ইসলামী ব্যাংকে অনিয়মের ঘটনাগুলো দেশের ব্যাংকিং খাতে একটি উদাহরণ তৈরি করেছে – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in bdnews24 on 21 August 2024

ব্যাংক খাতে সংস্কার শুরু ইসলামী ব্যাংক দিয়ে?

অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “সংস্কারের কাজটি এমনভাবে শুরু করতে হবে, যাতে ব্যাংক খাতে কোনো প্যানিক তৈরি না হয়। আমানতকারীরা যেন ভয় না পান।”

রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনায়, পুরনোদের জায়গায় এসেছে নতুন মুখ; ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে এই খাতের অনিয়ম ও জীর্ণদশার চিত্র।

এমন অবস্থায় তারল্য সংকট ও জালিয়াতির খেলাপি ঋণে জেরবার ব্যাংক খাতের সংস্কারে হাত দিতে যাচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। অন্তর্বর্তী সরকারের সায়ও মিলেছে তাতে।

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গভর্নরের প্রথম বৈঠকেই আর্থিক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি এবং সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করে তা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১০০ দিনের মধ্যে তা প্রকাশ করার সিদ্ধান্তও হয়েছে।

সংস্কারের এ কাজ শুরু হচ্ছে আলোচিত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশকে দিয়ে, যে ব্যাংক এক সময় ঋণ ও আমানতে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের স্বীকৃতি পেলেও অনিয়ম ও কেলেঙ্কারিতে নাজুক দশায় পৌঁছেছে। সরকার পরিবর্তনের পর মালিকানা বদলকে কেন্দ্র করে অনিয়মের বিষয়গুলো নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

এমন প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত রোববার গভর্নরের নেতৃত্ব একটি সভা করেছে ব্যাংক খাতের সংস্কারের আশু পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে।

সভায় থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, চলতি সপ্তাহেই সংস্কারের কাজটি শুরু হবে।

সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদে পরিবর্তন আনতে চাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরই ব্যাংকটির পুরো আর্থিক মান দেখতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নীরিক্ষক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হবে।

এজন্য ব্যাংকটিতে বেশ কিছু তথ্য চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি নতুন ঋণ বিতরণে সতর্কতা ও একসঙ্গে তিন কোটি টাকার বেশি অর্থ নেওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

প্রবল গণ আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা গত ৫ অগাস্ট দেশ ছাড়ার পর আত্মগোপনে চলে যান সরকারঘনিষ্ঠ আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারক ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, ব্যাংক পরিচালকদের একটি অংশ। গা-ঢাকা দিয়েছেন দেশের এক সময়ে সবচেয়ে বড় ব্যাংক হয়ে ওঠা ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদের অনেকেই।

এর পর থেকে প্রকাশ্য দেখা যায়নি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস- বিএবির চেয়ারম্যান ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারকেও। অনেক ব্যাংকের চেয়ারম্যানও দেশের বাইরে রয়েছেন।

এরমধ্যেই অনিয়ম ও সুবিধার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোর একের পর এক বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়ার খবর সামনে আসছে।

এমন প্রেক্ষাপটে সব মিলিয়ে অনিয়মে ন্যুজ হয়ে পড়া ব্যাংক খাত সংস্কারে ‘ব্যাংকিং কমিশন’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তবর্তীকালীন সরকার।

ব্যাংক খাতে সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সোমবার থেকে ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের নতুন ঋণ বিতরণ বন্ধ করার নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এলসি খোলায় শতভাগ নগদ টাকায় সম্পাদন করতে নির্দেশনা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, এতে ব্যাংকটি থেকে নতুন অর্থায়নের পথ বন্ধ হবে। তবে, কৃষি ও এসএমই ঋণের মত ক্ষুদ্রঋণ বিতরণে শুধু সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছে।

ব্যাংকটির পর্ষদ পুনর্গঠন বা ভেঙে দেয়ার বিষয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, “শেয়ারের মালিকানা নেয়ার মাধ্যমে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিচালক নিয়োগের সুযোগ আছে। এ পথটি একটি আইনি প্রক্রিয়া, এতে সময় লাগবে।”

পিসিএর আওতায় বা ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংককে যে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া আছে, তাও প্রয়োগের পরামর্শ এই অর্থনীতিবিদের।

“ইসলামী ব্যাংকের জন্য একটি অ্যাকশন প্ল্যান করে প্রশাসক বসিয়ে বা স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়ে ব্যাংকটিকে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরাসরি বা সবচেয়ে বেশি প্রভাব থাকবে ব্যাংকটির পর্ষদে।”

শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের পাশাপাশি প্রচলিত ব্যাংকগুলোতেও সমস্যা কম নয়।

প্রথমেই সবচেয়ে বেশি খারাপ ব্যাংক সংস্কারে হাত দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, “সংস্কারের কাজটি এমনভাবে শুরু করতে হবে, যাতে ব্যাংক খাতে কোনো প্যানিক তৈরি না হয়। আমানতকারীরা যেন ভয় না পান।”

খেলাপি ও ঋণ কেলেঙ্কারির বোঝা

১৫ বছর আগে ২০০৮ সালে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। সেটি বাড়তে বাড়তে গত মার্চে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায়।

তবে এটি প্রকৃত খেলাপি ঋণ নয় বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি সভাপতি সেলিম আর এফ হোসেন।

গত সপ্তাহে সিপিডি আয়োজিত সেমিনারে তিনি বলেছেন, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণসহ যে সমস্যা দেখা যাচ্ছে, তার গভীরতা আরও বেশি। আর বেসরকারি গবেষণা সংস্থাগুলোর হিসাবে খেলাপির পরিমাণ চার লাখ কোটি টাকা ছাড়াবে।

শুধু খেলাপিই নয়, গত দেড় দশকের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে বড় ধরনের ২৪টি কেলেঙ্কারি হয়েছে, যার মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে ৯২ হাজার কোটি টাকা লোপাট হওয়ার তথ্য দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, সিপিডি।

সবচেয়ে বড় ধরনের কয়েকটি অনিয়মের ঘটনায় গত সরকারের বিভিন্ন সময়েই ঘুরে ফিরে এসেছে রাষ্ট্রয়ত্ত সোনালী, জনতা, বেসিক, অগ্রণী, রূপালী ও বেসরকারি ইসলামী, স্ট্যান্ডার্ড, ফারমার্সসহ (বর্তমান পদ্মা) কয়েকটি ব্যাংকের নাম।

ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে ইসলামী ব্যাংকে ২০২২ সালে। এক সঙ্গে এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটি থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা অনিয়ম করে নিয়ে নেয় বলে খবরে এসেছে।

আর ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম করেন তৎকালীন চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু।

এই সময়ে সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে চলে যায় চার হাজার কোটি টাকা।

তখন ‘চার হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম’ কিছুই না মন্তব্য করে আলোচিত হয়েছিল তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত।

অন্যদিকে ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা বের হয় রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকে। সামনে আসে ক্রিসেন্ট ও অ্যাননটেক্স গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সময়ে জনতা ব্যাংক থেকে ৮১৬ কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির জন্ম দেয় থার্মেক্স গ্রুপ।

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক) ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের আর্থিক খাতে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের বিষয়টি ধরা পড়ে ২০২১ সালে।

এ ছাড়া ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) ৫০০ কোটি টাকা, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে শহিদুল আহসানের ৭০১ কোটি টাকা, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালে এবি ব্যাংকে ৪০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের ঘটনাগুলো দেশের ব্যাংক খাতে বড় ঘটনাগুলোর নজির তৈরি করে।

আলোচনার শীর্ষে ইসলামী ব্যাংক

কাগজে কলমে রুগ্ন না হলেও অনিয়মের কারণে দুর্বল হয়ে পড়া দেশের প্রথম শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকের ‘স্বাস্থ্যদ্ধারে’ এরই মধ্যে উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যার ধারাবাহিকতায় এটিসহ এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের ঋণ বিতরণ সীমা ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

মঙ্গলবার নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, শরিয়াহভিত্তিকসহ কোনো দুর্বল ব্যাংককেই টেনে তুলতে আর বেআইনিভাবে তারল্য সহায়তা দেওয়া হবে না।

ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকেও (ইউসিবি) বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা ব্যাংকেও বিক্ষোভ হয়েছে।

ব্যাংক খাত সংস্কারের আলোচনার মধ্যেই ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিতে গভর্নর বরাবর আবেদন করেছেন ব্যাংকটির কিছু গ্রাহক।

আবেদনে বলা হয়েছে, “ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি দেশের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক ব্যাংক। আড়াই কোটি গ্রাহকের এ ব্যাংকের বোর্ড অব ডাইরেক্টরস ও কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার কূটকৌশলে ব্যাংকের তহবিল পাচার এবং লুটপাটের ভয়ংকর চিত্র বিভিন্ন সময় অসংখ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, লুটপাটের বাস্তব চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশিত অবস্থার চেয়েও ভয়াবহ। ব্যাংকের বর্তমান দুর্নীতিগ্রস্ত পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেওয়া জরুরি।”

অন্যদিকে অস্থির পরিবেশে শেয়ার বিক্রি করে টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে সব ধরনের শেয়ার কেনাবেচার উপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেছে আরেকটি দল।

ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার ও আবেদনকারী তোফাজ্জল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা জানতে পেরেছি, নামে বেনামে অনেক শেয়ার কিনেছে এস আলম গ্রুপ। এসব প্রতিষ্ঠানের দখলে ইসলামী ব্যাংকের ৮২ শতাংশ শেয়ার চলে গেছে। এখন সেই শেয়ার পছন্দমত লোকজনের কাছে বিক্রি করে ব্যাংকে প্রভাব রাখতে চায়।’’

বিএসইসিতে জমা পড়া আবেদনের সঙ্গে দেওয়া তালিকায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের শেয়ার কিনেছে এমন ২৪ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির তথ্য রয়েছে, যার মধ্যে ১৩ ব্যক্তি ও ১১ প্রতিষ্ঠান। এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে গত ১১ অগাস্ট পর্যন্ত ব্যাংকটির ১৩১ কোটি ৮৯ লাখ ১২ হাজারের বেশি শেয়ার রয়েছে।

এ পরিমাণ শেয়ার ইসলামী ব্যাংকের মোট শেয়ারের ৮১ দশমিক ৯২ শতাংশ। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটির মোট শেয়ারের সংখ্যা ১৬০ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার ৬৬৮টি।

ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিক্ষোভে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গত ১১ অগাস্ট এক পক্ষ গুলি ছুড়লে ১০ জন আহত হয়। ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিক্ষোভে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গত ১১ অগাস্ট এক পক্ষ গুলি ছুড়লে ১০ জন আহত হয়।

সেদিনই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। সবশেষ সোমবার ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের মধ্যে থেকে আট কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়, যারা এস আলম গ্রুপের পক্ষে ব্যাংকে কাজ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিশেষ ক্ষমতা ও পিসিএ নীতি প্রয়োগের পরামর্শ

সমস্যা জর্জরিত ও দুর্বল ব্যাংকের সংকট কাটিয়ে তোলার পদক্ষেপ নিতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বিশেষ পরিকল্পনা নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ)’ কাঠামোর আওতায় ব্যাংকের সমস্যার ধরন চারটি শ্রেণিতে ভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়। সমস্যা ধরার পড়ে ব্যাংক ভেদে সমাধান দিতে ‘ডিরেক্টিভস অব বাংলাদেশ ব্যাংক-ডিওবিবি বা ডব ইস্যু করার কথা জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে সেই পিসিএ বাস্তবায়ন করার কথা বলছেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পিসিএ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে একটি সহায়ক নীতি হিসেবে কাজ করবে। ইসলামী ব্যাংকটি সবচেয়ে বেশি কু-শাসিতভাবে পরিচালনা করা হয়েছে আগের পর্ষদকে বের করে দেয়ার পরে। যে গ্রুপটির নাম সবখানে আলোচিত হচ্ছে তারা একে একে ছয়টি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একইভাবে পরিচালনা করায় ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি পুরো ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এদের কুর্কীতি এখন সবাই জানে।”

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে যাওয়ায় এখন অনেক কিছুই করা সম্ভব বলে মন্তব্য করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “সংস্কারের শুরুটা করতে হবে ব্যাংক খাতের রক্তক্ষরণ বন্ধ করার মাধ্যমে। এজন্য প্রথমেই তারল্য ব্যবস্থাপনায় পদক্ষেপ নিতে হবে।”

ইসলামী ব্যাংকে অনিয়মের ঘটনাগুলো দেশের ব্যাংকিং খাতে একটি উদাহরণ তৈরি করেছে মন্তব্য করেছেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আর্থিক স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে এক সময়ের ভালো একটি ব্যাংক সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে চলে গেছে মালিকানা বদলের পরে। সুশাসনের অভাব ও দুর্নীতির কারণে এমনটি হয়েছে।”

গণমাধ্যমে যেসব ঋণ কেলেঙ্কোরির ঘটনা এসেছে বাস্তবে ব্যাংকটিতে তার চেয়ে ভয়াবহ অনিয়ম হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এসব অনিয়ম যাচাই করতে স্বাধীন ও দক্ষ নিরীক্ষক দিয়ে পূর্ণাঙ্গ নীরিক্ষা করার পরামর্শ তার।

“ব্যাংকটির সমস্যা জেনে প্রয়োজনে সম্পদ বিক্রি করে হলেও আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া নিশ্চতের মত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।”

ইসলামী ব্যাংক দখল হওয়া, পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এর আর্থিক স্বাস্থ্য খারাপের দিকে যাওয়া ও ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার সময়কালে গত ১৫ বছরে দুই জন অর্থমন্ত্রী সরকারে ছিলেন। একজন আবুল মাল আব্দুল মুহিত ও আরেক জন আ হ ম মুস্তফা কামাল।

এই সময়ে গভর্নর ছিলেন আতিউর রহমান ও ফজলে কবির। তাদের পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করা সচিবদের দায়ও দেখছেন ব্যাংকাররা।

ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, “‘ইসলামী ব্যাংক আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংকের একটি। ব্যাংকটিতে সুশাসন নেমে যাওয়া, অদক্ষ লোক নিয়োগ দেওয়া ও ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় সবাই নিরব ছিল। কোনো পক্ষই দুষ্কৃতিকারীদের থামতে বলেনি, এমনকি রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রী ও আমলারা কথা বলেননি। তারা কথা বললে, ব্যাংকটির এমন দুরাবস্থা হত না।”

পুনরাবৃত্তি রোধে আইনের চর্চা

ব্যাংক খাতের সংস্কারে স্বল্প মেয়াদী উদ্যোগের পাশাপাশি প্রস্তাবিত ‘ব্যাংকিং কমিশন’ থেকে দীর্ঘমেয়াদী কৌশল পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

তিনি বলেন, “এজন্য সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহযোগিতা দিতে হবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। অর্থঋণ আদালতে চলমান মামলাগুলো যেন দ্রুত নিস্পত্তি হয়, সেজন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।”

খেলাপি হওয়া প্রতিষ্ঠান বন্ধ না করে তার মালিকানার অংশ শেয়ার হিসেবে ব্যাংকের নামে স্থানান্তর করার পরামর্শ দিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, “সুবিধামতো সময়ে শেয়ার বিক্রি করে ব্যাংক বেরিয়ে আসতে পারবে। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা একটি স্বচ্ছ সমাধান হতে পারে। খেলাপিরা যাতে সম্পত্তি বিক্রি করতে না পারে, তা আটকাতে দ্রুত সরকারি সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হবে।”

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, যেকোনো অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার, চুরি, কেলেঙ্কারির ঘটনার বিচার করতে প্রচলিত অনেক আইন আছে। দোষীদের ধরে আইনের আওতায় এনে বিচার করা সম্ভব।

তিনি বলেছেন, “আইন অনুযায়ী শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। দ্রুত ইচ্ছেকৃত খেলাপিদেরকে শনাক্ত করে তাদের ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংক হিসাব বন্ধ করতে হবে। দুদককে সক্রিয় করতে হবে তাদের বিরুদ্ধে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে সময় লাগলেও তার প্রক্রিয়া সচল করতে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাকে নির্দেশনা দিতে হবে।”

বড় বড় কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলে ব্যাংক খাতের জন্য ভবিষ্যত দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলেও মনে করেন ফাহমিদা খাতুন।

ইসলামী ব্যাংকে মালিকানা বদলের পূর্বাপর

১৯৮৩ সালে শরীয়াভিত্তিক দেশের প্রথম ব্যাংক হিসেবে অনুমোদন পেয়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড আইবিবিএল (পরবর্তীতে পিএলসি) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ১৯৮৫ সালে।

প্রতিষ্ঠাকালীন দেশের সবচেয়ে বড় এই ব্যাংকের ৭০ শতাংশ পুঁজি যোগানে ছিল বিদেশি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, যাদের মধ্যে এখন আছেন মাত্র একজন।

বাকি অর্থ দিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার এবং কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের মালিকানায় বদলের দাবিও ওঠে।

২০১৪ সালের নির্বাচনের পরে তা আরও জোরালো হলে শুরু হয় ব্যাংকের মালিকানা বদলর আয়োজন। এর পেছনে সরকারের সমর্থন দেখতে পেয়ে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তা বাহরাইন ইসলামিক ব্যাংক তাদের হাতে থাকা পুরো শেয়ার বিক্রি করে চলে যায়। ২০১৫ সালে আরেক উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান দুবাই ইসলামিক ব্যাংকও সব শেয়ার বিক্রি করে দেয়।

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে আরমাডা স্পিনিং মিলস নামের একটি প্রতিষ্ঠান ব্যাংকটির শেয়ার কেনে এবং সাবেক সচিব আরাস্তু খানকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়। শেয়ারের মূল মালিক চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের হয়ে সাবেক আমলা আরাস্তু খান যোগ দেওয়ার মাধ্যমে ব্যাংক ’দখলের’ প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকতা পায়।

আরমাডা স্পিনিং মিলের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে কোম্পানির মালিকানা ও কাজের ধরণ সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেননি আরাস্তু খান।

এরপরই ব্যাংকটি ছাড়তে শুরু করেন বিদেশিরা। ২০১৬ সালে দেশীয় ইউনাইটেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠান হজরত শাহজালাল (রহ.) ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি লিমিটেড ব্যাংকটির ৩ কোটি ২৫ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৫টি শেয়ার কেনে। সেই বছরে অনুষ্ঠিত ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) তাদের পক্ষে পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়।

এরপর গ্র্যান্ড বিজনেস নামের চট্টগ্রামভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান শেয়ার কিনে ব্যাংকটিতে প্রবেশ করে। মূলত এটাই ছিল ব্যাংকটির মালিকানা বদলের শুরু। ওই বছরই বিভিন্ন খাতের আরও আটজনকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, যারা ব্যাংকটি পরিচালনায় মূল ভূমিকা রাখতে শুরু করেন।

২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ব্যাংকটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় হঠাৎ পরিবর্তন ঘটে। একই বছরের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে উদ্বেগ জানিয়ে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) প্রেসিডেন্ট বন্দর এম এইচ হাজ্জার লিখেছিলেন, আইডিবিসহ সৌদি আরব, কুয়েতের উদ্যোক্তাদের ৫২ শতাংশ শেয়ার থাকার পরও ব্যাংকটির সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে।

ওই বছর ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হন আরাস্তু খান। এভাবে গত আট বছরে এটিসহ ছয়টি ব্যাংকের পুরো নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম গ্রুপ।

বড় এই পরিবর্তনের পর ইসলামী ব্যাংকের ৮ কোটি ৬৯ লাখ শেয়ার বিক্রি করে দেয় উদ্যোক্তা পরিচালক আইডিবি।

‘জোরজবরদস্তি’ করে এ ব্যাংকে আধিপত্য নেওয়ার ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি। ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে জোর করে পদত্যাগ করানোর খবর আসে। রীতি ভেঙে একটি হোটেলে সভায় বসে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। পদত্যাগ করা পরিচালকদের স্থলাভিষিক্ত কারা হবেন, সেটিও নির্ধারণ করা হয়। তারপর ধীরে ধীরে নামে-বেনামে ৩০ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনে নেয় এস আলম।

ব্যাংকটির মালিকানা স্থানান্তরের সময়ে মোট ঋণ স্থিতি ছিল ৬১ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। আর আমানত ছিল ৬৮ হাজার ১৩৫ কোটি টাকার। এক সময়ে খেলাপির হার ৩ শতাংশের নিচে থাকলেও এখন ৫ শতাংশ।

২০১৬ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির থেকে এস আলম গ্রুপের নেওয়া ঋণ স্থিতি ছিল মাত্র তিন হাজার ছয় কোটি টাকা। সময়ের ব্যবধানে আট বছর পরে এস আলম ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ঋণ স্থিতি ৭৫ হাজার কোটি টাকার বেশি হওয়ার খবর এসেছে একাধিক সংবাদমাধ্যমে।

গত জুলাই শেষে ব্যাংকটির ৩৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ শেয়ার উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ৪৩ দশমিক ২২ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ শেয়ার।

এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার আগে বিদেশিদের শেয়ার ছিল ৫২ শতাংশের মত, যা এখন ১২ দশমিক ৯৬ শতাংশ শতাংশে নেমে এসেছে।

ধীরে ধীরে শেয়ার ছেড়ে দিয়েছে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি), দুবাই ইসলামী ব্যাংক, আল-রাজি গ্রুপ, কুয়েতের সরকারি ব্যাংক কুয়েত ফাইন্যান্স হাউস, সৌদি কোম্পানি আরবসাস ট্রাভেল অ্যান্ড টুরিস্ট এজেন্সিসহ বেশির ভাগ উদ্যোক্তা ও সাধারণ শেয়ারধারী প্রতিষ্ঠান।

জামায়াত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ইবনে সিনা, ইসলামিক সেন্টারও ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ছেড়ে দেয়।

শেয়ারহোল্ডাররা অভিযোগ করেছেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে থাকা শেয়ারের মালিকানা পরোক্ষভাবে এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করছে।

মালিকানা বেদখল হয়ে যাওয়ার পর বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ব্যাংকটির আর্থিক সূচকগুলোতে অবনতি হয়। একদিকে ব্যাংকটিতে আমানত আসা কমে গেছে, পাশাপাশি কমেছে আয়ও। অন্যদিকে বেড়ে গেছে ঋণ বিতরণ ও খেলাপি ঋণ।

নগদ অর্থের সংকট তৈরি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ ব্যবস্থায় টাকা ছাপিয়ে তারল্য সুবিধা দিয়েছে গত দুই গভর্নরের আমলে। সেই টাকাও গিয়েছে এস আলমের পেটে।

সম্প্রতি জানা গেছে, শুধু ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখাতেই এস আলম গ্রুপের ১২টি কোম্পানির ফান্ডেড ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর বাইরে নন ফান্ডেড ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকের অন্যান্য শাখায় আরও কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণ রয়েছে এস আলম গ্রুপের।