, ভেন্টিলেটরের অভাবে ওনাদের জীবন রক্ষা করতে পারছি না। দ্বিতীয়ত, অবকাঠামো দৃশ্যমান উন্নয়নের জন্য এতখানি ব্যস্ত হয়ে গেছিলাম। আমাদের যে নরম সামাজিক খাতগুলো আছে, শিক্ষারগুণগত মান, স্বাস্থখাতকেও অবজ্ঞা করেছি। স্বাস্থ্যখাতে এবারো যে বাজেট দেয়া হলো, সেটাও পুরো বাজেটের ৫ শতাংশের সামান্য বেশি। আগে পাঁচের নিচে ছিল, এখন পাঁচের উপরে এসেছে। গত ৪/৫ বছরে স্বাস্থ্যখাতে যে টাকা দেয়া হয়েছে, সেটার ৮০ শতাংশের বেশি খরচ করা যায়নি। আর যেটা খরচ করা হয়েছে সেটা ৫ টাকার জিনিস আমরা ৫০ টাকা দিয়েও কিনেছি। সেখানেও দুর্নীতি হয়েছে। এখন স্বাস্থ্যখাতের যে করুণ পরিস্থিতি দেখছি, যেটা আমার সাহায্যে সে রকমভাবে কাজ করছে না। এটা আমাদের গত কয়েক বছরের কৃতকর্মের ফলাফল হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

প্রশ্ন: আপনারা অর্থনীতিবিদরা হইচই করেন। নানা আশঙ্কার কথা বলেন। কেউ কারো কথা শুনে না। যেমন ধরুন জিডিপি নিয়ে বিশ্বব্যাংক এক রকম বলল। আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, সিপিডি নানা রকম বলল। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বলেছেন ৮.২ শতাংশই প্রবৃদ্ধি। আসলে রহস্যটা কি?

বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালের প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিভিন্ন সময় সংশয় প্রকাশ করেছি। কিন্ত এবারের প্রবৃদ্ধির হিসেবটা আসলেই জটিল। কারণ হলো কোন তথ্য-উপাত্ত ব্যতিরেকেই এটা করা হয়েছে। বাজেট প্রস্তুতের আগে যে ২ মাসে কোনো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়নি। কারণ জরুরি সেবার অংশ হিসেবে এটার মধ্যে ছিল না এবং সেটা সংগ্রহ করা সরকারের দায়িত্বের ভিতর পড়েনি। সেহেতু এই সংখ্যাটাকে ওই ভাবেই গ্রহণ করতে হবে। এটা আসলেই কোনো অনুমিত সংখ্যা না। সেই ৫.২ শতাংশই এই যে, বছরটা শেষ হচ্ছে সেখানে।  আমরা সকলেই বলেছি ২ শতাংশের উপরে, ৩ শতাংশের উপরে কিছুতেই যাওয়ার সুযোগ নেই। সরকার মনে করছেন লকডাউনের আগে পর্যন্ত সব কিছু ভালো ছিল তারপর সমস্যা হচ্ছে। লকডাউনের আগ পর্যন্ত যদি ৭/৮ মাসের তথ্য দেখেন। একমাত্র রেমিটেন্স ছাড়া আর কোথাও সুবিধাজনক অবস্থায় নেই আমরা। আমাদের রপ্তানি কম ছিল, ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ কম ছিল। ব্যক্তিখাতে ঋণ প্রবাহ ২০১১ সালের মধ্যে সবচেয়ে কম ছিল। তা ৯ শতাংশের নিচে। সেহেতু এটা বলতে পারবো না যে খুব ভালো অবস্থান থেকে করোনাতে ঢুকে গেছি, সেজন্য আমার ৮ হয়নি। ৫ হয়েছে। এটা ঠিক না। আর পরের বছরে যেটা দেয়া হয়েছে সেটা আগের সংখ্যাই ছিল। পূর্ণরূপে প্রকাশ করা হয়েছে। এটাও কোনো তথ্যভিত্তির উপর নির্ভর করে দেয়া হয়নি। এটা পুরনো একটা আকাঙ্খারই প্রতিফলন হয়েছে। রাজনীতিবিদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হলো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আশার কথা বলতে চান, মানুষের মনে আস্থা দিতে চান। সেহেতু তারা সেই ধরনের কোনো উদ্যোগ সৃষ্টি  করতে চান না। তারা এমন কিছু কথা বলেন, এতে সবাই উৎসাহিত বোধ করেন। আর আমরা নীতি বিশ্লেষকরা বাস্তবতার কাছাকাছি থেকে, তথ্য উপাত্ত দিয়ে কথা বলতে চাই। কোনটা সম্ভব, কোনটা সম্ভব না। আমাদের সম্ভাবনার সঙ্গে ওনাদের আশার যে চিন্তা এই দুটোর যোগসূত্র স্থাপন আমরা প্রত্যাশা করি। আশা করবো ওনারা সেটা লক্ষ্য রাখবেন।

প্রশ্ন: করোনা পরবর্র্তী বিশ্ব অর্থনৈতিক যে পরিস্থিতি নিয়ে কিছুদিন আগে আপনার মতামত প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন অনেক দেশই সূচনা বিন্দুতে ফিরে যাবে না। বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?

বাংলাদেশও যাবে না। এটা সম্ভব না। এটা দুই কারণে যাবে না। একটা কারণ হলো দেশের ভিতরে যে পরিস্থিতি চলছে। যে বাজেটটি দেয়া হয়েছে। এই বাজেটে যে অনুমান যার ভিত্তিতে করা হয়েছে। সেটা হলো যে করোনা পরিস্থিতি খুব দ্রুতই আমাদের দেশে শেষ হয়ে যাবে। এক মন্ত্রী প্রত্যক্ষ আলোচনায় আমাকে বলেছেন যে, তিনি আশা করেন জুন মাসের শেষের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এই যে প্রত্যাশা এটা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা আমার সন্দেহ আছে। সেহেতু এই স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলা করতে গিয়ে আমরা যেভাবে সংগঠন, সামাজিক, অর্থনীতি, ব্যক্তি জীবনকে আমরা সাজাবো, সেটা আর আগের মতো থাকবে না। এখন কি দাঁড়াচ্ছে। বর্তমান অবস্থায় দেশগুলোতে এক ধরনের  ডিজিটাল নজরদারির ভিতরে আমাদের ঢুকতে হচ্ছে। ডিজিটাল নজরদারির ইতিবাচকও আছে, নেতিবাচকও আছে। ইতিবাচক দিক এক্সরের মাধ্যমে জানতে পারেন যে আপনার পাশের মানুষটি রোগগ্রস্ত কি না। তার কোনো ধরনের সংক্রমণ আছে কি না। সেই ব্যক্তিকে রাষ্ট্র এটার মাধ্যমে কোথায় আছে কি করছে সব কিছুই নজরদারির মধ্যে রাখতে পারে। একইরকমভাবে যেকোন ব্যক্তিকেই নজরদারির মধ্যে আনা যায়। তার ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা অনেক ক্ষেত্রে সঙ্কুচিত হতে পারে। সেহেতু আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে আগামীতে এক ধরনের ডিজিটাল নজরদারির ভিতরে ঢুকে থাকে। একই রকমভাবে  আগামী দিনে সমাজে ব্যক্তিখাতের চেয়ে রাষ্ট্রের প্রাধান্য অনেক বাড়বে। কারণ রাষ্ট্র এখন আর্থিক সক্ষমতা নিয়ে নাগরিককেও সুরক্ষা দিতে চাইবে, ব্যক্তিপুঁজিকে নিয়ে সামনে আগাতে চাইবে, সে সামাজিক সংগঠনকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে। সেহেতু আমরা আগামী দিনে আরো কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকায় রাষ্ট্রকে আমরা দেখতে পাবো। বাংলাদেশে কি হবে না হবে অনেকখানি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে। রপ্তানি খাতে আমাদের পতন হচ্ছে। রপ্তানি বাজারকে আমরা আবার কিভাবে ফিরিয়ে আনবো। আমাদের অনাবাসিক শ্রমিকরা, প্রবাসী শ্রমিকরা ফিরে আসতে শুরু করছে। প্লেন চালু হলেই আমরা দেখতে পাবো যে কত মানুষ ফিরে আসছে। এবং আগামীদিনে নতুন বাজার কেমন করে পাবো, বিশেষ করে তেলের দাম কম থাকাতে মধ্যপ্রাচ্যে সেই বাজার পাবো কি পাবো না ইত্যাদি বিষয় রয়ে গেছে। আগামী বিশ্ব সহযোগিতা পূর্ণ হবে কি না। নাকি তারা আগ্রাসী প্রতিযোগিতায় নামবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন শুধু না, রাশিয়া, ভারত এবং ইউরোপ মিলিয়ে। এবং তার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের ভূমিকা এবং বিভিন্ন দেশে যে যুদ্ধ চলছে সেটার কি হবে। আন্তর্জাতিক যে সংগঠনগুলো আছে ডব্লিউএইচও, জাতিসংঘ সেখানে আমরা কি ধরনের অভিন্ন মূল্যবোধের ভিতরে একটি সুযোগ পাবো কি না। ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলো তাদের কন্ঠস্বর দেয়ার তার একটা ব্যাপার আছে। অর্থাৎ গণতন্ত্র, কথাবলা, ব্যক্তি স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়গুলো দেশে বিদেশের সব জায়গাতেই একটা চাপের মুখে পড়ার আশঙ্কা সর্বত্র আছে। আবার এর ভিতরে ইতিবাচকও দেখছে। আশাবাদও রয়েছে। আমরা এর ভিতর দিয়ে টের পেলাম যে স্বাস্থ্য সেবায় মনোযোগ না দিলে নাগরিককে রাখা যায় না। একটা সামাজিক সুরক্ষা যদি না থাকে তাহলে বিকশিত মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তকে টিকানো যাবে না। আমরা পরিবেশবান্ধব না হলে আগামীদিনে আরো দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে যাবো। এগুলো কিছু সুশিক্ষাও আছে। এখন কথা হলো আমরা সেই সুশিক্ষাগুলো নিবো কিনা।