আলোচনা স্থগিতের ঘটনাটি আমাদের জন্য খুবই নেতিবাচক সংবাদ – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in বণিক বার্তা on 1 August 2024

অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি

বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা স্থগিত করেছে ইইউ

বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে নতুন অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরুর ঘোষণা আসে গত বছরের অক্টোবরে। সে সময় ব্রাসেলসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ইইউর গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরাম চলাকালে এ আলোচনা শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন ইউরোপিয়ান কমিশনের (ইসি) প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেইনে। আগামী সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্ভাব্য এ চুক্তি নিয়ে প্রথম আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। দেশে বিরাজমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সে আলোচনা স্থগিত করেছে ইসি।

ইসি বলছে, বাংলাদেশে চলমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এ আলোচনা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে গতকাল ৩১ জুলাই বণিক বার্তার পাঠানো এক ই-মেইলের উত্তরে সংস্থাটির মুখপাত্র নাবিলা মাসরিলা বলেন, ‘সেপ্টেম্বরে অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির প্রথম দফা আলোচনা হওয়ার পরিকল্পনা ছিল। বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে এটি স্থগিত করা হয়েছে। পরবর্তী দিনক্ষণ এখনো ঠিক করা হয়নি। ইইউর পররাষ্ট্র বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ জোসেফ বোরেল ফন্টেলেসের গত ৩০ জুলাই প্রকাশিত বিবৃতিটিই এ বিষয়ে ইসির বর্তমান অবস্থান।’

প্রসঙ্গত, ৩০ জুলাই প্রকাশিত ওই বিবৃতিতে জোসেফ বোরেল কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগ এনে এ ঘটনার নিন্দা জানান। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষের ঘোষিত শ্যুট অ্যাট সাইট নীতি এবং বেআইনি হত্যাকাণ্ডের ঘোষণায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ঘটা নিয়মবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সহিংসতা, অত্যাচার, গণগ্রেফতার ও ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনায় আমরা নিন্দা জানাই। এছাড়া আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের নিহত হওয়া, সহিংসতা, নির্যাতন, গণগ্রেফতার ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষতিসাধন নিয়েও আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’

বিবৃতিতে এসব ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে উল্লেখ করে জোসেফ বোরেল আরো বলেছিলেন, ‘বিক্ষোভকারী, সাংবাদিক, তরুণ ও শিশুদের গ্রেফতারের ঘটনা নিয়ে যথাযথ তদন্ত হতে হবে। আমরা এ সংকটের প্রেক্ষাপটে কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপগুলো নিবিড়ভাবে অনুসরণ করব এবং ইইউর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে আমলে নিয়ে আমরা আশা করব, বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষ মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানাবে।’

আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সহিংসতার ঘটনাগুলো নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে প্রথম প্রতিক্রিয়া জানায় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করতে শুরু করে। এ ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে প্রথম ধাপের আলোচনা স্থগিতের সিদ্ধান্ত জানাল ইসি।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ইইউর এ অবস্থান এবং আলোচনা স্থগিতের সিদ্ধান্তকে পশ্চিমা বিশ্বের চাপের অংশ হিসেবেই দেখছেন নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যা সাময়িক। অঞ্চলটি দ্রুত এ অবস্থান থেকে সরে আসবে বলে প্রত্যাশা করছেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হাই-রিপ্রেজেনটেটিভ আমাকে বলেছেন, তাদের কিছু উদ্বেগ রয়েছে। এত লোক মারা গেল কেন, এটি একটি উদ্বেগ। এ বিষয়ে তারা স্বচ্ছ, পূর্ণাঙ্গ ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত চান। এছাড়া উদ্বেগ রয়েছে ব্যাপক ধরপাকড় নিয়েও। তিনি বলেছেন, ধরপাকড় প্রমাণভিত্তিক হওয়া উচিত। ব্যাপক হওয়া উচিত না এবং হয়রানিমূলক যেন না হয় সে বিষয়েও জোর দিয়েছেন তিনি। তারা এটা পর্যবেক্ষণ করবেন।’

‘শ্যুট অ্যাট সাইট’ নীতি নিয়ে তারা খুবই বিচলিত উল্লেখ করে ড. মোমেন বলেন, ‘তারা বলছেন এটা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে হতে পারে না। আলোচনা স্থগিতের বিষয়টি হচ্ছে আমাদের ওপর এক ধরনের চাপ দেয়ার প্রচেষ্টা। আমরা যে এমওইউ সই করেছি, সেটি একতরফা না। তারা টাকা-পয়সা দিতে চায়। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে তাদের আগ্রহ রয়েছে। কাজেই এটি একতরফা না। তারা বাদ দিয়ে দিলেন আর আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলাম, বিষয়টি এমন নয়। তাদেরও ক্ষতি হবে। কারণ এ অঞ্চলে আমরা গুরুত্বপূর্ণ দেশ। এজন্যই পশ্চিমা বিশ্বের এত মাথাব্যথা। তারা চায় আমরা তাদের ঢঙে কাজ করি। কিন্তু আমরা এখনো তাদের ঢঙে কাজ করি না। আমাদের স্বাধীন, নন-অ্যালায়েন্ট ও ভারসাম্যপূর্ণ বৈদেশিক নীতি রয়েছে। আমরা তাদের লেজুড় হইনি।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের অক্টোবরে ব্রাসেলস সফরে গিয়েছিলেন। সে সময় বাংলাদেশ ও ইইউর মধ্যে অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে নতুন আলোচনা শুরুর ঘোষণা আসে। ওই সময় ইইউ, ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (ইআইবি) ও বাংলাদেশের মধ্যে দেশের বিদ্যুৎ খাতের পরিবেশবান্ধব রূপান্তরসংক্রান্ত ৪০ কোটি ইউরোর একটি চুক্তি হয়। এছাড়া শিক্ষা খাত, কর্মপরিবেশ, পরিবেশবান্ধব নির্মাণ, ই-গভর্ন্যান্স এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে ৭ কোটি ইউরো অর্থমূল্যের আরো পাঁচটি সহযোগিতামূলক পদক্ষেপসংক্রান্ত চুক্তি হয়।

বাংলাদেশের রফতানিযোগ্য পণ্যের সবচেয়ে বড় গন্তব্য হলো ইইউর দেশগুলো। অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধার (জিএসপি) আওতায় ইইউতে শুল্কমুক্ত পণ্য প্রবেশাধিকার পায় বাংলাদেশ। এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে অর্থমূল্য বিবেচনায় বাংলাদেশের মোট পণ্য রফতানির ৪৫ শতাংশের বেশি যায় ইইউভুক্ত দেশগুলোয়। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর ২০২৬ সাল নাগাদ অঞ্চলটিতে জিএসপি প্লাস সুবিধা নিয়ে দরকষাকষি শুরু করবে বাংলাদেশ।

তবে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও অন্যান্য খাতে বড় ধরনের কোনো টানাপড়েনের কারণ হয়ে দেখা দেবে না বলে আশাবাদী নীতিনির্ধারকরা। তাদের বক্তব্য হলো গোটা বিষয় নির্ভর করছে বাংলাদেশ কীভাবে এ পরিস্থিতি সামাল দেয় তার ওপর।

যেকোনো ধরনের অনিশ্চয়তা দুই পক্ষের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন শিল্প-বাণিজ্য খাতের প্রতিনিধিরা। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তারা আমাদের অংশীদার। অংশীদার যখন দেখে আরেক অংশীদারের ওখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে, তখন তারা একটু সতর্ক হয়। সেই অনুযায়ী আমরাও চেষ্টা করছি কীভাবে কত দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যায়। বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে ঘটনা ঘটেছে এক রকম আর বহির্বিশ্বে প্রচার হয়েছে আরেক রকম।’

এদিকে ব্রাসেলসে অবস্থানরত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে গতকাল বৈঠক করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বহিঃসম্পর্কবিষয়ক মহাসচিব স্টিফানো সেনিনো। এ সময় তিনি বিক্ষোভকারীদের ওপর বলপ্রয়োগের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পাশাপাশি সংকট নিরসনে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন।

আলোচনার পর স্টিফানো সেনিনো নিজের এক্স অ্যাকাউন্টে (সাবেক টুইট) পোস্টে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং সাম্প্রতিক বিক্ষোভে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগে গভীর উদ্বেগ পুনর্ব্যক্ত করেছি। আমি আন্দোলনে যুক্তদের সঙ্গে আচরণের জবাবদিহিতা নিশ্চিত ও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছি। বাংলাদেশের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্কের একটি মৌলিক উপাদান হলো মানবাধিকার।’

যদিও স্টিফানো সেনিনোর সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় সংকট উত্তরণে বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গতকাল মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এমন বক্তব্য দেয়া হয়।

তবে আলোচনা স্থগিতের সিদ্ধান্তটিকে বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক বার্তা হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্যমতে, ইইউর বাজার ও বাণিজ্যসহ দ্বিপক্ষীয় সার্বিক সম্পর্কেই এর প্রভাব পড়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আলোচনা স্থগিতের ঘটনাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এটা আমাদের জন্য খুবই নেতিবাচক সংবাদ। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে ইইউর সম্পর্কটি বিশেষ সম্পর্ক। গোষ্ঠীগত বাজার হিসেবে ইইউ আমাদের সবচেয়ে বড় বাজার। রফতানির একটা বড় অংশই ইইউতে যায়। জোটটি এতদিন ধরে আমাদের বাজার সুবিধা দিয়েছে। আরো তিন বছর বাজার সুবিধা দেয়ার কথা বলছে। যে আলোচনাটি শুরু হওয়ার কথা, এটার অধীনে বহুমাত্রিক সুবিধার আশ্বাস ছিল। এমন একটা অবস্থায় ইইউর মতো বন্ধুপ্রতিম সংঘ যখন বর্তমান সহিংসতার কারণে আলোচনা স্থগিত করে, এটি বাংলাদেশের জন্য খুবই নেতিবাচক আভাস। স্থগিতের এ ঘটনা আমাদের অন্য সহযোগীরাও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে ও দেখবে। এর সম্ভাব্য অভিঘাত অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের ওপরেও পড়বে। ইইউর সঙ্গে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, বাজার সুবিধা থেকে শুরু করে সব ধরনের সম্পর্কে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকবে। সুতরাং যেসব কারণে তারা আলোচনা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, উচিত হবে সেটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া এবং যেসব কারণ তারা উল্লেখ করেছে সেগুলোর সম্পর্কে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া।’