Originally posted in The Daily Star on 14 February 2023
সরকার-ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে ‘সমন্বয়’ করছে, জনগণ ‘সমন্বয়’ করবে কীভাবে
করোনা মহামারি, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন, ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমতে থাকায় পণ্য আমদানিতে খরচ বৃদ্ধিসহ নানা কারণে বেড়ে যাওয়া খরচ ব্যবসায়ীরা ‘সমন্বয়’ করছেন পণ্যের দাম বাড়িয়ে।
করোনা মহামারি, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন, ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমতে থাকায় পণ্য আমদানিতে খরচ বৃদ্ধিসহ নানা কারণে বেড়ে যাওয়া খরচ ব্যবসায়ীরা ‘সমন্বয়’ করছেন পণ্যের দাম বাড়িয়ে।
একই কারণে তেল-গ্যাসসহ জ্বালানির দাম ‘সমন্বয়’ করেছে সরকার। আবার তেল-গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় এর মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুতের দামও ‘সমন্বয়’ করেছে সরকার।
জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়াকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে আবারও ‘সমন্বয়’ করেছে পণ্যের দাম। এই প্রক্রিয়া চলছে চক্রাকারে।
সরকার হোক আর ব্যবসায়ী, সবক্ষেত্রেই ‘সমন্বয়’ বলতে দাম কেবলই বেড়েছে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা কাউসার সাজ্জাদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সবকিছুর দাম বাড়ে, কিন্তু সেই হারে আমাদের বেতন বাড়ে না।’
এ বছর বেতন ২ হাজার টাকা বেড়ে ২৫ হাজার টাকা হয়েছে জানিয়ে কাউসার সাজ্জাদ জানান, তিনি প্রতি মাসে ইউটিলিটি বিলসহ সাড়ে ১৩ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দেন। যাতায়াত, মোবাইল বিলসহ আনুসাঙ্গিক বাবদ খরচ হয়ে যায় আরও অন্তত সাড়ে ৩ হাজার টাকা। বাকি ৮ হাজার টাকায় চলে বাবা-মা, স্ত্রীসহ তাদের ৪ জনের সংসারের বাকি সব খরচ।
তিনি বলেন, ‘সরকারের কথা বলেন, আর ব্যবসায়ীদের কথা বলেন, সবাই সমন্বয় করছে, দাম বাড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা আগে যা আয় করতাম, এখনো তো প্রায় একই আয় করছি। তাহলে আমরা সমন্বয় করব কীভাবে? যে বেতন পাই তা দিয়ে আগেই যেখানে সংসার চালাতে কষ্ট হতো, এখন কীভাবে টিকে থাকব?’
একই কথা জানান মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মো. তালহাও। তিনি বলেন, ‘বাড়তি খরচ সমন্বয় করতে দৈনন্দিন খরচের তালিকা কাটছাঁট করতে করতে এমন জায়গায় এসে গেছে, এর চেয়ে আর কমানোর কোনো সুযোগ নেই। অন্তত ডাল-ভাত খেয়ে তো বাঁচতে হবে। তারপরও হিসাব মেলাতে পারি না। প্রতি মাসেই ধার-দেনা করতে হয়। এসব টাকা কবে-কীভাবে ফেরত দেবো জানি না।’
সরকারি চাকরিজীবী মো. তৈমুর রহমান দিনাজপুরে থাকেন। চতুর্থ শ্রেণির এই কর্মচারীর বেতন এ বছর ৫ শতাংশ বৃদ্ধির পর সাকুল্যে হয়েছে ১৫ হাজার ৭৭০ টাকা। বাড়ি থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অফিসে তাকে যাতায়াত করতে হয় মোটরসাইকেল নিয়ে। কর্মদিবসে জ্বালানি তেলসহ তার খরচ অন্তত ৩০০ টাকা। বাবা-মা, ভাই, স্ত্রী ও ২ সন্তান তার ওপর নির্ভরশীল।
তৈমুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম গত ১ বছরে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। অথচ বেতন বেড়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। আমরা যারা নিম্ন আয়ের মানুষ, তারা কোনোমতে খেয়ে বেঁচে আছি। প্রতি মাসেই কয়েক হাজার টাকা ধার করতে হচ্ছে।’
গত বছরের আগস্টে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, অকটেনের দাম ৮৯ থেকে ১৩৫ টাকা, পেট্রলের দাম ৮৬ থেকে ১৩০ টাকা করার ঘোষণা আসে। যদিও, পরবর্তীতে এসব জ্বালানির দাম লিটারে ৫ টাকা করে কমানো হয়।
এরপর থেকেই তড়িৎ গতিতে বেড়ে যায় সবকিছুর দাম।
চাল, ডাল, আটা, তেল, চিনি, সবজি থেকে শুরু করে সব ধরনের খাদ্যসামগ্রীর দাম বেড়েছে। বাদ যায়নি টয়লেট্রিজ সামগ্রী ও ঘর পরিষ্কার রাখার উপকরণও। প্রায় সব ধরনের সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট, ডিটারজেন্ট ও টয়লেট ক্লিনারের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
সাভারের বাসিন্দা খালেদা ইয়াসমিন বলেন, ‘গত বছরের জুনেও ১ কেজির যে ডিটারজেন্ট পাউডার ১০০ টাকায় কিনেছি, এখন সেটার দাম ১৪৫ টাকা। সুগন্ধি সাবান কিনতাম ৫৫ টাকায়, সেটার দাম এখন ৮০ টাকা।’
আকারভেদে প্রতি কেজি রুই মাছের দাম ২৮০-৪৫০ টাকা, পাঙ্গাস ১৮০-২৫০ টাকা, তেলাপিয়া ১৮০-২৫০ টাকা এবং ইলিশ ১ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। ছবি: সুমন আলী/স্টার
গত ২ সপ্তাহে ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম অন্তত ২৫ শতাংশ বেড়েছে। আজ মঙ্গলবার ঢাকার কারওয়ান বাজারে প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৪৫ টাকায় এবং প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২১০-২২০ টাকায়। অথচ, ২ সপ্তাহ আগেও ডিমের দাম ছিল ১০৮ টাকা ডজন ও ব্রয়লার মুরগি ছিল ১৬০ টাকা কেজি।
এ ছাড়া, হাঁসের ডিম ২০০ টাকা ডজন, সোনালি মুরগি ৩০০ টাকা ও লাল মুরগি ২৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
গরুর মাংস ৭০০ টাকা এবং খাসির মাংস ১ হাজার ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
ঢাকার নবাবপুরের ইলেক্ট্রিক পণ্যের ব্যবসায়ী রাফিউল আলম বলেন, ‘নিজেদের জন্য তো দূরে থাক, বাসায় শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় এলেও আর গরু বা খাসির মাংস রান্নার কথা চিন্তা করতে পারি না। মুরগির দামও যেভাবে বাড়ছে, এটাও হয়তো আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাবে।’
‘আমাদের দোকানে বিক্রির অবস্থা ভালো না। মানুষ নিতান্ত না ঠেকে গেলে কিছু কিনছেন না। এ মাসের দোকান ভাড়া, বাসা ভাড়ার ব্যবস্থাও এখনো করতে পারিনি। মাস কীভাবে শেষ হবে সেই চিন্তায় আছি’, যোগ করেন তিনি।
প্যাকেটজাত তরল দুধের দামও ধাপে ধাপে বেড়ে প্রতি লিটারের দাম ৬৫ টাকা থেকে ৯০-৯৫ টাকা হয়েছে।
বাজারে আকারভেদে প্রতি কেজি রুই মাছের দাম ২৮০-৪৫০ টাকা, পাঙ্গাস ১৮০-২৫০ টাকা, তেলাপিয়া ১৮০-২৫০ টাকা এবং ইলিশ ১ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
প্রতি কেজি মিনিকেট চালের দাম ৭২-৭৬ টাকা, নাজিরশাইল ৭২-৮০ টাকা, ২৮ চাল ৬০ পর্যন্ত কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বেগুন, শিম, ধুন্দল, টমেটো, মুলাসহ অন্যান্য সবজির দাম কেজিপ্রতি ৩৫-৪৫ টাকা। ফুলকপি, বাঁধাকপির দাম প্রতি পিস ৩০-৪০ টাকা। প্রতি কেজি কাঁচা মরিচের দাম ১২০-১৪০ টাকা।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিনিয়োগকারীদের জন্যও ভালো না, প্রতিযোগিতামূলক বাজারের জন্যও খারাপ এবং ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতাও কমায়। কাজেই আমাদের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ নেওয়া দরকার এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে।
— মোস্তাফিজুর রহমান, বিশেষ ফেলো, সিপিডি
ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত রবিন ইসলাম জানান, ৫ শতাংশ বেড়ে এ বছর তার বেতন হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা। বাড়ি ভাড়া ২৫ হাজার টাকা, বাড়িতে বাবা-মাকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে দেওয়ার পর বাকি ১০ হাজার টাকায় তাকে খাবার, সন্তানের পড়াশোনা, নিজের যাতায়াতসহ বাকি সব খরচ মেটাতে হয়।
তিনি বলেন, ‘গত বছরের শুরুর দিকেও মোটামুটিভাবে চলতে পারতাম। কিন্তু এই ১ বছরে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়েছে। অফিসে যাতায়াত করি বাসে। সেই ভাড়াও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। নিজের কষ্টের কথা তো আর কাউকে বলতে পারি না, সহ্যও করতে পারছি না আর।’
‘খাবারের খরচও অনেক কমিয়ে ফেলতে হয়েছে, অন্যান্য খরচের কথা তো বাদই দিলাম’, যোগ করেন তিনি।
কারওয়ান বাজারের মাছ বিক্রেতা আনিস জানান, পরিবহন খরচ বাড়ায় মাছের দাম আগের চেয়ে কেজিতে গড়ে ২০ টাকা বেড়েছে। দাম বাড়ার কারণে মানুষ কিনছে কম। আগে যেখানে গড়ে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করতেন, এখন ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা বিক্রি হয়। ‘মানুষ শুধু দাম জিজ্ঞেস করে আর চলে যায়’, বলেন আনিস।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘নির্দিষ্ট বেতনের চাকরিজীবীদের তো আর আয় বাড়ছে না। স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতির ফলে তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমছে। এর বাইরে যারা আছেন তারা হয়তো তাদের পণ্য বা সেবার দাম বাড়িয়ে কিছুটা সমন্বয়ের সুযোগ পান।’
তিনি বলেন, ‘যাদের সমন্বয়ের সুযোগ আছে তাদের আয়ও যে অনেক বেড়েছে, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে দাম বাড়ালেও তাদের আয় সার্বিকভাবে হয়তো কমছে। একজন মাছ বিক্রেতা ১০ টাকার মাছ হয়তো ১৫ টাকায় বিক্রি করছে। কিন্তু তার মোট বিক্রি তো কমে গেছে।’
‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিনিয়োগকারীদের জন্যও ভালো না, প্রতিযোগিতামূলক বাজারের জন্যও খারাপ এবং ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতাও কমায়। কাজেই আমাদের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ নেওয়া দরকার এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে,’ যোগ করেন তিনি।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বৈশ্বিক বাজারে অনেক পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। সেইসঙ্গে ফিসক্যাল পলিসি, মনিটরি পলিসির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির প্রভাব কমাতে হবে।’
করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘স্বল্পমেয়াদী উদ্যোগ হিসেবে সবার আগে প্রান্তিক মানুষের জন্য কম দামে নিত্যপণ্য বিক্রি কার্যক্রম আরও বাড়াতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে, ম্যাক্রো ইকোনমি আরও শক্তিশালী করতে হবে। আমদানি বা উৎপাদন থেকে ক্রেতার হাত পর্যন্ত পণ্য পৌঁছাতে নানাভাবে বাজারে কারসাজি হচ্ছে। সেখানে শক্ত নজরদারি প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশীয় উৎপাদন ও চাহিদা সঠিকভাবে প্রাক্কলন করে সেই অনুযায়ী সময় মতো আমদানি করার মতো ব্যবস্থাপনার বিষয়েও নজর দিতে হবে। সব মিলিয়ে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী নানান উদ্যোগের মাধ্যমেই মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। ম্যাক্রো ইকোনমির কার্যকারিতা ও শক্তি বাড়িয়ে ধীরে ধীরে এটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।’