বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হতে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের দ্বারপ্রান্তে। তবে এ উত্তরণ মসৃণ ও ধারাবাহিক রাখতে শ্রম আইন ও অধিকার বিষয়ে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ বর্তমান। মসৃণ এই উত্তরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে শ্রমমান পরিস্থিতি সম্পর্কিত বিভিন্ন আইন, কাঠামোগত দূর্বলতা এবং প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। অন্যদিকে এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশ রপ্তানির ক্ষেত্রে যে অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা (preferential market access) পায়, তা সংকুচিত হবে। বাংলাদেশের জন্য বৃহত্তম রফতানি বাজার, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি+ সুবিধার জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত হতে পারলে উত্তরন-পরবর্তী কালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে রফতানির ক্ষেত্রে বাড়তি শুল্ক দেয়া থেকে সুরক্ষা পাওয়া যেতে পারে। এই সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে সাতাশটি মানবাধিকার ও শ্রমমান সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক রীতি মেনে চলতে হবে। যার মধ্যে পনেরোটি আইএলওর শ্রমমানের সাথে সম্পর্কিত। বিগত প্রায় আট বছর সময় ধরে শোভন কাজ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিভিন্ন আইন ও বিধিমালা সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আরোও উন্নতির সুযোগ রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে হয়রানি সম্পর্কিত বিষয়গুলো কে আইনী কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা; বাধ্যতামূলক শ্রম ইস্যু সঠিকভাবে মোকাবেলা; আইএলও বিশেষজ্ঞ কমিটির উদ্বেগের দিকে দৃষ্টি দেওয়া এবং সার্বিক তদারকি ও বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়ার বিষয়গুলো উঠে আসে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত “বাংলাদেশের জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-এর ইবিএ এবং জিএসপি+-এর সম্ভাবনা: শ্রম আইন ও অধিকার সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা” শীর্ষক ভার্চুয়াল সংলাপে। সংলাপটি অনুষ্ঠিত হয় বুধবার, ২০ জানুয়ারী ২০২১ তারিখে।
সংলাপে সূচনা বক্তব্য প্রদান করেন সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন বাংলাদেশের জিএসপি+ সুবিধা পেতে প্রাসঙ্গিক মানদণ্ডগুলোর পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে আইনগত ত্রুটিগুলো পর্যালোচনা এবং শ্রমের মান সম্পর্কিত জিএসপি+ এর সমস্ত প্রয়োজনীয়তা পূরণ বিষয়ে যৌথভাবে সিপিডি ও নেটওয়ার্কস ম্যাটার এই গবেষণা পরিচালনা করেছে।
মূল প্রতিবেদন উপস্থাপনায় সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক, ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি সুবিধা একটি বাণিজ্য কাঠামো প্রদান করে, যা পেতে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং সরকারকে মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের সুরক্ষা এবং প্রচারের পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন সুনিশ্চিত করতে হয়। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর জিএসপি+ সুবিধা পেতে শ্রম আইন নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি বলেন যে শিশু শ্রম, ট্রেড ইউনিয়ন আইন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি সহ শ্রম আইন ও অধিকারের সংস্কারের উন্নতির সুযোগ রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রেন্সজে তেরিঙ্ক এবং আইএলও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর জনাব টুওমো পটিয়াইনন সংলাপে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রদূত রেন্সজে তেরিঙ্ক-এর মতে বাংলাদেশকে শ্রমিকবান্ধব একটি দেশ হিসেবে পরিচিত করার প্রয়োজন রয়েছে, যা শুধু জিএসপি+ সুবিধা পেতে নয় বরং শ্রমিকদের সামগ্রিক উন্নয়নে সাহায্য করবে। জনাব টুওমো পটিয়াইনন প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির উপর বিশেষ জোর দেন এবং শ্রম আইন ও অধিকার বিষয়ে সংলাপ চলমান রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন।
দেশে অপ্রতিষ্ঠানিক খাতের ব্যাপকতার কথা উল্লেখ করে জনাব কামরান টি রহমান, প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) বলেন যে এই খাতে শ্রমিক আইন বাস্তবায়ন করা সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জনাব মোঃ বেল্লাল হোসেন শেখ, পরিচালক, প্রধান কার্যালয়, শ্রম অধিদপ্তর, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, সংলাপে উপস্থিত সবাই কে অবগত করেন যে, মন্ত্রনালয় একটি ডাটাবেজ তৈরির কাজ শেষ করেছে। এর মাধ্যমে ট্রেড ইউনিয়ন ও বিরোধ নিষ্পত্তি সম্পর্কিত তথ্য ও উপাত্ত দ্রুত সময়ের মধ্যে পাওয়া সম্ভব হবে।
সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতি জনাব রাজেকুজ্জামান রতন মনে করেন যে, দেশের উন্নতি ও শ্রমিকের উন্নয়নের স্বার্থে শ্রম আইন প্রয়োগ করা উচিৎ, শুধু বাইরের চাপে নয়। আইন সংস্কার দেশীয় প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে করার পরামর্শ দেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-এর সহ-সভাপতি জনাব আরশাদ জামাল দীপু। তবে ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সাধারণ সম্পাদক জনাব চৌধুরী আশিকুল আলম মনে করেন যে, গার্মেন্টস সহ অন্যান্য শিল্পে বৈশ্বিক সংযুক্তি থাকায়, আইন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সাথে মিলেই তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ)-এর সহ-সভাপতি জনাব মোহাম্মদ হাতেম সংলাপে আরেকজন আলোচক হিসেবে বক্তব্য প্রদান করে বলেন যে ক্রেতাদের আরও দায়িত্ববান ভূমিকা পালন করতে হবে। বৈশ্বিক পর্যায়ের শ্রমিক আইন মানতে, ক্রেতাদের বৈশ্বিক পর্যায়ের দাম নিশ্চিত করতে হবে, যা বাংলাদেশের শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
সংলাপটি সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি। কাঠামোগত দূর্বলতা এবং প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জগুলোকে বিশেষ মনোযোগ দেয়ার দরকার আছে বলে তিনি মনে করেন এবং সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে সংলাপের মাধ্যমে শ্রম আইন ও অধিকার নিশ্চিতের গুরুত্ব তিনি আবার তুলে ধরেন।
সংলাপে সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ, সাংবাদিক, গবেষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন পেশাজীবীসহ অনেকে অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের মতামত তুলে ধরেন।