আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চাপ কমাতে থার্ড টার্মিনাল দ্রুত চালু করা জরুরি: মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in আমাদের সময় on 27 October 2025

বিমানবন্দরে জাপানি অপারেটর অনিশ্চিত, চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশী হাতে টার্মিনাল দেওয়ার প্রস্তুতি

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২১ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন নতুন টার্মিনাল ভবন (থার্ড টার্মিনাল)। জাপানের একটি কনসোর্টিয়ামকে এ টার্মিনালের অপারেটর নিয়োগ করতে দীর্ঘ সময় ধরে দেনদরবার চালাচ্ছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। প্রায় দুই বছর ধরে দরকষাকষি চললেও এখনো জাপানি কনসোর্টিয়ামকে চূড়ান্ত করা যায়নি। আবার থার্ড টার্মিনাল পরিচালনায় জাপানি অপারেটর থাকলেও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মাধ্যমে সরকার বিমানকে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দিতে চায়।

অন্যদিকে বাংলাদেশের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগে পরিচালিত হওয়া চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এনসিটিসহ তিনটি টার্মিনালে পর্যায়ক্রমে বিদেশী অপারেটর নিয়োগ প্রক্রিয়া জোরেশোরে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিকে বিমানবন্দর অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর—দুটো ভিন্ন ক্ষেত্র হলেও উভয় জায়গায়ই আমাদের নিজস্ব দক্ষতা ও সক্ষমতা উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। সেটা কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সেদিকে সরকারের নজর দিতে হবে।

যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশী বিনিয়োগ ও সক্ষমতা বাড়াতে বিদেশী অপারেটর নিয়োগ প্রয়োজন। তবে সরকারের এ সিদ্ধান্তে দেশের সার্বভৌমত্ব, কর্মসংস্থানসহ নানা ক্ষেত্রে হুমকি দেখছেন অর্থনীতিবিদ, পেশাজীবী ও বিভিন্ন সংগঠন-সংশ্লিষ্টরা।

শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালটি ২০২৩ সালের অক্টোবরে ‘সফট ওপেনিং’ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ওই সময় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) পদ্ধতিতে নতুন এ টার্মিনাল পরিচালনায় জাপানের একটি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়। থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংসহ সব পরিচালন কাজ এ কনসোর্টিয়ামকে দিয়ে করানোর ব্যাপারে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েও নেন বেবিচক কর্মকর্তারা। কিন্তু গত বছরের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দুই বছরের জন্য থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কাজ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্ত জাপানি কনসোর্টিয়ামকে ক্ষুব্ধ করে বলে জানিয়েছে কয়েকটি সংশ্লিষ্ট সূত্র। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এখন আর অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে থার্ড টার্মিনাল চুক্তি করতে আগ্রহী নয় জাপানি কনসোর্টিয়াম। তাদের যুক্তি, রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে থার্ড টার্মিনালে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংসহ রাজস্ব ভাগাভাগি চুক্তিতে তারা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবেন। ফলে চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে জাপানি কনসোর্টিয়াম আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে আগ্রহী। যদিও জাপানি কনসোর্টিয়াম অন্তর্বর্তী সরকারকে এ ধরনের কোনো ইঙ্গিত দেয়নি বলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।

বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তুত অবস্থায় থাকা থার্ড টার্মিনাল গত মাসে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট টার্মিনালটি ব্যবহারও করেছে। তবে জাপানি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে থার্ড টার্মিনালের চুক্তি মূলত রাজস্ব ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনায় আটকে রয়েছে বলে গত মাসে জানিয়েছিলেন বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক।

থার্ড টার্মিনাল বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘আমাদের বিমানবন্দরের বিদ্যমান সক্ষমতার অনেক বেশি প্যাসেঞ্জার সামলাতে হয়। প্রয়োজনেই নিরিখেই এটা চালু করা দরকার। ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করে থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ হয়েছে। এর জন্য তো প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থের ডেট সার্ভিসিং করতে হবে। আর টার্মিনালটি চালু হলে বিমান ভাড়ার যে নৈরাজ্য চলছে তা অনেকাংশে প্রশমিত হবে। কারণ অন্যান্য ইন্টারন্যাশনাল প্লেন আরো আসা শুরু করবে। এয়ারপোর্টের ক্ষেত্রে আমাদের আলোচনা শেষ পর্যায়ে রয়েছে। শেষ পর্যায়ের এ আলোচনা যেহেতু সরকারি পর্যায়ের, অতএব আমরা চাইলেই এ আলোচনা হঠাৎ করে থামিয়ে দিতে পারি না। তাই জিটুজির পরিক্রমাটা শেষ করেই আমরা নতুন কোনো কিছু চিন্তা করতে পারি।’

দেশে বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি, অব্যবস্থাপনা, লাগেজ চুরি, কার্গো ব্যবস্থাপনায় ধীরগতিসহ নানা অনিয়ম দীর্ঘদিনের। এসব কারণে দীর্ঘদিন ধরে লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে উঠে আসছে দেশের উড়োজাহাজ খাত। এসব বিষয় পাসপোর্ট র‍্যাংকিংয়ে প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, একটি দেশের উড়োজাহাজ শিল্পের ব্যবস্থাপনা, বিশেষত বিমানবন্দরে হয়রানি, অনিয়ম, নিরাপত্তা, দুর্নীতি, সময়ক্ষেপণসহ নানা বিষয় এ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অনুসরণ করে। এমনকি সম্প্রতি কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ড বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার বিষয়টিও সামনে এনেছে। যা আন্তর্জাতিক আকাশরুটে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। এসব সমস্যা কাটাতে এবং আকাশপথে সহজে পণ্য পরিবহনে থার্ড টার্মিনাল দ্রুত চালু করা প্রয়োজন বলে মনে করেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।

জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ওপর যে ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে, এ পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই থার্ড টার্মিনাল দরকার। সম্প্রতি কার্গো ভিলেজে যেটা হয়েছে সেই অভিজ্ঞতা থেকে এটাও বলতে হবে যে একটার ক্ষেত্রেই আমরা নিরাপত্তা দিতে পারি না, আবার নতুন থার্ড টার্মিনালের মতো এত বড় স্থাপনার নিরাপত্তা দিতে হবে। এ বিষয়গুলোতে নজর দেয়া প্রয়োজন। বিদেশী ঋণের টাকায় এত বড় বিনিয়োগ, সেটার গ্রেস পিরিয়ড চলছে, সুদ দিতে হচ্ছে। গ্রেস পিরিয়ড শেষ হলে রিপেমেন্ট পিরিয়ডের সুদ ও আসল দুই-ই দিতে হবে। এ টাকা উঠবে কীভাবে? ফলে দ্রুত থার্ড টার্মিনাল চালু করে আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনসকে কীভাবে আমরা আকর্ষণ করতে পারি, সেদিকে নজর দিতে হবে।’

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান আরো বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশীদের ব্যবস্থাপনায় দেয়া কতটা সঠিক সেটা ভিন্ন আলোচনা। নিজস্ব স্বার্থ সুরক্ষা কতটা নিশ্চিত করে বিদেশী কোম্পানিকে ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত করতে পারব, সেই বিষয় রয়েছে। এটা একটা নীতিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। চট্টগ্রাম বন্দর চলমান রয়েছে, এর ব্যবস্থাপনা বিদেশী কোম্পানিকে না দিলে এটি চালুই থাকবে। চলমান বন্দরটিই আমরা নিজেদের ব্যবস্থাপনা থেকে অন্য ব্যবস্থাপনায় দিতে চাচ্ছি। স্পর্শকাতর একটা জায়গা আমি অন্য কাউকে দেব কি দেব না, কী শর্তে দিচ্ছি, সিকিউরিটির বিষয়টি কী, তারা আমাদের কী ধননের রিটার্ন দেবে—এ ধরনের বিষয় নিয়ে ভিন্ন বিতর্ক হতে পারে।’

চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান প্রবেশদ্বার। বিগত অর্থবছরে মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের ৮৩ শতাংশই এ বন্দর দিয়ে হয়েছে বলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে।

চট্টগ্রাম বন্দরে মোট চারটি কনটেইনার টার্মিনাল চালু আছে। এগুলো হলো নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি), জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি) ও রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি) চিটাগাং, যা পতেঙ্গা টার্মিনাল নামে পরিচিত। এর মধ্যে পতেঙ্গা টার্মিনালে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার গত বছর জুনে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল বা আরএসজিটিআইকে অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দেয়। বাকি তিনটির মধ্যে নিউমুরিং বা এনসিটি পরিচালনা করত দেশীয় অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। কোম্পানিটির সঙ্গে গত ৬ জুলাই চুক্তি শেষ হওয়ায় বর্তমানে বন্দর কর্তৃপক্ষ নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান চিটাগাং ড্রাই ডক লিমিটেডকে এটি পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। বাকি দুটি টার্মিনাল—জিসিবি ও সিসিটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে।

চালু চার টার্মিনালের মধ্যে সবচেয়ে বড় টার্মিনাল এনসিটি। এটিতে বিদেশী অপারেটর নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার তোড়জোড় চালাচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এনসিটিতে বিদেশী অপারেটর নিয়োগ দিতে চায় সরকার। চারটি টার্মিনালের মধ্যে এনসিটিকে বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিভিন্ন মহলে জোর আপত্তি উঠেছে। বিশেষ করে শ্রমিক সংগঠন ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, এনসিটিতে জেটি ও আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনাসহ বিভিন্ন খাতে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। আগামী দুই দশকে নতুন করে এ টার্মিনালে বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। এটি বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেই পরিচালনা করতে পারে। তাছাড়া বন্দরের সবচেয়ে বেশি আয় হয় এনসিটি টার্মিনাল থেকে। তাই এটি বিদেশী অপারেটরদের হাতে ছেড়ে দিলে বন্দরের আর্থিক ক্ষতি হবে।

সীকম গ্রুপের চেয়ারম্যান আমিরুল হক বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের কোনো টার্মিনাল বিদেশী অপারেটরদের হাতে তুলে দেয়া যাবে না—বন্দর ব্যবহারকারীরা এমনটা কখনো বলছে না। বরং আমরা বলছি যে পুরোপুরি সরকারের অর্থায়নে এনসিটির মতো সাজানো একটা টার্মিনালে কেন বিদেশী অপারেটর যুক্ত হতে হবে? এখানে নদীর বাঁক, জোয়ার-ভাটাসহ আরো যেসব প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সেগুলো যত বড় আন্তর্জাতিক অপারেটরই হোক না কেন, তারা সমাধান করতে পারবে না। বরং বে-টার্মিনালসহ রাষ্ট্রের অর্থায়ন হয়নি, যন্ত্রপাতি ব্যয় করা হয়নি, সেখানে বিদেশী অপারেটর আনা যেতে পারে। এটা করা গেলে শুরু থেকেই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটিয়ে তারা দক্ষতার ছাপ রাখতে পারবে।’

অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদেশী অপারেটর নিয়োগ দেয়া গেলে বন্দরে বিনিয়োগ, ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতা বাড়বে। তবে বন্দর পরিচালনায় দক্ষতা কতটা বাড়বে, তা এককভাবে শুধু অপারেটরের ওপর নির্ভর করে না বলে জানিয়েছেন বন্দর বিশেষজ্ঞরা।

তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বন্দর অপারেটরের মূল কাজ শুরু হয় জেটিতে জাহাজ ভেড়ানোর পর। জাহাজ জেটিতে ভেড়ানোর পর আমদানি কনটেইনার নামানো হয় এবং রফতানি কনটেইনার জাহাজে তোলা হয়। বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর এ প্রক্রিয়া নির্ভর করে। প্রথমত, বন্দরে পর্যাপ্ত জেটি থাকা। এটা না থাকলে বেশির ভাগ সময় জাহাজ বন্দরে ভিড়লেও অপেক্ষা করতে হয়। কর্ণফুলী নদীতে বন্দরের সবক’টি জেটি নির্মাণ করায় সাগর থেকে নদীতে ভিড়তে জাহাজকে অনেক সময় জোয়ারের অপেক্ষা করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, জট না থাকলেও গড়ে প্রতিটি জাহাজকে অন্তত ১৪ ঘণ্টা করে অপেক্ষা করতে হয়। দ্বিতীয়ত, কাস্টমস প্রক্রিয়ার ওপর। বন্দরে পণ্য নামানোর পর তা কাস্টমস প্রক্রিয়া শেষ করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এনবিআরের ২০২২ সালের টাইম রিলিজ স্টাডি অনুযায়ী, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের মাধ্যমে পণ্য খালাসে গড়ে সময় লাগে ১১ দিন ৬ ঘণ্টা। ফলে কাস্টমস প্রক্রিয়া ধীরগতিতে হলে এখানে অপারেটরের কিছু করার নেই। তৃতীয়ত, বন্দর থেকে পণ্য খালাসের পর পরিবহন-সংক্রান্ত জটিলতা। বিশেষত সড়ক, নৌ ও রেলপথে এসব কনটেইনার পরিবহন করা হয়। সড়কে যানজট থাকায় এবং কনটেইনার টার্মিনালের দূরত্বের কারণে বেশির ভাগ সময় জাহাজকে জেটিতে অপেক্ষা করতে হয়। এতে বন্দরে পণ্যবাহী কনটেইনারের জটলা বেঁধে যায়।

বাণিজ্য ফ্যাসিলিটেশনের প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম বন্দরে দুটি কর্তৃপক্ষ, একটা কাস্টমস আরেকটা পোর্ট—এ তথ্য উল্লেখ করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘আমাদের দেখতে হবে যে কীভাবে আমরা সবচেয়ে বেস্ট টার্ন অ্যারাউন্ড করতে পারি। অবশ্যই টার্ন অ্যারাউন্ড সময় আমাদের অনেক বেশি। আমাদের প্রায় দেড়শ বিলিয়ন ডলারের ওপরে বাণিজ্য। এ ভলিউমের জন্য যে পরিমাণ কার্গো আমাদের হ্যান্ডলিং করার প্রয়োজন সেটার জন্য কাস্টমস ও পোর্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে যে কনভার্জ করা দরকার, সেই কনভার্জেন্সে আমাদের অভাব রয়েছে। এটা নিশ্চিত করা গেলে বন্দরের দক্ষতা ও গতিশীলতা অনেক বাড়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বলা সহজ করা কঠিন। এই করা কঠিন জায়গায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার হয়। তাতে করে প্রতিবন্ধকতাগুলো বস্তুগতভাবে উপলব্ধি করে নিরাময় করা সম্ভব।’

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ও লালদিয়া এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁও টার্মিনাল বিদেশী অপারেটরের হাতে ছেড়ে দেয়া হবে। ডিসেম্বরেই এ চুক্তি সম্পাদন করা হবে। চুক্তি অনুযায়ী লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল ৩০ বছর পরিচালনা করবে একটি বিদেশী কোম্পানি। পাশাপাশি বাকি দুটি টার্মিনাল ২৫ বছর মেয়াদের জন্য ছেড়ে দেয়া হবে।

বন্দরের শ্রমিক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের দাবি, নিউমুরিং টার্মিনালের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর বিপুল রাজস্ব আয় করছে। এ বন্দরের মোট হ্যান্ডলিংয়ের ৫৫ শতাংশ এনসিটি টার্মিনালে হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ অত্যাধুনিক ও উন্নতমানের নতুন যন্ত্রপাতি ক্রয় করেছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য ৫ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে এ টার্মিনালে কোনো ধরনের বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই।

নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশী অপারেটরের হাতে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্তটি ২০২৩ সালে নিয়েছিল ক্ষমতাচ্যুত তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। আর সে কাজটিই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠানটিকে যে টার্মিনালে অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, ওই টার্মিনালে একসঙ্গে তিনটি জাহাজ ভেড়ানোর তিনটি জেটি রয়েছে। একটি জাহাজ গড়ে তিনদিন অবস্থান করলে মাসে ১০টি জাহাজ ভেড়ানো যায়। সেক্ষেত্রে তিন জেটিতে মাসে ৩০টি জাহাজ ভেড়ার কথা। তবে টার্মিনালে কনটেইনার রাখার পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় মাসে ২০টির বেশি জাহাজ ভেড়ানোর সুযোগ হয় না।

বন্দরের জেটি পরিচালনাকারী বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বার্থ অপারেটরস, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরস ও টার্মিনাল অপারেটরস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলে একরাম চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের বার্থ অপারেটররা কাঠখড় পুড়িয়ে নিজেদের দক্ষ করে তুলেছে। বার্থ অপারেটরদের সম্মিলিত উদ্যোগ বড় বড় টার্মিনাল পরিচালনা করতে সক্ষম। এনসিটিতে তো স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করার সুবিধা তৈরি করাই আছে। সরকারের উচিত যেকোনো পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ নিশ্চিত করা।’

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের পাশাপাশি লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্বও শিগগিরই বিদেশী অপারেটরদের দেয়ার প্রস্তুতি রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের। পরের ধাপে বে-টার্মিনাল প্রকল্পের দুটি টার্মিনালও বিদেশী অপারেটরদের দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে সরকার।

পোর্ট ইউজার্স ফোরামের আহ্বায়ক আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বিদেশী অপারেটরদের সুবিধা করে দিতে বন্দরের মাশুল বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া এভাবে এক লাফে এত বড় পরিসরে মাশুল বাড়ানোর ভিন্ন কোনো কারণ থাকতে পারে না৷। কারণ ৮৬ টাকার ডলার বেড়ে এখন ১২০ টাকায় ঠেকেছে। বন্দরের মাশুল আদায় হয় ডলারের হিসাবে।’

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বন্দর দিয়ে আমদানি–রফতানি ও খালি কনটেইনার পরিবহন হয়েছে ৯ লাখ ২৭ হাজারটি। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে এ সংখ্যা ১ লাখ ১ হাজার একক কনটেইনার বেশি।

বিমান কিংবা সমুদ্র—দুই ধরনের বন্দর পরিচালনার ক্ষেত্রেই দেশী প্রতিষ্ঠানকে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দেয়া উচিত বলে মনে করেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সাবেক পর্ষদ সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম। তিনি বলেন, ‘এয়ার ও সি পোর্ট—এ দুটির মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। ঢাকা এয়ারপোর্টে যাত্রী পরিবহন করা হয় এবং স্বল্প পরিমাণে পণ্য পরিবহন হয়। সমুদ্রপথে যত বেশি পণ্য যায় তার তুলনায় খুব কম যায় বিমানপথে। থার্ড টার্মিনাল পড়ে থাকার দুটো কারণ আছে। একটা গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, আরেকটা টার্মিনাল হ্যান্ডলিং। এক্ষেত্রে টার্মিনাল হ্যান্ডলিংয়ে বাংলাদেশের ব্যবস্থা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনইউজুয়াল। আমাদের এখানে টার্মিনাল হ্যান্ডলিং করছে সিভিল এভিয়েশন। এটা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বিশ্বের প্রায় সব দেশে টার্মিনাল হ্যান্ডলিং করে একটি স্বাধীন কোম্পানি। আমাদের এখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হলেও টার্মিনাল হ্যান্ডলিং করে সিভিল এভিয়েশন। আবার এয়ারপোর্টে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করে বিমান। যদিও বিশ্বের অন্যান্য দেশে একাধিক গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং এজেন্ট থাকে। এতে সেবা মূল্যসহনীয় হয়। অনেক অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের এখানে অদ্যাবধি বিমান গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করে আসছে।’

কাজী ওয়াহিদুল আলম আরো বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষেত্রে বড় ধরনের কর্মযজ্ঞ রয়েছে। এ জায়গা খুবই ক্যাপিটাল ইনটেনসিভ। যথাযথ বিনিয়োগ না হওয়ার কারণে বন্দরের সক্ষমতার পুরোপুরি ব্যবহার হচ্ছে না। বর্তমানে বন্দরের ব্যবহারকারীরা যে সেবা পাচ্ছেন তা অনেক গুণ বাড়ানো সম্ভব। আমাদের সীমিত সাধ্যে নিশ্চিত করা যাবে না বিধায় সরকার মনে করেছে বিদেশী ব্যবস্থাপনায় বন্দর অপারেট করা গেলে পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করা সম্ভব হবে। বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মক্ষমতা বাড়বে। দুই বন্দরের বিষয়টি তুলনা করলে আমরা দেখব উভয় ক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়ানোর দরকার আছে। এ বিষয়ে কারো মতপার্থক্য নেই। দুই ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট করতে হবে।’

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘বিমান ও সমুদ্র—দুই বন্দর নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো বৈসাদৃশ্য বা ঘাটতি আমি দেখি না। কিন্তু পদ্ধতিগত বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করাও তো সম্ভব না। বিশেষ করে যখন বিষয়গুলো সরকার থেকে সরকার পর্যায়ে হয়, তখন উপেক্ষা করা সম্ভব না। আমাদের এখানে দৃষ্টিভঙ্গির কোনো বৈসাদৃশ্য নেই। আগ্রহের কোনো ঘাটতি নেই। আবার প্রচেষ্টারও ঘাটতি নেই।’