Originally posted in বণিক বার্তা on 28 October 2022
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো। এছাড়া তিনি জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) সদস্য। কাজ করছেন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্ম, বাংলাদেশের আহ্বায়ক হিসেবে। সম্প্রতি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, উন্নয়ন দর্শন, রাজনৈতিক সংকট ও আর্থিক ঘাটতি নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কেমন দেখছেন?
গত দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি কম-বেশি প্রবৃদ্ধির মধ্যে ছিল। এ সময়ে একটা অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ ঘটেছে। যদিও তা মূলত হয়েছে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ও উদ্যোগের ফলে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ, দেশীয় ও বিদেশী অর্থনীতির আয়তনের তুলনায় বাড়েনি। কর আহরণ উদ্বেগজনক কম হয়েছে এবং ভৌত অবকাঠামোয়, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের বিপরীতে বরাদ্দ বেশি দেয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে।
বর্তমানে আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি, একই সঙ্গে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। দু-একটি সূচক বাদ দিলে এমডিজি অর্জিত হয়েছে, অতিমারীর আগ পর্যন্ত এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দিকেও এগিয়েছি। তবে বর্তমান সময়কালে উন্নয়নের যে চরিত্র তার কিছু দ্বন্দ্ব, বিশেষ করে অন্তর্নিহিত ও আর্থ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এ অর্জনগুলোকে কিছুটা হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
দেখুন, আমরা যখন বাংলাদেশের ৫০ বছর উদযাপন করি তখন বিভিন্ন অর্জনগুলোর সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি বিষয়ে অনেকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আমি সেগুলো স্মরণ করতে চাই, যেহেতু বর্তমান আলোচনার ক্ষেত্রে এগুলো প্রাসঙ্গিক হবে। প্রথমত, বাংলাদেশ বিগত ৫০ বছরে আরো বেশি বৈষম্যমূলক সমাজে পরিণত হয়েছে। শুধু আয় কিংবা সম্পদ নয়, ভোগ ও সামাজিক সুযোগের ক্ষেত্রেও বৈষম্য প্রতিফলিত হচ্ছে, যা আমাদের যুবসমাজকে মূলধারা থেকে অনেক বেশি বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে ধরনের বিনিয়োগ, সেবা ও সুবিধা বণ্টন করা হয়েছে, তা সবার কাছে পৌঁছেনি। লক্ষ্যনির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য শুধু বরাদ্দ কম ছিল তা-ই নয়, ভাতা বিতরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম দেখা দিয়েছে। তাই জাতীয় উন্নয়নের সুবিধা গরিব মানুষ বা অসুবিধাগ্রস্ত সম্প্রদায় কম পেয়েছে। তাদের মধ্যে আবার রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে যোগাযোগবিহীন দরিদ্ররা পেয়েছে আরো কম। তৃতীয়ত, উল্লেখিত দুটি ঘটনা ঘটার একটা বড় কারণ হলো, আর্থসামাজিক উন্নতির ধারাবাহিকতাকে সচল রাখতে হলে যে ধরনের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক জবাবদিহির প্রয়োজন, সেটার ক্ষেত্রে এ সময়কালে বাংলাদেশে বড় ধরনের ঘাটতি ছিল। আমাদের অর্থনীতি বিকাশমান ও সম্প্রসারণশীল; কিন্তু একই সঙ্গে তা ক্রমবর্ধমানভাবে অন্যায্য ও বৈষম্যমূলক।
এটা কি আমাদের উন্নয়নের দর্শনগত সমস্যা?
গত ১০ বছরে চেষ্টা করা হয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন দর্শনে জবাবদিহির অভাবকে তাত্ত্বিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার। শাসক শ্রেণী ও তার সমর্থকরা বলতে চেয়েছেন, উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে জবাবদিহি নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ উন্নয়ন ও জবাবদিহি একসঙ্গে যায় না। এজন্য অনেকে প্রথমে মালয়েশিয়ার উদাহরণ দেন, এরপর তামাদি হয়ে যাওয়া দক্ষিণ কোরিয়ার পার্ক চুং-হিয়ের মডেলের উদাহরণ দেন। কেউ কেউ আবার চীনের কথাও উদাহরণ হিসেবে আনেন। তারা বলেন, উন্নয়ন আগে গণতন্ত্র পরে, আর আমি বলি এটা মূলত তাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের অপরিপক্ব ধারণা। কেন আমি এটা বলছি, কারণ ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচি তৈরি করা হলো, অর্থাৎ দ্য নিউ ডেভেলপমেন্ট কনন্সেন্সাস বা উন্নয়ন দর্শনের নবতম সমঝোতা, যেখানে বলা আছে, উন্নয়নের ধারায় কাউকে পিছিয়ে রাখা যাবে না। সবচেয়ে পেছনে পড়ে থাকা মানুষের অবস্থাই হবে উন্নয়নের মাপকাঠি, গড় পরিস্থিতি দিয়ে হবে না। এ অবস্থানই এসডিজি নামে পরিচিত। অথচ বাংলাদেশ কিন্তু গড়ের ওপর জোর দিয়েছে; উন্নয়নের সুফলের বিতরণ বিভাজিতভাবে দেখেনি।
দ্বিতীয়ত, নতুন বৈশ্বিক সমঝোতা বলছে, উন্নয়ন কোনোভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও মানবাধিকারকে বঞ্চিত করে করা যাবে না। উন্নয়ন মানে শুধু আর্থিক বা বস্তুগত উন্নয়ন নয়, মানুষ হিসেবে নাগরিকের যে অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য অধিকারগুলো রয়েছে সেগুলোকে কার্যকর করাই উন্নয়ন। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বৈশ্বিক নেতারা এ অঙ্গীকারে স্বাক্ষর করেছেন। আমাদের সরকারও করেছে, অথচ তারা এখন কার্যত বিপরীতে অবস্থান নিচ্ছে। সুবিধাভোগীরা সমস্যাগুলোকে যৌক্তিক বা রাজনৈতিকভাবে ব্যাখ্যা না করতে পেরে তামাদি চিন্তার আশ্রয় নিচ্ছেন।
আমার সরল কথা হচ্ছে, বাংলাদেশকে উন্নয়নের পরবর্তী পর্যায়ে যেতে হলে এ তিনটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে অর্থাৎ অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন হতে হবে। এ জায়গাটাকে বিভাজিতভাবে দেখতে হবে ও গড়ের হিসাব থেকে বের হতে হবে। মানবিক ও নাগরিক অধিকার, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন এগুলো যদি আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে না পারি তাহলে গত এক দশকের অর্জনগুলো হুমকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে, যার কিছু ইঙ্গিত এরই মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে।
সাধারণত দুটি কারণে চ্যালেঞ্জগুলো তৈরি হয়, রাজনৈতিক সংকট থেকে অর্থনৈতিক সংকট কিংবা অর্থনৈতিক সংকট থেকে রাজনৈতিক সংকট। বাংলাদেশে হঠাৎ করে এ বিষয়টি কেন হলো?
আমি তৃতীয় যে বিষয়টির কথা বলেছিলাম, অর্থাৎ জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার অভাব, এটা তার সঙ্গে যুক্ত। অনেক দেশে, বিশেষ করে শ্রীলংকার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে অর্থনৈতিক সুশাসনের অভাব রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করছে। কারণ উন্নয়নের ধারায় যারা খানিকটা কম পেল, বিশেষ করে বিকাশমান মধ্যবিত্ত, তারা এটাকে মেনে নিতে পারে না। এশিয়া বা আফ্রিকা, বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকার বহু দেশের অভিজ্ঞতা এখানে বিবেচনা করতে হবে। পরিবর্তনের ধারায় বিকাশমান মধ্যবিত্তের জন্য এই যে আর্থসামাজিক অব্যবস্থাপনা, মানসম্মত শিক্ষার অভাব, স্বাস্থ্য ও সেবার ক্ষেত্রে ঘাটতি, গণপরিবহনের অভাব, নাগরিক সুরক্ষা বা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অভাব, এগুলো তাদের জন্য অগ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। অর্থনৈতিক অর্জন আছে কিন্তু সুশাসন নেই, এ ফাঁকটা বুঝতে হবে।
অনেকে সুশাসনের অভাবকে অনেক সময় অর্জনের অভাবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে, আসলে তা কিন্তু না। সুশাসনবিহীন অর্জন সুষ্ঠু বণ্টনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অসুবিধা সৃষ্টি করে। বর্তমানে অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী। তারা দেখে তাদের যে পরিমাণ টাকা আছে তা দিয়ে দেশের ভেতরে মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারছে কিনা। যখন তাদের বিলাত বা সিঙ্গাপুরে গিয়ে শিক্ষা-স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণের সামর্থ্য থাকে না, আবার দেশের ভেতরেও তারা এটা পায় না, তখন তারা অসন্তোষ প্রকাশ করে, বিদ্রোহ করে। অর্থাৎ প্রত্যাশা অনুযায়ী কোনো একটা শ্রেণী যখন নিজেদের প্রাপ্যটা পায় না, তখন এ আর্থসামাজিক অসন্তোষ রাজনৈতিক চরিত্র নেয়।
আমরা যদি লাতিন আমেরিকার দিকে তাকাই, তাহলে দেখব যে অনেক মধ্যম আয়ের দেশ ৫০ বছরেও উচ্চ-মধ্যম আয়ের দিকে যেতে পারছে না। এখন তারা বামপন্থী সরকার আনছে চিলির মতো দেশে। দক্ষিণ আফ্রিকায়ও এএনসির মতো দল সুশাসন দিতে পারছে না। এএনসি গরিব মানুষের পক্ষের দল। সে অর্থে মানুষগুলোর প্রান্তিকীকরণ হচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে এএনসি প্রভাব হারিয়ে ফেলছে। আবার সুদানে মধ্যবিত্তের প্রত্যাশা পূরণ করার ক্ষেত্রে প্রথাগত রাজনীতি ব্যর্থ হয়েছে। একই রকমভাবে আমরা যদি আমাদের আশপাশের দেশের দিকে তাকাই, যেমন থাইল্যান্ড। তরুণরা প্রথাগত রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। যখন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন তাদের ঐতিহাসিক ও প্রতিশ্রুত মূল্যবোধগুলোকে কার্যকরভাবে ধারণ করতে পারে না, তখন দেখা যায় বিকাশমান মধ্যবিত্ত সংযোগবিহীন ও নেতৃত্বহীনভাবে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক আন্দোলনে অংশ নেয়। সব সময় যে তারা রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয় তা নয়, তবে সমাজকে একটা ঝাঁকি দেয়।
বাংলাদেশে যেমন নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে অসংগঠিত বিকাশমান মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা। তারা কিন্তু হতদরিদ্রের ছেলেমেয়ে না। ডিজিটাল যুগের বৈশ্বিক জ্ঞানভাণ্ডারের সঙ্গে তারা যুক্ত। তারা জানে অন্যভাবেও সমাজ পরিচালনা সম্ভব। তাদের কাছে বিকল্পগুলো আছে। কিন্তু তাদের প্রতিবন্ধকতা হলো, তারা অসংগঠিত সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে থাকে, একক নেতৃত্বের মধ্যে থাকে না। সেজন্য অনেক সময় আন্দোলনটা কার্যকর হয় না।
উন্নয়নে মধ্যবিত্ত কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
আপনি যদি উন্নয়নের পরবর্তী ধাপের কথা চিন্তা করেন, তাহলে গত এক দশকে যে বিকাশমান মধ্যবিত্ত গড়ে উঠেছে তারাই বাংলাদেশে আগামী দিনে আর্থসামাজিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে বলে আমার ধারণা। তবে ড্রাইভিং ফোর্স এবং ডিফাইনিং ফোর্স বা নিয়ামক শক্তি, এ দুটির মধ্যে তফাৎ আছে। আমি মধ্যবিত্তকে চালিকাশক্তি হিসেবে দেখি, নিয়ামক শক্তির ব্যাপারে নিশ্চিত নই। যখন তাদের মধ্যে এক ধরনের আক্ষেপ জন্ম নেয় যে ‘আমার তো কণ্ঠস্বর নেই, আমি কাউকে প্রশ্ন করতে পারি না, প্রশাসন আমাকে অবজ্ঞা করে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে আমি পৌঁছাতে পারি না’ তখন সে হতাশাবোধ ও আত্মপীড়নকে যদি সংগঠিতভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে রাস্তা করে না দেয়া হয়, তাহলে পৃথিবীর অভিজ্ঞতা বলে তখন তারা বিশেষ করে যুবসমাজ উগ্রবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। লাতিন আমেরিকায় শাইনিং পাথ বা উগ্র বাম আন্দোলন যেমন। সত্তরের দশকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের লাতিন আমেরিকা যে জায়গায় ছিল আজ বাংলাদেশ সেখানে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক জায়গায় এখনো এ রূপ অবস্থা দেখি। খুব ঘরের কাছে আপনি ভারতবর্ষের আদিবাসীদের আন্দোলনের মধ্যেও এটি দেখতে পাবেন। যখন স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পথগুলো রুদ্ধ হয়ে যায়, জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনসহ, তখন অবধারিতভাবে জনগণ সহিংসতা ও উগ্রবাদের দিকে চলে যায়। আমার আস্থা এবং বিশ্বাস বাংলাদেশের আলোকিত নেতৃত্ব সে পথ থেকে আমাদের বিরত রাখতে সক্ষম হবে।
আমাদের অর্থনীতির সংকটগুলো কেন তৈরি হলো?
বেশকিছু কারণ আছে। একটা হচ্ছে সরকার তথাকথিত দৃশম্যান উন্নয়নের ধারাকে বেছে নিয়েছে। সরকার হয়তো মনে করেছে, শাহজাহান চলে গেছে কিন্তু তাজমহল তো রয়ে গিয়েছে। শাহজাহানের আর কোনো অপকীর্তি বা তার সন্তানদের উত্তরাধিকার লাভের চেষ্টায় সহিংসতার কথা কেউ আর মনে রাখেনি। এ রকম একটা তত্ত্ব বোধহয় মাথায় ঢুকেছে। শাহজাহান তো সাম্রাজ্য চালিয়েছে আর আমরা আছি গণতন্ত্রের যুগে। এ দুই সময়কালের মাঝে ৪০০ বছরের ব্যবধানের ফলে রাষ্ট্রের চরিত্রে ও নাগরিকের প্রত্যাশায় গুণগত ও কাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে।
আমাদের ২০টি মেগা প্রকল্পের ক্ষেত্রে গড়ে বছরে জিডিপির ১ শতাংশ করে ব্যয় করা হয়েছে। ২০টি মেগা প্রকল্পে যে অর্থ দেয়া হয়েছে, শিক্ষা খাতে সেই একই পরিমাণ টাকা দেয়া হয়েছে, আর গোটা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার জন্য দেয়া হয়েছে তার অর্ধেক। এক দশক ধরে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষাকে বঞ্চিত করে মেগা প্রকল্প করা হয়েছে এ প্রত্যাশায় যে এগুলো অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। ঘটনাক্রমে এ প্রকল্পগুলোর অনেকই অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর বা যৌক্তিক নয় বলে এখন প্রকাশ পাচ্ছে। শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বন্দর অপ্রয়োজনীয় দৃশ্যমান উন্নয়নের একটি বড় উদাহরণ। আর বাংলাদেশের মধ্যে এ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কিংবা মাতারবাড়ী প্রকল্প আমাদের জন্য অনুরূপ। আমরা ভয় পাচ্ছি আগামীতে হয়তো রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র আরো একটি অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এসব প্রকল্প থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রত্যাশা সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি মনে করি, গত দশকে মানবসম্পদ খাতের বিপরীতে ভৌত অবকাঠামোকে প্রাধান্য দিয়ে সবচেয়ে বড় ‘সোশ্যাল ট্রেড অফ’ বা সামাজিক ছাড় দেয়া হয়েছে। এর ফল আমাদের পরবর্তী ১০ বছর ধরে ভোগ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, এসব প্রকল্পের অবদানে যদি প্রবৃদ্ধি হয়ে থাকে তাহলে দেশে আয় বেড়েছে। কিন্তু সে আয় থেকে কর আদায় হলো না কেন? কর কেন জিডিপির মাত্র ৯ শতাংশ? আমি তাই বলি, সরকার ‘উচ্চপ্রবৃদ্ধির দরিদ্র সরকার’। কারণ সরকারের হাতে বর্তমানে টাকা-পয়সা নেই। জিডিপির প্রায় ১৫ শতাংশ সরকারি ব্যয়, যার মধ্যে ৯ শতাংশের মতো কর থেকে আসে, বাকি ৫ থেকে ৬ শতাংশ থাকে ঘাটতি। সরকার এ ঘাটতির প্রায় ৪০ শতাংশ বৈদেশিক ঋণ নিয়ে পূরণ করে, যার মাত্র ২ শতাংশ অনুদান। বাকি ৬০ শতাংশ সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়। আগে এ অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রায় পুরোটাই আসত জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে, কিন্তু এখন এর ৪০ শতাংশই আসে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে। কিন্তু এটা তো সরকারকে ফেরত দিতে হয় সুদসহ। রাজস্ব বাজেটের ১৮-২০ শতাংশ সুদ ব্যয়ে চলে যায়। এটা হচ্ছে বর্তমান উন্নয়ন ধারার দ্বিতীয় সমস্যা। সরকার দৃশ্যমান উন্নয়ন থেকে আয় করতে পারেনি। ফলে আজ যখন সরকারের ভর্তুকি দেয়ার প্রয়োজন, তখন সে তা দিতে পারছে না। যেটুকু দিতে পারে, সেগুলোও বিভিন্ন কায়েমি স্বার্থের কাছ জিম্মি।
তৃতীয়ত, এ উন্নয়নে সর্বদা গড়ের দিকে নজর দেয়া হয়েছে। ফলে নীতিকথা বলা হলেও বাস্তবে ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে বিভিন্ন বিপন্ন জনগোষ্ঠীর প্রতি প্রয়োজনীয় নজর দেয়া হয়নি। ফলে এরা ক্রমে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক এবং দুর্বল অবস্থানে পৌঁছেছে। পার্বত্য এলাকার ও সমতলের আদিবাসী, দলিত সম্প্রদায়, নদীভাঙনে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠী, উপকূল অঞ্চলের মানুষ, তৃতীয় লিঙ্গ, শারীরিক প্রতিবন্ধী, প্রবীণ ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অনুকূলে আমরা যথাপ্রয়োজন অর্থ বরাদ্দ ও নীতি সমর্থন দিতে পারিনি। গোষ্ঠী পরিচয়বিবর্জিতভাবে আমরা দুর্বল জনমানুষকে এগিয়ে নিয়ে আসতে পারিনি।
সমাধান আসবে কীভাবে?
প্রচলিত উন্নয়ন ধারার তিনটি সমস্যার কথা শুরুতে বলেছি। এখন আগের তিনটির সঙ্গে এ তিনটি মিলবে। এগুলোর সংশোধন করতে হলে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার জায়গায় ফিরে আসতে হবে। আর জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার উৎসবিন্দু হচ্ছে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচন। একটি অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন বাংলাদেশের উন্নয়ন ধারার জন্য এখন সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুটি কারণে এটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গত এক দশকে যা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এবং উন্নয়নের পরের ধাপে যাওয়ার জন্য এটি প্রয়োজন। পরের ধাপে যাওয়ার জন্য জবাবদিহি আরো বেশি প্রয়োজন। কারণ উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে যেতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অত্যন্ত বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
এলডিসি থাকা অবস্থায় আমাদের বাজার সুবিধা ছিল পণ্যের ভিত্তিতে, অর্থাৎ উৎপাদনে দেশজ উপাদানের ভিত্তিতে। এখন আমাদের পণ্য মানের সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত প্রক্রিয়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ভাষায় বলে পিপিএম (প্রসেস অ্যান্ড প্রডাকশন মেথড)। অর্থাৎ পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শিশু শ্রম ব্যবহার করা হয়েছে কিনা কিংবা শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন আছে কিনা এগুলো বিবেচনা করা হবে। হয়তো এটা আরো এক ধাপ বাড়বে, তা হলো নাগরিকদের সর্বজনীন মানবাধিকার রক্ষা করা হয়েছে কিনা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে কিনা এগুলোও বিবেচনায় নেয়া হবে।
তাই বলব, যারা ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের অপরিপক্ব ধারণা দিয়েছিলেন যে ‘উন্নয়ন আগে, মানবাধিকার পরে’ তারা যে কতখানি অপব্যাখ্যা করেছেন তা আগামীতে প্রকাশ পাবে। সেজন্য খুব দ্রুততার সঙ্গে আমাদের এ বিষয়গুলো সংশোধন করা দরকার। আগামী দেড় বছর পর নির্বাচন হওয়ার কথা। এই গণতান্ত্রিক উত্তরণের সুযোগ নিয়ে উন্নয়ন ধারা সম্পর্কিত বিষয়গুলো সংশোধন করতে হবে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জবাবদিহির প্রক্রিয়ায় যে ঘাটতিটুকু আছে তা পূরণ করে নবতর স্তরে আমরা যেন টেকসইভাবে এগিয়ে যেতে পারি সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
চলমান আর্থিক পরিস্থিতি সামলাতে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি?
আগামী দুই বছরের জন্য একটা উত্তরণকালীন বা অন্তর্বর্তীকালীন পরিকল্পনা প্রয়োজন। বর্তমান অর্থবছরের বাজেট, যেটা মাত্র চার মাস আগে দেয়া হয়েছে, সেটার প্রাক্কলনগুলো অনেক ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০২০-২৫) লক্ষ্যমাত্রা তো কেউ উল্লেখই করে না আজকাল। কারণ আমাদের সামনে যে উন্নয়ন বিচ্যুতি ছিল, চ্যালেঞ্জগুলো ছিল, তা আগের চেয়ে অনেক বেশি তীব্র হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে আমি মনে করি, কিছু জায়গায় অগ্রাধিকার দিয়ে গুরুত্ব দেয়া দরকার। প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। এটা করতে হলে যেখানে যে আর্থিক সম্পদ আছে সব এক করে যৌক্তিকভাবে ভর্তুকি দিতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে ভর্তুকির বিষয়টি সবচেয়ে বড়। ভর্তুকি দেয়ার ক্ষেত্রে দুটি প্রাধিকার হতে হবে। প্রথমত, কৃষি উৎপাদন ও খাদ্যনিরাপত্তা। আমন ধানের মৌসুম চলছে। বিদ্যুৎ, সার ও ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমন উৎপাদন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, উপরন্তু মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টি হয়েছে কম। দ্বিতীয়ত রয়েছে গ্যাস সরবরাহ তথা জ্বালানি প্রাপ্যতা। জ্বালানির লভ্যতা ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে শিল্প উৎপাদন ও রফতানি বিঘ্নিত হচ্ছে। শুল্ক সমন্বয় করে বা অন্য খাত থেকে টাকা নিয়ে এসে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দেয়া যায় না, এমনটা আমি মনে করি না।
সংকট মোকাবেলায় সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ভর্তুকি বাড়িয়েছে, ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ করেছে। এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
ভর্তুকি দুই ধরনের হয়, ‘ভালো ভর্তুকি’ হয় আবার ‘খারাপ ভর্তুকি’ও হয়। এ মুহূর্তে খারাপ ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। যেমন ব্যক্তি খাতের অলস বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ। খারাপ ভর্তুকি বাতিল করে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি প্রয়োগ করে ভালো ভর্তুকি দিতে হবে।
অন্য বিষয়টি হচ্ছে টাকার বিনিময় হার ও সুদের হারকে কিছুটা হলেও বাজারভিত্তিক বা নমনীয় করতে হবে। নয়-ছয় সুদের হারকে শিথিল করে একটা ব্যান্ডের মধ্যে নিতে হবে। আমানতের ওপর ৬ শতাংশ সুদ আর ৯ শতাংশের ওপর মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই ব্যাংকে আমানতকারীদের টাকার প্রকৃত মূল্যের ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। সুদের হার নয়-ছয় করে আমরা ব্যক্তি খাতে তো বিনিয়োগ বাড়াতে পারিনি। সরকার বা উদ্যোক্তারা যে যুক্তি দিয়েছিল, অভিজ্ঞতা বলে তা সঠিক ছিল না।
আমাদের এখন অভ্যন্তরীণ বাজারকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে আমন, আউশ ধান উৎপাদনে জোর দিতে হবে। কৃষককে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিতে হবে। নতুন বাজার অনুসন্ধানের পাশাপাশি বিদেশে গমনরত শ্রমিকদের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। মূল্যস্ফীতির কারণে শ্রমিক-কর্মচারীদের কিছু না কিছু সুরাহা দিতে হবে। চা বাগানের শ্রমিকরা আন্দোলনে চলে এসেছে, কোনোদিন হয়তো গার্মেন্ট শ্রমিকরা আন্দোলনে নামবে। রফতানিকারী সম্প্রদায়কে মনে রাখতে হবে, টাকার বিনিময় হারের কারণে যে লাভটা তারা বাড়তি পেলেন, তার কিছু অংশ শ্রমিকদের দিতে হবে। শ্রমিকদের দেখতে হবে। কৃষকদের দেখবে হবে। প্রবাসীকর্মীদের দেখতে হবে। এ তিন অংশীজনদের যদি আমরা নজরে রাখতে পারি তাহলে কর্মসংস্থানের উন্নতি হবে।
সর্বশেষে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া গরিব তথা দুস্থ মানুষকে সুরক্ষা দিতে হবে। টিসিবিকে সম্প্রসারণ করতে হবে, জেলা তথা পৌরসভা পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে যে ফ্যামিলি কার্ডের কথা বলা হচ্ছে, সেটা যেন দ্রুত স্বচ্ছতার সঙ্গে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়। এখানে যেন আগের মতো দুর্নীতি ও বিচ্যুতি না হয়। সব ধরনের ভাতাকে সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা করা যায় কিনা এটা চিন্তা করতে হবে। ৫০০ টাকা ভাতা তো মাথাপিছু জাতীয় আয়ের ২-৩ শতাংশ—এটা তো তাদের সঙ্গে পরিহাসের ব্যাপার। এছাড়া শিক্ষিত ও বেকার যুবকদের এককালীন আর্থিক সমর্থন দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। না হলে এগুলো পরবর্তী সময়ে সামাজিক অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে। সময় থাকতে আমি এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষে।
আমাদের সরকারের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আগে অস্বীকারের মনোভাব থাকে, পরে তারা ঠেকে শেখে। বুদ্ধিমানদের তো ঠেকে শিখতে হয় না, তারা পরিস্থিতির আগাম পর্যালোচনা করে ও অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে শেখে। আমি এটাই প্রত্যাশা করব যে আমাদের নেতৃত্ব ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতার সঙ্গে এই উত্তরণকালীন নীতি সংস্কারকে ধারণ করতে পারবেন।